গৌরবের সাক্ষী বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর
আদিবা বাসারাত তিমা : জাদুঘর সবসময় মানুষের অতীত বা তাদের পূর্বপ্রজন্মের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, দর্শন, জ্ঞান সবকিছু সংরক্ষণ করে থাকে। কারণ এসব জাদুঘরই অতীত আর ভবিষ্যতের মধ্যে সংযোগ তৈরি করতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক শিল্পকলা ও প্রাকৃতিক নিদর্শন সংগ্রহ করে, প্রদর্শন করে এবং গবেষণার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের পথচলা শুরু। বহুমাত্রিক শিক্ষা, সাংস্কৃতিক কর্মপরিসরে আজ বিস্তৃত তার শাখা-প্রশাখা।
ঢাকার ইতিহাসের সঙ্গে জাদুঘরের ইতিহাস জড়িত। ১৯৮৫ সালের ১ নভেম্বর ‘দ্য ঢাকা নিউজ’ পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে ‘জাদুঘর’ স্থাপনের ব্যাপারে আলোচনার সূত্রপাত ঘটে।
জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯০৯ সালে শিলং থেকে কিছু মুদ্রা ঢাকায় স্থানান্তর হওয়ার পর। ১৯১০ সালের ১ মার্চ বিশিষ্ট মুদ্রাতত্ত্ববিদ এইচ এ স্টাপলটন গর্ভনর ল্যান্সলট হিয়ারকে ঢাকায় একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
১৯১২ সালের ২৫ জুলাই ঢাকার নর্থব্রুক হলে সুধীবৃন্দ সভায় মিলিত হন। ১৯১৩ সালের ৫ মার্চ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার অনুমোদন গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।
১৯১৩ সালের ২০ মার্চ ঢাকা জাদুঘর ২ হাজার রুপি তহবিলে যাত্রা শুরু করে। বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল তৎকালীন ঢাকা মেডিকেল কলেজের একটি কক্ষে ‘ঢাকা জাদুঘর’ উদ্বোধন করেন।
৩০ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রভিশনাল জেনারেল কমিটি গঠিত হয়। পরের বছর ১৯ মে প্রথম নির্বাহী কমিটির সভায় ১৯১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হয়। এসময় জাদুঘরের একজন কিউরেটর নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১৪ সালের ৬ জুলাই নলিনী কান্ত ভট্টশালী মাসিক একশ রুপি বেতন ভাতায় কিউরেটর নিযুক্ত হন। নলিনী কান্ত ভট্টশালী ছিলেন বিশিষ্ট মুদ্রাতত্ত্ববিদ, ভাস্কর বিশেষজ্ঞ।
তার অধ্যবসায়, কর্মদক্ষতা ইতিহাস, ঐতিহ্য অনুরাগের মাধ্যমে জাদুঘর বিকশিত হয়। নিদর্শন সংগ্রহ, গবেষণা, প্রদর্শন সজ্জিত করার কাজ দ্রুত এগোতে থাকে।
৩৭৯টি নিদর্শন নিয়ে জাদুঘর প্রদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ১৯১৪ সালের ২৫ আগস্ট। ঢাকার দানশীল ব্যক্তিরা জাদুঘরে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারকগুলো প্রদর্শনের জন্য উপহার হিসেবে প্রদান করেন।
১৯১৫ সালের জুলাই মাসে সচিবালয় থেকে নিমতলীর বারোদুয়ারি ও দেওড়িতে ‘ঢাকা জাদুঘর’ স্থানান্তর করা হয়।
নিমতলীতে অবস্থিত ‘ঢাকা জাদুঘর’ ক্রমে পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিত্তবান, ইতিহাসমনস্ক ব্যক্তিদের নিরলস পৃষ্ঠপোষকতায় জাদুঘরে সংগ্রহ বাড়তে থাকে।
১৯৮৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর জাতীয় জাদুঘর অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। একই বছরের ২০ নভেম্বর জাতীয় জাদুঘর ভবন উদ্বোধন করা হয়।
‘ঢাকা যাদুঘর’ ‘বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে’ আত্মীকৃত হয়ে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদায় উন্নীত হয়।
শাহবাগে অবস্থিত বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর আজ গৌরবের বহুমাত্রিক নিদর্শন প্রদর্শন ও সংরক্ষণের প্রতিষ্ঠান হয়ে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সেতুবন্ধন রচনা করেছে।
৮.৬৩ একর জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর শুধু একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা নয়, পরিপূর্ণ সংরক্ষণশালাও বটে।
৪৫টি প্রদর্শনী কক্ষ, দুটি মিলনায়তন, একটি বিশেষ গ্রন্থাগার, একটি শ্রুতি চিত্রন শাখা, প্রকাশনা শাখা নিয়ে জাতীয় জাদুঘর বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান।
চারতলা জাদুঘর ভবনের ২০ হাজার বর্গমিটার জুড়ে রকমারি নিদর্শনের প্রদর্শন দৃষ্টিনন্দন। বাংলার ইতিহাসের ধারাবাহিক উপস্থাপন অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত ঘটনাপঞ্জি ইতিহাসের স্মারকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়।
বীর, যোদ্ধা, ইতিহাসের পাত্রপাত্রী সরব উপস্থাপনায়। বাংলা অঞ্চলের ইতিহাস, বাঙালির আত্মত্যাগে গৌরবদীপ্ত। জাতীয় জাদুঘর উপস্থাপনা, শৈলীর মাধ্যমে মূর্ত করে তুলেছে ইতিহাসকে।
তরুণ প্রজন্মের কাছে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবন ও কর্ম তুলে ধরা হয়েছে।
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ভিডিও, অডিও উপস্থাপন হৃদয়গ্রাহী। সেমিনার, আলোচনা, প্রদর্শনীতে মনীষীদের অবদান তুলে ধরা হয়েছে।
জাতীয় জাদুঘরের আর্কাইভ ও শ্রুতচিত্রণ শাখা কথ্য ইতিহাস ও প্রাচীন দলিলপত্রে সমৃদ্ধ। বিশাল ভাণ্ডারে যুক্ত হয়েছে অমূল্য রত্ন। এর পেছনে রয়েছে উপহার দাতা, বিক্রেতা ও জাদুঘর কর্মীদের মিলিত শ্রম।
প্রাচীন নিদর্শন সংগ্রহের মাধ্যমে জাদুঘরের গোড়াপত্তন হয়েছিল। আজ সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সমকালীন বস্তুসম্ভার সংযুক্ত হয়েছে জাদুঘরে। পৃথিবীব্যাপী জাদুঘরের কর্মকাণ্ড প্রসারিত হয়েছে।
প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাদুঘরকে দর্শকপ্রিয় করার ব্যাপারে জাদুঘর কর্মীদের নিত্য নতুন ভাবনা ভাবতে হচ্ছে। প্রদর্শনের নতুনত্ব ও পর্যাপ্ত তথ্য জাদুঘর ভাণ্ডারে যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর অনুষ্ঠানমালায় নতুনত্ব এনেছে।
প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত নিদর্শনের খুঁটিনাটি দিক কম্পিউটার ও ট্যাবে প্রতিনিয়ত আকর্ষণীয়, চলমান ও জীবন্ত করে দর্শকদের কাছে উপস্থাপন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে স্বাধীন বাংলা বেতার কক্ষে শব্দ সৈনিকের অংশগ্রহণ, স্মৃতিচারণ ও স্মৃতি সামগ্রী প্রদর্শন করা হয়েছে।
এ ধরনের অসংখ্য বিশেষ প্রদর্শনী জাতীয় জাদুঘরে হয়ে থাকে। নিদর্শন সংগ্রহ চলমান প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। আধুনিক জাদুঘর নিত্যনতুন পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
বস্তু নিদর্শন উপস্থাপন আকর্ষণীয় ও তথ্যবহুল করার বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছে।
বীর ও শহীদের দানে গড়ে ওঠা এই দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক উপাদান সংরক্ষণ অতীব প্রয়োজন। আর এ কাজটিই জাতীয় জাদুঘর স্বগর্বে করে থাকে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের নিরন্তর পথচলা কল্যাণময় হোক।