করোনা পরিস্থিতিতে জীবন ও জীবিকার প্রশ্ন?

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৪, ২০২০; সময়: ৬:১২ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
করোনা পরিস্থিতিতে জীবন ও জীবিকার প্রশ্ন?

মো. আবদুল কুদ্দুস : কোভিড-১৯ এর থাবা সারা বিশ্বকে গ্রাস করেছে। মানুষসহ সকল প্রাণির জীবন ও জীবিকার পথ হুঁচট খেয়েছে অনেক আগেই। এখন উন্নয়নশীল বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মুখে কিছু সরল প্রশ্ন; জীবন ও জীবিকা আবারো একসাথে সচল হবে? কবে নাগাদ জীবন আবার গতিশীল হবে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ, অফিস-আদালত, পার্ক, সমুদ্র সৈকত আবার কবে নতুন প্রাণ ফিরে পাবে? শপিং কমপ্লেক্্র চালু হবে কবে? সেদিন কবে আসবে যখন নব দম্পতিরা প্রশাসনের ভয়ে বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠে পালাতে বাধ্য হবে না? আবার কবে আমাদের মাথার উপরে ভুঁ ভুঁ করে বিমান চলবে? আবার কবে রেললাইনে ঝন ঝন করে ট্রেন চলবে? পিপ পিপ করে হর্ন বাজিয়ে মহাসড়কে বাস-বাইক চলবে কবে? সদা জাগ্রত ঢাকা শহর উৎপাদনের কাজে নির্ঘুম রাত শুরু করবে কবে?

এমন দিন কবে আসবে যেদিন মানুষ করোনার ভয়ে ট্রাকে করে নিজ গ্রামে ফিরে যাবে না! সেই দিন কবে ফিরবে যেদিন মানুষ জীবিকার তাগিদে তাঁর নিয়োগকর্তার ডাকে সাড়া দিয়ে প্লাস্টিকের ড্রামের ভিতরে মাথা লুকিয়ে কর্মস্থলে ফিরতে বাধ্য হবে না? এমন দিন কবে আসবে যেদিন মানুষ নিজ গৃহে ফিরে বিনা অপরাধে গৃহবন্ধী হবে না? এমন শুভ দিন কবে ফিরবে যেদিন খেটে খাওয়া মানবকূল জীবিকার জন্য হাটে-বাজারে এসে ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখে কান ধরে দাঁড়িয়ে পড়বে না? এমন দিন কবে ফিরে পাবো যেদিন আবার মানুষ একে অপরকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরবে? কোলাকুলি করবে, হ্যান্ডশেক করবে! মুখের পর্দা খুলে কথা বলবে, মিষ্টি হাসি হাসবে! কর্মজীবিরা সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে অফিসের পথে রওনা হবে। ফিরবে কি সেই দিন? যেদিন মানুষ কাজ থেকে ফিরে ঘরের দরজায় দন্ডায়মান পরম আদরের শিশুটিকে নির্বিঘ্নে কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরবে? কবে মসজিদসহ সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান খুলে যাবে? জানাজার জন্য লাশের পাশে লাখো মানুষ দাঁড়াবে কবে? আবার আসবে তো সেই দিন? খুব আশায় আছি। অবশ্যই সেই দিন ফিরবে আমাদের মাঝে। মানুষ বন্দীদশা থেকে মুক্ত হবে। পৃথিবীর বুকে বয়ে যাবে শান্তির সুবাতাস।

সংশয়ের এতো প্রশ্নের জবাব দিয়ে এমন দিন কীভাবে ফিরে আসবে তা আমাদের জানা নেই। কেননা কোভিড-১৯ নিরাময়ে পৃথিবীর কোন ডাক্তার আজ পর্যন্ত প্রেসক্রিপশন লিখতে পারেন নি। সেতো দূরেরই কথা। গবেষণাও শুরু হয় নি সামান্যও। তবে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে বিশ্বের রাষ্ট্র প্রধানগণ প্রেসক্রিপশন লিখে যাচ্ছেন প্রতিদিন। নিয়মিত মানুষের জন্য স্বাস্থ্যবিধি তৈরী করছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। প্রেসক্রিপশনে যা লেখা হলো, তাতে দেখা মিললো, সকল রাষ্ট্রের জন্য একটিই ঔষধ ‘লকডাউন’। দেশটির স্ট্যাটাস উন্নত হোক বা উন্নয়নশীল হোক! এই ঔষধের কোন মাত্রা নেই। কোন পাওয়ার উল্লেখ নেই। ঔষধের গায়ে লেখা নেই কোন ডোজেজ অর্থাৎ ঔষধটি কতদিন প্রয়োগ করতে হবে তার কোন নির্দ্দিষ্ট সময়সীমা নেই! কোভিড-১৯ এর রোগী প্রতিটি দেশ, প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি প্রাণি এমনকি প্রতিটি জড় বস্তুও।

এখনো কোন আশার আলো নেই। কারণ সারাবিশ্বে রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে ব্যাপক হারে। তবে সেই দিনের আশায় নয়। হয়তো বর্তমানে জীবন ধারণ করে বেঁচে থাকবার জন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশে সরকারী উদ্যোগে ব্যবসায়ীদের ভাগ্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা জুটেছে। সার্বিক আর্থনীতি এগিয়ে নিতে ঘোষণা করা হয়েছে বাহাত্তর হাজার সাতশত পঞ্চাশ কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ করোনাযুদ্ধা ডাক্তার বন্ধুদের জন্য জুটেছে কিছু পুরস্কার। আর জীবন-জীবিকার মেরুদন্ড অর্থসেবী ব্যাংকার ভাইদের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে বিমা প্যাকেজসহ আর্থিক প্রেষণা। কৃষক বন্ধুদের জন্য দেওয়া হয়েছে পাঁচ শতাংশ সুদে ঋণের ব্যবস্থা। মানুষের আনন্দ শোভাযত্রা আপাতত বন্ধ। চলছে মৃত্যুর মিছিল। জানাযা করবার লোক নেই। রাজপথ বন্ধ। বন্ধ আকাশপথ। নৌপথে কী হচ্ছে জানি না। কেবল জরুরী প্রয়োজনে ও খাদ্যসামগ্রী আনা-নেওয়ার কাজে চলছে পণ্যবাহী যান। আর ফাঁকা রাজপথে হুংকার দিয়ে চলছে অ্যাম্বুলেন্স। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ আজ দিশে হারা। তাঁরা কেবল তাদের কর্মচারীদের হাতে জীবন রক্ষার দায়-দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে দিন যাপন করছে। বেতনের আশা নেই তবুও সাংবাদিক বন্ধুরা ছুটে বেড়াচ্ছেন মানুষকে খবর জানানোর জন্য। অবশ্য তাঁদের জন্য এখন পর্যন্ত কোন প্রণোদনা প্যাকেজ ও পুরস্কার ঘোষণা হয়েছে বলে আমি জানতে পারি নি!

এমতবস্থায় মানুষের দাবি-দাওয়ার ও শেষ নেই। ভাড়াটিয়ায়া বলছেন বাড়ির ভাড়া মাফ করে দিতে হবে। ছাত্র বন্ধুরা আওয়াজ দিচ্ছেন টিউশন ফি পরিশোধ করবো কেমন করে? ম্যাচের সিট ভাড়া মাফ করে দিতে হবে। অনেকের দাবি আছে মোবাইল ফোন আপারেটর কোম্পানীকে বিনামূল্যে ইন্টারনেট প্যাকেজ দিতে হবে। কিন্তু যেসব মানুষের জীবন ওই কেবলমাত্র বাড়ি ভাড়ার টাকা দিয়ে চলে তাঁদের জীবিকা কী হবে? তা জানার বা বোঝার জন্য কেউ প্রশ্ন তোলে নি। বে-সরকারী চাকুরীজীবি বন্ধুগণ শুধু বেতন নয় চাকরী হারানোর ভয়ে আতংকিত প্রহর গুনছেন প্রতিদিন। শেষ পর্যন্ত তাদের ভাগ্যে কী হবে কেউ জানেন না! ‘লকডাউন’ নামক ওই ঔষধটি কী শেষ পর্যন্ত পারবে কোভিড-১৯ নিরাময় করতে? হয়তো এই পদ্ধতি মানুষকে জীবনে বেঁচে থাকার জন্য সহায়তা দিবে। বেঁচে যাবে শত সহশ্র প্রাণ। কিন্তু বেঁচে থেকে না খেয়ে পরিবার নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া ওই মানুষগুলোর জীবন ও জীবিকার পথ আবিস্কারের জন্য এখনই গবেষণা হওয়া দরকার নয় কী? তার জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠন এখনই প্রয়োজন নয় কী? তাছাড়া খাবার জন্য লড়াইয়ের সেই মহামারী আরো বিপদের হবে না তো? হয়তো খাদ্যের অভাবে মানুষ চুরি করবে। জীব-জন্তুর কাঁচা মাংস খাবে। সাপ পোকা-মাকড় সব খাবে। বিলুপ্ত হবে সভ্যতা। আমরা কতটুকু প্রস্তুত?

আমি বুঝি, মহামারিতে কোন শাসসনতন্ত্র খাটে না। প্রযোজ্য হয় না কোন অর্থনৈতিক তত্ত্ব। আমার দেশে অনেক লোক আছে যারা আজকের মাহামারী বাদে অন্য সময় কাজ না করে ঘরে বসে থাকে। খাবার না পেয়ে হাড্ডিসার হয়ে যায়। রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তাতে অবশ্য সরকারকে কেউ দোষ দেয় না। কিন্তু মাহামারীতে একজন মানুষ মারা গেলেই সরকারের দোষ? হ্যাঁ সেটি সরকারেরই দোষ। কেননা মানুষ সরকার গঠন করেছে মানুষের কল্যাণের জন্যই। ব্যার্থ হলে দোষ তো হবেই। এই পদ্ধতিতে কাজ না হলে মানুষের প্রয়োজনে বিশ্বব্যাপী বিককল্প শাসন পদ্ধতির আবিস্কার হবে নিশ্চয়।

লেখক: মো. আবদুল কুদ্দুস, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক, মোবাইল- ০১৭১৭৮৫৪১০৪

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে