কীভাবে রমযান মাসে অধিক লাভবান হবেন
হোছাইন আহমাদ আযমী : রমযান মাসের সর্বোত্তম আমল যে রোযা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ রোযার ব্যাপারেই আল্লাহ তাআলা বলেছেন স্বয়ং আমি এর প্রতিদান দিব। রোযা ঢাল; এ ঢাল যেন অক্ষুন্ন থাকে।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রোযা ঢাল স্বরূপ। (সহীহ মুসলিম হাদীস : ১১৫১; ইবনে মাজাহ হাদীস : ১৬৩৯)
অন্য হাদীসে আছে, যুদ্ধে ব্যবহৃত ঢালের মতো রোযা জাহান্নাম থেকে ঢাল। রোযা যেহেতু জাহান্নাম থেকে ঢাল সুতরাং তা আমাকে অক্ষুন্ন রাখতে হবে এবং কী করলে তা ভেঙ্গে যায় তাও জানতে হবে। এক হাদীসে এসেছে, রোযা ঢাল যতক্ষণ না তা বিদীর্ণ করে ফেলা হয়।(মুসনাদে আহমদ হাদীস : ১৬৯০)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রোযা হচ্ছে ঢাল। যখন তোমাদের কেউ রোযা থাকে সে যেন অশ্লীল কথাবার্তা না বলে এবং মূর্খের ন্যায় কাজ না করে। কেউ যদি তাকে গালি দেয় বা ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয় তাহলে সে যেন বলে, আমি রোযাদার, আমি রোযাদার। (সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯০৪; সহীহ মুসলিম হাদীস : ১১৫১)
অন্য হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও মন্দ কাজ বর্জন করল না তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯০৩)
নিয়মিত তারাবীহ পড়ুন
এ মাসের বিশেষ আমলের মধ্যে তারাবী নামায অন্যতম। এ নামায সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে সওয়াবের আশায় রমযানের রাতে দণ্ডায়মান হয় তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। (সহীহ বুখারী হাদীস : ২০০৯)
বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করুন
কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, (অর্থ) রমযান মাস, মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে। যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্য পথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ এবং হক বাতিলের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। (সূরা বাকারা : ১৮৫)
হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত জিবরীল আ. রমযানের প্রতি রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আসতেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কুরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন। (সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯০২)
যথাসাধ্য দান করুন
দান করার অর্থ অন্যকে দেওয়া নয়, নিজের জন্য আখেরাতের সঞ্চয় করা। সুতরাং দান করি আর হিসাব করি যে, আখেরাতের জন্য কী পরিমাণ সংরক্ষণ করলাম। আর এর জন্য সর্বোত্তম সময় হল রমযান মাস। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক দাতা ছিলেন। রমযানে তাঁর দানের হাত আরো প্রসারিত হত। (সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯০২)
তাহাজ্জুদের সুযোগকে কাজে লাগান এবং তা অভ্যাসে পরিণত করুন
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘ফরজ নামাযের পরে সর্বোত্তম নামায হল রাতের নামায (অর্থাৎ তাহাজ্জুদ)। (সহীহ মুসলিম হাদীস : ১১৬৩; মুসনাদে আহমদ হাদীস : ৮৫৩৪; জামে তিরমিযী হাদীস : ৪৩৮)
রমযান মাসে যেহেতু সেহরীর জন্য ওঠা হয়। তাই একটু আগে উঠে দুই চার রাকাত তাহাজ্জুদ পড়া খুবই সহজ। এজন্য এই বিষয়ে মনোযোগী হওয়া উচিত। পাশাপাশি ফিকির করা উচিত যে, এটাকে যেন আগামীর জন্য অভ্যাসে পরিণত করতে পারি। পরিবারের লোকদেরকেও উঠিয়ে দিই।
বেশি বেশি দুআ ও ইস্তেগফার করুন
এক হাদীসে এসেছে, ‘রোযাদারের দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।’ অন্য রেওয়ায়েতে আছে, রমযানে রোযাদারকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। বিশেষ করে শেষ রাত দুআ ও ইস্তেগফারের সবচেয়ে উপযোগী সময়।
হযরত আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখন রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকি থাকে তখন আল্লাহ তাআলা নিকটবর্তী আসমানে নেমে আসেন এবং ঘোষণা করতে থাকেন, কে আমাকে ডাকছ আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে প্রার্থনা করছ আমি তাকে দান করব। কে আছ ক্ষমাপ্রার্থী আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। (সহীহ বুখারী হাদীস : ১১৪৫; সহীহ মুসলিম হাদীস : ৭৫৮)
শবে কদরের অন্বেষণে থাকুন
কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, (অর্থ) নিশ্চয়ই আমি তা (কুরআন) নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি কি জানেন লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। (সূরা কদর : ১-৩)
হাদীস শরীফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় কদরের রাতে নামাযে দণ্ডায়মান থাকবে তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (সহীহ মুসলিম হাদীস : ৭৬০; সহীহ বুখারী হাদীস : ২০১৪)
সুতরাং এই ফযীলত লাভে সচেষ্ট হওয়া কর্তব্য। অন্তত ইশা ও ফজর যদি জামাতের সাথে হয় তবুও সারারাত নামায পড়ার সমান ছওয়াব পাওয়া যাবে এবং শবে কদরের ন্যূনতম ফযীলত লাভ করা যাবে। কারণ এক হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি ইশা ও ফজর জামাতের সাথে পড়ল সে যেন সারারাত দাঁড়িয়ে নামায পড়ল। (সহীহ মুসলিম হাদীস : ৬৫৬; মুসনাদে আহমদ হাদীস : ৪০৮)
শেষ দশকে ইতিকাফ করুন
শবে কদর লাভ করার সবচেয়ে উত্তম উপায় হল শেষ দশকে ইতিকাফ করা। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা শেষ দশকে শবে কদর অন্বেষণ কর।’ অন্য রেওয়ায়েতে আছে, ‘তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলোতে শবে কদর তালাশ কর। (সহীহ বুখারী হাদীস : ২০১৭; ২০২০)
নির্দিষ্টভাবে সাতাশের রাতকে শবে কদর বলা ঠিক নয়। কারণ হাদীসে শেষ দশকে শবে কদর অন্বেষণ করতে বলা হয়েছে। তাই শেষ দশকের সব রাতেই যথাসম্ভব বেশি বেশি ইবাদাত করা চাই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের মাঝের দশ দিন ইতিকাফ করতেন। এক বছর এভাবে ইতিকাফ শেষ করার পর যখন রমযানের একুশতম রাত এল তখন তিনি ঘোষণা করলেন, যে ব্যক্তি আমার সাথে ইতিকাফ করেছে সে যেন শেষ দশকে ইতিকাফ করে। কারণ আমাকে শবে কদর সম্পর্কে অবগত করা হয়েছিল (যে তা শেষ দশকের অমুক রাতে)। এরপর তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। … সুতরাং তোমরা শেষ দশকে শবে কদর খোঁজ কর।’(সহীহ বুখারী হাদীস : ২০২৭; সহীহ মুসলিম হাদীস : ১১৬৭)
সুতরাং বুঝা গেল যে, শেষ দশকে যে ইতিকাফ করবে তার শবে কদর নসীব হবে।
মাসনূন ইতিকাফ দশ দিন। যাদের দশ দিন ইতিকাফ করার সুযোগ নেই বা সাহস হয় না তারা দুই তিন দিন নফল ইতিকাফ করতে পারেন। হাদীস শরীফে এসেছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একদিন ইতিকাফ করবে আল্লাহ তায়ালা তার এবং জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। অর্থাৎ আসমান ও যমীনের দূরত্ব থেকে অধিক দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। (শুআবুল ঈমান হাদীস ” ৩৯৬৫)