দাম্ভিক করোনাভাইরাসের সংশয়াকুল অনুভূতি
মুহাম্মদ আব্দুল মুমীত : পরিচয়ের ব্যাপ্তিটা চীনের উহান হতে শুরু হলেও জন্ম আমার ১৯৬০ এর দশকে। জন্মদাতাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তবে সুন্দর একটি নামের জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা নিরন্তর।করোনা শব্দের অর্থ ’মুকুট’। অবশ্য এ মুকুট ’বিষমুকুট’, কেননা আমার নামের সাথে যে ভাইরাস শব্দটি যুক্ত আছে ল্যাটিন এ শব্দের অর্থ ’বিষ’। তাইতো নামের আমীলিতেই ভয়, আতঙ্ক ও ঘৃণার অন্ত নেই মানুষের! মূলত আমি নিদুভাইরাস বর্গের করোনাভাইরদা পরিবারের আরএনএ গ্রুপের একটি ভাইরাস, যা করোনাভাইরিনা উপপরিবারের অন্তর্ভূক্ত।
২০০৩ সাল থেকেবিভিন্ন নামে এ পৃথিবীতে পরিচিতি পেলেও সর্বশেষ ২০১৯ সালে এসএআরএস-সিওভি-২নামে চীনে আবির্ভূত হয়ে নোভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) নামে বিস্তৃতি লাভ করি। লোকেরা আমাকে যত খ্যাপাটে মনে করে ততটা খারাপ আমি নই। কারণ আমি আমার মনিবের সাথে কখনোই বিশ্বাসঘাতকতা করি না।
দায়িত্বে অবহেলা আর অনৈতিক কার্যকলাপের তো প্রশ্নই ওঠে না। সামান্যতম ভিন্ন চিন্তা থাকলে আমেরিকা ইউরোপের মতো উন্নত দেশগুলোতে কাজ করতে গিয়ে অনেক লাভবান হতে পারতাম হইনি। হয়ত অদৃশ্য শক্তির এটি একটি অন্যতম কারণ হতে পারে। তাছাড়া আমার কলেবরের উপরিভাগ প্রোটিন সমৃদ্ধ থাকে যা ভাইরাল স্পাইল পেপলোমার দ্বারা গঠিত হওয়ায় এটি প্রোটিন সংক্রমিত হওয়া টিস্যু বিনস্ট করে; ফলশ্রুতিতে আমি সবাইকে সংক্রমিত করতে পারি কিন্ত নিজে অধোরাই থেকে যাই। চারটি প্রজাতির (আলফা করোনাভাইরাস, বেটা করোনাভাইরাস, ডেলটা করোনাভাইরাস, গামা করোনাভাইরাস) অনেক বড় পরিসরের পরিবার হওয়ায় বিজ্ঞানীদের পক্ষে আমার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপারই বটে!
অদৃশ্য অবস্থান, দ্রুতগতির গমনাগমন এবং উচ্চ মাত্রার সংক্রমণ সক্ষমতা মানুষের আতঙ্কেরআরও একটি কারণ। পারমাণবিক বোমা থেকে শুরু করে কোন মারণাস্ত্রকেই আমি ভয় পাই না, যেহেতু তারা লক্ষ্যবস্তুু ব্যতিত নিশানাই নিতে পারে না। মহাপরাক্রমশালী মার্কিন যুক্তরাস্ট্রসহ ইউরোপের অতিক্ষমতাধর দেশগুলোকে দোর্দন্ডপ্রতাপের সাথে নিমিষেই পরাভূত করে আফ্রিকা অস্ট্রেলিয়া হয়ে পুনরায় পাড়ি জমিয়েছি নিজ জন্মভুমি দক্ষিণ এশিয়ায়। নাতিদীর্ঘ এ পথচলায় কোন দেশ বা কাউকেই নিজের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বি বা হুমকির কারণ হিসেবে ভাবিনি, এখানো ভাবিনা।
প্রজননে আমি অত্যন্ত সক্ষম হওয়ায় যেকোন মুহুর্তে ইচ্ছে মতো ডেরিভেটিভস তৈরি করতে পারি; যারা জন্মের পর থেকেই দায়িত্ব পালনে সক্ষম। তাইতো বর্তমানে ২১০টির অধিক দেশে একসংগে কাজ করতে আমার সামান্যতমও বেগ পেতে হয় না। পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে চলে যেতে পারি চোখের পলকেই।কয়েকমাস একাধারে কাজ করতে করতে অনেকটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তাই সামান্য সময় বিশ্রাম নিলাম: ফাঁকে পুরানো অভ্যাসে বেশ কিছুটা বইও পড়ার সুযোগ পেলাম।
এইতো সেদিন এলাম এদেশে। পরন্ত বিকেলে যখন বিমান থেকে নামলাম অবাক হয়েছি এদেশের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে, যা আমাকে মোহগ্রস্ত করে তুলেছে।নিজেকে ফিরে পেলাম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুুরের সেই কবিতায়: ’অবারিত মাঠ, গগন ললাট চুমে তব পদ-ধূলি, ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি’। এখানকার মানুষগুলো দেখতে অনেক নিরীহ ও শান্ত স্বভাবের। ইউরোপ ও আমেরিকার মতো নয় এঁরা। ভাল লাগল; কিছুটা শংকাও তৈরি হলো। কারণটা পরে জানা যাবে। প্রায় সপ্তাহ পার হলো বাইরে বের হইনি। ভাল ও মন্দের দ্বিধা-দ্বন্দে¦ বিষিয়ে উঠতে লাগল মনটা। একবার ভাবলাম এদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় সমীচীন হবে। অবাক হতে শুরু করলাম ক’দিন পর থেকেই।
অনেক পথ পাড়ি দিয়েছি, উপরে কয়েকদিনের বন্দি জীবন, বেশ ঝিমিয়ে পড়েছিলাম। ভাবলাম একটু চা খেলে মন্দ হয়না। রাস্তায় বের হলাম। ওমা একি! এতটুকু একটা দেশে এত লোকের বাস! রাস্তায় লোকজনের ঠেলাঠেলিতে নিশ্বাষ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো; কোন মতে নিজেকে সামলে নিলাম। আরও কয়েকদিন কেটে গেল ভাবতে ভাবতে। নিজের প্রয়োজনে রাস্তায় নামলে দু’একজন আমার সান্নিধ্যে এসেছে; ব্যক্তিগতভাবে এখন পর্যন্ত কাউকে আঘাত করিনি। ঘরে বসে বসেই সরকারের বিভিন্ন প্রস্তুুুতি, মহড়া এবং তদন্ত সংক্রান্ত আদেশ ও নির্দেশনার প্রতি নজর রাখছিলাম। সরকারের পদক্ষেপগুলো অনেক প্রশংসার। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রেস ও মিডিয়ার তৎপরতা ক্রমেই আমাকে ভাবিয়ে তুলতে লাগল।
একদিন ছাদের উপর বসা ছিলাম, তীব্র শোরগোল কানে আসতে লাগল; দেখলাম কিছু সংখ্যক সরকারি লোকজনজনসাধারণকে ঘরে ফিরিয়ে নিতে ব্যস্ত। জনগণ কিছুতেই বুঝতে চাইছেনা যে, ঘরই তাদের জন্য নিরাপদ স্থান। প্রশাসন সিন্ধান্তে অনড় ও অবিচল ঠিক যেন ধনুভঙ্গ পণ নিয়েই মাঠে নেমেছেন তাঁরা। এছাড়া বিকল্প কোন উপায়ও তাঁদের কাছে নেই আপাতত। খুব মনোযোগ দিয়ে উপভোগ করতে লাগলাম। কিন্তুু একি? প্রশাসনের ভয়ে সবাই ঘরে ঢুকছে বটে, কিন্তুু‘ যেই তাঁরা অন্যস্থানে চলে যাচ্ছেন আবার সেই পূর্বের অবস্থা বিরাজ করছে। এ যেন খুদে প্ল্যাংটন ভরা বিশাল কোন পুকুরে ঢিল ছুড়ার মতো; একটু পরেই আবার সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ছাদ থেকে তাঁদের পিছু নিলাম অভিজ্ঞতা অর্জনের অভিপ্রায়ে।
ক্রমেই যেন অবাক হতে লাগলামএদেশের মানুষের আবেগ আর অনুভূতি দেখে। এক দোকানে দেখলাম প্রশাসনের ভয়ে সবাই চায়ের স্টলের ঝাপ নামিয়ে ভিতরে বসে প্রশাসনের সমালোচনা করছে। আমি অতি সন্তর্পনে আড়ি পাতলাম। একি! লোকগুলোর দেখি আমার প্রতিও সামান্য ভয় নেই।তাদের এই অবস্থা দেখে অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের ’পল্লীসমাজ’ উপন্যাসের রমেশকে উদ্দেশ্য করে গ্রামবাসীর উক্তিগুলো মনে পড়ে গেল: দেখিছিস নে, ওর নিজের গরজটাই বেশি। জুতো পায়ে মসমসিয়ে চলা চাই কিনা! এতকাল- যে ও ছিল না, আমাদের ইস্টিশান যাওয়া কি আটকে ছিল? ঘরে ফিরে এলাম।
ভাবতে লাগলাম কত অবুজ আর জেদী এ লোকগুলো।চিন্তার লেশমাত্র নেই তাদের চোখে-মুখে; কি ঘটবে আর কি ঘটতে যাচ্ছে এখানে? সামান্যতম ভ্রুক্ষেপও নেই সে ব্যাপারে। একবার ভাবলাম এদের আগের প্রজন্ম বুঝি হিপনোটাইস করেই ওদেরকেমাঠে নামিয়েছে নিজের ভালোটা না বুঝার জন্য। অসহায় বোধ করছিলাম। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমার পূর্বপ্রজন্ম যারা বিভিন্ন সময় এ পৃথিবী শাসন করেছে, তাদের শরণাপন্ন হলাম।
আলাপ হলো: ইবোলা ভাইরাস, রেবিজ ভাইরাস, বার্ড ফ্লু (এইচ৫এন১), মরবুর্গ ভাইরাস, ডেঙ্গু (ট্রপিক্যাল ফ্লু) ও এইডস ভাইরাস (এইচআইভি) এর সাথে। আলাপচারিতার ফাঁকে খবরের কাগজ উলটাতেই শিউরে উঠলাম! অত্যন্ত আশ্চর্যের কথা: ১৯১৮ থেকে ১৯১৯ সালের মধ্যে স্প্যানিশ ফ্লু ভাইরাসের সংক্রমণে প্রাণ দিতে হয়েছে প্রায় পাঁচ থেকে দশ কোটি মানুষের, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় তিন শতাংশ (সুত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ১৩ মার্চ ২০২০)।ব্যথিত হলাম! শান্তনা নিলাম এই ভেবে যে, মানুষ ইদানীং এই ’বিষ’ কে (লাটিন শব্দ ভাইরাস যার অর্থ বিষ) তাদের কল্যাণেও কাজে লাগাচ্ছে।
কয়েকদিন থেকেই টিভির সংবাদগুলো আমাকে ব্যাকুল করে তুলেছে। নিরীহ মানুষগুলোর মধ্যে এমন অনেক বিস্ময়কর প্রজাতির মানুষও যে রয়েছে, তা বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলো না আমার। মুখ আর মুখোশের মিতালীটা এখানেমিলে মিশে যেন একাকার হয়ে আছে। ঠিক যেন সুকুমার রায়ের ’ভাল রে ভাল’ কবিতার মতো। একজন বাবা কিভাবে ঋণের দায়ের অজুহাতে নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যা করতে পারে? কিভাবে একজন মা নিজের অপকর্ম ঢাঁকতে আপন সন্তানকে হত্যা করে? যারা এক সময় ভালোবাসার কথা বলতে বলতে স্বপ্নরাজ বানিয়েছিল যে মানুষটিকে খানিক পরেই মোহ ভেঙ্গে কিভাবে প্রমান দিল সবই অভিনয়।
অবাক হয়েছিলাম, এখন আর হই না। মেনে নিলাম এ অঞ্চলের মানুষের আর সব স্বভাবের মাঝে হিপোক্রেসিও হয়ত একটি। খবরের কাগজে চোখ রাখতেই অভি-কম্পন শুরু হয়ে গেল। প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর প্রায় প্রতিটিতেই নিত্যদিনের সংবাদে পরিণত হেয়েছে নিম্নের খবরগুলো।প্রসঙ্গত দৈনিক পত্রিকার কিছু উদ্ধৃত এখানে প্রাসঙ্গিক মনে করছি : ’দরিদ্রের চাল নিয়ে চালবাজি’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৯ এপ্রিল, ২০২০)।’করোনার মধ্যেও থেমে নেই মাদক ব্যবসা’(দৈনিক ইনকিলাব, ০৩ এপ্রিল,২০২০)। থেমে নেই জুয়া ও ধর্ষণের মতো লোমহর্ষক অপকর্মগুলোও। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে ০৯ বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার (দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১০ এপ্রিল, ২০২০)। খবরগুলো পড়তে পড়তে আবেগপ্রবণহয়ে পড়লাম। এরা কেমন মানুষ? একজন মানুষ কিভাবে এমন দুর্দিনে অসহায় গরিবের খাবার কেড়ে নিতে পারে? কিভাবে ত্রাণের নামে যত্রতত্র চাঁদাবাজির কারখানা খুলে বসতে পারে? সবাই আমাকে প্রানঘাতী বলে অপবাদ দেয়; কিন্তুু এরা তো দেখি আমার চেয়েও ভয়ংকর!
আমার প্রতিও এদের সামান্যতম ভীতি নেই; একবারও ভাবছে না আমি তাদের ঘারের উপরেই বসে আছি। তাদের অনৈতিক সাহসের কাছে আমার সকল অহংকার যেন মিইয়ে গেল নিমিষেই!
সবচেয়ে মমস্পর্শী ওহৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে গেল রাজশাহীর পুঠিয়ায়: বোনের বাড়িতে দুলাভাই কর্তৃক ধর্ষিত স্কুলছাত্রী, লজ্জায় আত্নহত্যা’ (সিল্কসিটি নিউজ, ১০ এপ্রিল ২০২০)। লোকে আমাকে বলে মারণঘাতী, মানুষরূপী এই নরপিশাচগুলো তাহলে কী? করোনাভাইরাসের কালে এমন কলঙ্কগ্রস্ত ঘটনা আমাকে অবাক করে তুলল।এ কেমন কথা-ঘরেও মানুষ নিরাপদে থাকতে পারছে না।
দুর্নীতি আর অনিয়ম আমাকে হিংস্র করে তুলে। নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে দানবের মতো প্রানঘাতী হয়ে উঠি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি নিমিষেই। এক দিকে অসহায় মানুষের আর্তনাদ অন্য দিকে মনুষ্যত্বহীন মানবতা কোন দিকে যাই? ক্ষোভে-অভিমানে নিজের উপর বিরক্তির পাল্লাটা দ্রুত বাড়তে লাগল। মনস্থর করলাম এখানে থাকাটা আর সমীচীন হবে না। অপ্রকৃতিস্থ কালো মেঘ কূন্ডলী পাকিয়ে ঘিরে ফেলল নিজেকে। চরম হতাশা আর অপমানে কিছুই যখন ভালো লাগছে না, ভাবলাম একটা সিনেমা দেখলে মন্দ হয় না। অবশেষে গুণী ও মেধাবী পরিচালক খান আতাউর রহমানের আবার তোরা মানুষ হ’ সিনেমাটি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম। এক অন্যরমক অনিশ্চয়তাবোধ ছেয়ে ফেলল মনকে।
সংশয়টা রয়েই গেল: এরা কি আদৌ মানুষ হবে কখনো! গরমের তীব্রতা অসহনীয়মাত্রায় বাড়ছে;রাতের সিন্ধান্ত মোতাবেক অবশেষে নিজ দেশে রওনা হলাম। একি, লকডাউনের নামে সমস্ত রাস্তাগুলোই যে বাঁশ দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে!
লেখক: মুহাম্মদ আব্দুল মুমীত, গবেষক, রুয়েট, রাজশাহী।