তারাবিহ : গুরুত্ব ও ফযীলত
হোছাইন আহমাদ আযমী : রমযান মাসের বিশেষ একটি আমল হচ্ছে রাতে ঈশার নামাযের পর বিতরের পূর্বে তারাবির নামায আদায় করা। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য তা সুন্নতে মুআক্কাদাহ।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রমযানের দিবসের রোযাকে ফরয করেছেন। আর তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যবানে নবুওতের মাধ্যমে ‘কিয়ামে রমাযান’-এর ঘোষণার মাধ্যমে তারাবির মতো মূল্যবান এ তোহফা দান করেছেন। বস্তুত তারাবি রমযান মাসের এমন একটি বিশেষ ইবাদত, যা রমযান ছাড়া অন্য কোনো মাসে আদায় করা সম্ভবই না। রমযান মাসের অন্যান্য আমল রমযান ছাড়াও আদায় করা যায়। যেমন রমযান মাস ছাড়াও রোযা রাখা যায়, ইতিকাফ করা যায়। কিন্তু রমযান ছাড়া অন্য সময় তারাবি আদায় করা যায় না। এমনকি চাঁদ ওঠার পর তারাবির নামাযের মাধ্যমেই রমযানের মূল আমল শুরু হয়। অতএব রমযান মাসে তারাবির নামায অত্যন্ত তাৎপর্যমন্ডিত একটি ইবাদত।
তারাবিতে কালামুল্লাহ’র সাথে বান্দার বিশেষ সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং এর মাধ্যমে বান্দার গুনাহ মাফ হয়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাব তথা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সওয়াবের প্রত্যাশা নিয়ে কিয়ামে রমযান আদায় করবে তার বিগত গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ২০০৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৫৯)
অতএব তারাবির ব্যাপারে যত্নবান হওয়া চাই। আর খতম তারাবি পড়তে পারলে তো আরো ভাল। তবে তাড়াহুড়া করে তারবি নয়; তারাবি হতে হবে কুরআনের হকের প্রতি যথাযথ লক্ষ রেখে।
উল্লেখ্য যে, বিশ রাকাত তারাবীহ পড়া সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। আট রাকাত সংক্রান্ত হাদীসগুলো মূলত তাহাজ্জুদ সম্পর্কে। খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত, মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণের ইজমা, মারফ‚ হুকমী, সুন্নতে মুতাওয়ারাসা এবং ফুকাহায়ে কেরামের ইজমা (সমষ্টিগত ঐক্যমত) প্রত্যেকটি দলীল দ্বারাই প্রমাণিত যে, তারাবির নামায আট রাকাতে সীমাবদ্ধ মনে করা এবং বিশ রাকাআত মাসনূন হওয়াকে অস্বীকার করা একটি মারাত্মক ভুল। অতএব এ বিষয়ে অনর্থক বাদানুবাদে লিপ্ত হয়ে রমযানের বরকতময় মুহূর্তগুলো নষ্ট করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
দশটি দৃষ্টান্ত দিয়ে মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন সাহেব বলেন তারাবি ২০ রাকাত।
তারাবির নামাজ কত রাকাত, এনিয়ে বিতর্ক আছে। কিছু মানুষ তারাবি নামাজ ৮ রাকাত আদায় করছেন আবার কেউ ২০ রাকাত পড়ছে।
ইসলামের সূচনা কালেও তারাবিহর নামাজ বিশ রাকাত আদায় পড়া হতো। সাহাবা ও তাবেয়ীনগণের যুগে এবং ইসলামের স্বনামধন্য ইমামগণ যেমন ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমদ (রহ.) সবাই বিশ রাকাত তারাবিহর পক্ষে ছিলেন। (আল মুদাওওয়ানাতুল কুবরা, ইমাম মালেক ১/১৯৩)
এ বিষয়ে ইমাম ইবনে আবী শাইবা রহ. তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ মুসান্নাফে লিখেন- হজরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. রমজান মাসে ২০ রাকাত তারাবিহ ও বিতর পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ২/৩৯৪, ৭৭৭৪)
তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় তারাবিহ ২০ রাকাত পড়তেন তার অনেক প্রমাণ রয়েছে। পরবর্তিতে খলিফা হযরত আবু বকর রা. এর যুগেও সেভাবেই পড়া হতো। তিনি রাসুলুল্লাহ সা. এর অনুসরণ করে এতে কোনো পরিবর্তন বা সবাইকে এক ইমামের পেছনে জামাতবদ্ধ করার প্রয়োজন মনে করেননি।
দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর রা. রাসুলুল্লাহ সা. এর যুগ থেকে চলে আসা ২০ রাকাত তারাবিহকে গুরুত্বের সঙ্গে আদায় করেন এবং সবাইকে জামাতবদ্ধভাবে ইমামের পেছনে আদায় করার সুযোগ করে দেন।
এ ব্যাপারে সাহাবি হযরত সায়েব বিন ইয়াজিদ রা. বর্ণনা করেন, তাঁরা (সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণ) হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রা.-এর যুগে ২০ রাকাত পড়তেন।
হযরত সায়েব বিন ইয়াজিদ রা. বলেন, আমরা উমর ইবনে খাত্তাব রা.-এর যুগে ২০ রাকাত এবং বিতর পড়তাম। (মারিফাতুস সুনান ওয়াল আসার, বাইহাকি ২/৩০৫ সনদ সহিহ)
তাবেয়ী রুফাই বিন মেহরান যিনি ‘আবুল আলীয়া’ নামে প্রসিদ্ধ, রাসুলুল্লাহ সা.-এর ইন্তেকালের মাত্র দুই বছর পর ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হজরত উমর রা. এর পেছনে তিনি নামাজ পড়েন।
তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ উস্তাদ সাহাবি হযরত উবাই বিন কা’ব রা. এর ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, হযরত উমর রা. হজরত উবাই রা. কে রমজানে লোকদের নিয়ে নামাজ পড়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, লোকজন দিনভর রোজা রাখে, কিন্তু তারা সুন্দরভাবে কোরআন পড়তে পারে না, তাই আপনি যদি রাতে তাদের নামাজে কোরআন পড়ে শোনাতেন!
তখন তিনি বললেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! জামাতবদ্ধভাবে কোরআন শোনানোর এ পদ্ধতি তো আগে ছিল না। তিনি বললেন, আমি জানি, তবে তা খুবই উত্তম। এরপর সাহাবি হযরত উবাই রা. লোকদের নিয়ে ২০ রাকাত পড়লেন। (আল মুখতারাহ জিয়াউদ্দীন মাকদিসী ৩/৩৬৭, ১১৬১)
তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা.)-এর যুগেও তারাবির নামাজ ঈশার জামাতের পর ২০ রাকাত জামাতবদ্ধভাবে পড়া হতো।
হযরত সায়েব রা. এর বর্ণনায় হজরত উমর রা.-এর বর্ণনায় হজরত উমর রা. এর খেলাফতকালের অবস্থা বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে উসমান রা. এর যুগের পরিস্থিতিও প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ আছে, যা আমরা আগেই লক্ষ করেছি।
ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী রা. এর যুগেও তারাবির নামাজ ২০ রাকাত আদায় করা হতো। তিনি ইমামদের ২০ রাকাত পড়ার আদেশ দিয়েছিলেন। তাবেয়ী আবু আবদুর রহমান আস-সুলামী আলী রা. এর ব্যাপারে বলেন, হজরত আলী রা. রমজান মাসে কারীগণকে ডাকলেন এবং আদেশ দিলেন তাঁরা যেন লোকদের নিয়ে ২০ রাকাত তারাবিহ পড়ান। আর বিতর পড়াতেন আলী রা. নিজেই। (আস-সুনানুল কুবরা বাইহাকি ২/৪৯৬/৪৬২০ বর্ণনাটি হাসান, গ্রহণযোগ্য)
২০ তারাবির বিষয়ে কোনো খোলাফায়ে রাশেদীন এবং অন্য সাহাবিদের কোনো ধরনের আপত্তি কোনো কিতাবে উল্লেখ নেই।
১. এ ব্যাপারে বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম আতা বিন আবী রবাহ রহ. বলেন, আমি লোকদের (সাহাবি ও তাবেয়ীদের) পেয়েছি, তাঁরা বিতরসহ ২৩ রাকাত পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ২/৩৯৩৯, ৭৬৮৮) বর্ণনাটি সহিহ, এতে একজন বর্ণনাকারীও দুর্বল নেই।
২. প্রখ্যাত ইমাম মোল্লা আলী কারী রহ. লিখেছেন, তারাবির নামাজ ২০ রাকাতের ওপর সাহাবায়ে কেরামের ইজমা (সর্বসম্মত ঐকমত্য) সংঘটিত হয়েছে। (মিরকাত শরহে মিশকাত ৩/৩৪৬)
৩. বুখারি শরিফের ব্যাখ্যাকার ইমাম ক্বাসতালানী রহ. লিখেছেন, হজরত উমর রা. এর যুগের অবস্থা প্রায় ইজমা বা সর্বসম্মত ঐকমত্য পর্যায়ে গণ্য। (ইরশাদুস-সারী শরহে বুখারি ৩/৪২৬)
৪. ইমাম ইবনে কুদামা হাম্বলী রহ. তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আল মুগনীতে লিখেন, হজরত উমর রা. যা করেছেন এবং যে বিষয়ে সাহাবায়ে কেরাম তাঁদের যুগে ইজমা-ঐকমত্যে পৌঁছেছেন, তা অনুসরণের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য ও অনুসরণীয়। (আল মুগনী ১/১৬৭)
৫. ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) লিখেন, অসংখ্য আলেম এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, এটি সুন্নাত। কেননা উবাই ইবনে কা’ব রা. মুহাজির ও আনসার সাহাবিগণের মধ্যে ২০ রাকাত পড়িয়েছেন। আর কোনো একজনও তাতে আপত্তি করেননি। (মাজমু’আতুল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ২৩/১১২-১১৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.), সাহাবা এবং তাবেঈনের যুগ থেকে পবিত্র মক্কা শরিফে ২০ রাকাত তারাবি আজ পর্যন্ত নিয়মিত চলে আসছে। কোনো যুগেই এর কম বা বেশি পড়া হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ ইতিহাসের পাতায় নেই।
এ ক্ষেত্রে ইমাম তিরমিজি রহ. তাঁর নিজস্ব মতামত এবং ইমাম শাফেয়ী রহ. সহ অন্য ইমামদের মতামত উল্লেখ করে লিখেন, অধিকাংশ আলেম, তারাবিহ প্রসঙ্গে ২০ রাকাতের মতই পোষণ করেন, যা হজরত উমর রা., হযরত আলী রা. এবং রাসুলুল্লাহ সা. এর অন্য সাহাবিগণ থেকে বর্ণিত হয়েছে।
আর তা ইমাম সুফিয়ান সাওরী ইবনুল মুবারক ইমাম শাফেয়ী রহ, এর মত। ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেছেন, আমি পবিত্র মক্কাবাসীকে ২০ রাকাত তারাবিহর নামাজ পড়তে পেয়েছি। (তিরমিজি : ৩/১৭০)