বেশিরভাগ মানুষ যে প্রবাল প্রাচীরের নামই শোনেনি!
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : ‘কল্পনা করুন আপনি একটি পুরনো বনের মধ্যে ভেসে ভেড়াচ্ছেন। হয়তো আপনি বনের একদম নিচেই ভেসে বেড়াচ্ছেন, উপরে তাকিয়ে গাছপালার ফাঁক দিয়ে মৃদু সূর্যরশ্মি দেখতে পাচ্ছেন। অথবা ভেসে বেড়ানোর সময় নিচে তাকিয়ে দৈত্যাকৃতির গাছপালা দেখছেন। আমার অভিজ্ঞতা অনেকটা এরকমই অসাধারণ ছিল। সামুদ্রিক প্রাণীর পাশাপাশি অন্যতম আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল কেল্প।’
এভাবেই সমুদ্র তলদেশের কেল্প বনে নিজের স্কুবা ডাইভিং অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন তাসমানিয়ার ইগলহক ডাইভিং সেন্টারের মালিক মিক ব্যারন।
তাসমানিয়ার কেল্প বনের ৯৫ শতাংশই হারিয়ে গেছে। সেইসাথে এল নিনো পর্যাবৃত্ত পরিবর্তনের ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে সমুদ্রের তাপমাত্রা। ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ান সরকার একে বিপন্ন বাস্তুসংস্থান ঘোষণা দেয়।
ব্যারন বলছিলেন, ‘এই বনের বিরাট অংশ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানেই একদম হারিয়ে গেছে। এর খুব অল্প অংশই বাকি ছিল।’
তাসমানিয়ার এই বিরাট কেল্প বন থেকেই ৮০০০ কি.মি. বিস্তৃত ‘গ্রেট সাউদার্ন রিফ’ নামের প্রবালপ্রাচীরের একাংশ গড়ে উঠেছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রায় ৭০ শতাংশ জনগণই এই প্রবালপ্রাচীরের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে বাস করলেও, বেশিরভাগই কখনো এর নাম শোনেনি। ২০১৬ সালের আগে এই অনন্য প্রবালপ্রাচীরের নামকরণ-ই করা হয়নি।
জীববৈচিত্র্যের অনন্য নিদর্শন গ্রেট সাউদার্ন রিফ হাজার হাজার প্রজাতির বিরল প্রাণীর বাসস্থান। সি-ড্রাগন, সি-হর্সের মতো আরও অসংখ্য প্রাণী বাস করে এখানে যা পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায়না। অন্তত আরও ১০ হাজার প্রজাতির এখনো নামকরণ-ই করা হয়নি।
এ অঞ্চলে পর্যটন ও মাছ ধরার মাধ্যমেই প্রতিবছর ১০ বিলিয়ন ডলার আয় হয়। এ অঞ্চলের চিংড়ি ও ঝিনুক বিক্রির মাধ্যমে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের মৎস্য শিল্পের থেকেও চারগুণ বেশি লাভ হয়।
বেশিরভাগ বিজ্ঞানীরা মনে করে গ্রেট সাউদার্ন রিফের পরিবেশ উত্তরাঞ্চলের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে, তবে জলবায়ু পরিবর্তন বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামুদ্রিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে যা ‘কোরাল ব্লিচিং’ নামে পরিচিত। এধরণের ক্ষতির মুখে পড়তে পারে গ্রেট সাউদার্ন রিফও। ‘কোরাল আইভিএফ’, ‘হিট রেজিস্ট্যান্ট মাইক্রো অ্যালিগাই’ সহ বিভিন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা গ্রেট ব্যারিয়ার রিফকে আগত দুর্যোগ থেকে রক্ষার জন্য কাজ করছেন।
সামুদ্রিক কেল্প বনাঞ্চলের পরিমাণ কমে যাওয়ায় সামুদ্রিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে বাস্তুসংস্থানের সামগ্রিক পরিবেশ।
ইউনিভার্সিটি অব তাসমানিয়ার ইনস্টিটিউট অব মেরিন অ্যান্ড অ্যান্টার্কটিক স্টাডিজ (আইএমএএস) এবং ক্লাইমেট ফাউন্ডেশন যৌথভাবে তাসমানিয়ার কেল্প বনের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করছে।
আইএমএস এর একজন গবেষক ড. কেইন লেইটন জানান, ‘পানির উষ্ণ তাপমাত্রার পাশাপাশি অ্যালিগাই খেয়ে বেঁচে থাকা উষ্ণ পরিবেশের সামুদ্রিক প্রাণীও কেল্পের জন্য ক্ষতিকর। কারণ কেল্পও একধরনের অ্যালিগাই।’
তবে আশার বিষয় হলো, উষ্ণ আবহাওয়াও টিকে থাকতে পারে এধরণের কেল্প তৈরি করছেন বিজ্ঞানীরা।
ড. লেইটন বলেন, ‘আমরা পানির বিভিন্ন তাপমাত্রায় কেল্পের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছি। উষ্ণ তাপমাত্রায় টিকে থাকতে সম্ভব এমন প্রজাতির নাম সুপার কেল্প, গবেষণাগারে এগুলোর বংশবৃদ্ধি করে রোপণ করেছি।’
২০১৯ সালে পরীক্ষামূলক ভাবে সুপার কেল্পের রোপণ পদ্ধতিতে সাফল্য পাওয়া যায়, বিজ্ঞানীরা দ্বিতীয় দফায় আবার কাজ শুরু করেছেন।
সমুদ্র বিজ্ঞানীদের মতে, গ্রেট সাউদার্ন রিফ এবং এর কেল্প বনাঞ্চল রক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো, এর অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা।
সংকটাপন্ন কিন্তু কম আলোচিত ও সুরক্ষা বিহীন সামুদ্রিক অঞ্চলগুলোকে ‘হোপ স্পট’ বলা হয়। মিশন ব্লু প্রতিষ্ঠানের সাথে এই প্রবালপ্রাচীরকে হোপ স্পট ঘোষণার জন্য ক্যাম্পেইনে কাজ করছেন ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র বিজ্ঞানী সাহিরা বেল।
তিনি জানান, এই ক্যাম্পেইনে কাজ করার সময় অনেক অস্ট্রেলিয়ান জনগণও জানায়, এতো আকর্ষণীয় এই প্রবাল প্রাচীরের অস্তিত্ব ছিল তারা তা জানতেন না।
অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ার ডিকিন ইউনিভার্সিটির সমুদ্র বিজ্ঞানী ও সমুদ্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. প্রু ফ্রান্সিস তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই প্রবালপ্রাচীর নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছেন। এনিয়ে তিনি শিশুদের জন্য একটি বই লিখছেন যা ২০২১ সালে প্রকাশিত হবে।
অস্ট্রেলিয়ান মেরিন বায়োলজিস্ট স্টেফান অ্যান্ড্রুজ গ্রেট সাউদার্ন রিফ নিয়ে একটি ফিচার ডকুমেন্টারি তৈরি করছেন যা শীঘ্রই প্রচারিত হবে।
তিনি বলেন, ‘প্রবাল প্রাচীরগুলো কতোটা মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ তা প্রচারের উদ্দ্যেশ্যে এবং গ্রেট সাউদার্ন রিফকে অস্ট্রেলিয়ান সংস্কৃতিতে সংযোজনের উদ্দ্যেশ্যেই কাজ করছি।’