রোযা ভঙ্গের কারণসমূহ

প্রকাশিত: মে ৪, ২০২০; সময়: ৮:০৮ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
রোযা ভঙ্গের কারণসমূহ

হোছাইন আহমাদ আযমী : রোযা ভঙ্গের কারণসমূহ : যেসব কারণে শুধু কাযা করতে হয়ঃ অযু বা গোসলের সময় রোযার কথা স্মরণ থাকা অবস্থায় অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতর পানি চলে গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। লাকিত ইবনে সাবিরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ‘তোমরা (অযু-গোসলে) ভালোভাবে নাকে পানি দাও তবে রোযা অবস্থায় নয়।’ (সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ২৩৬৩ সুনানে তিরমিযী হাদীস : ৭৮৫)

সুফিয়ান সাওরী রাহ. এর অভিমত হল, ‘রোযা অবস্থায় কুলি করতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতর পানি চলে গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং তা কাযা করতে হবে। অযু ফরয নামাযের জন্য হোক বা নফল নামাযের জন্য। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস : ৭৩৮০ আরো দেখুন : ইবনে আবী শাইবা ৯৮৪৪-৯৮৪৭)

হস্তমৈথুনে বীর্যপাত হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। আর এটা যে ভয়াবহ গুনাহের কাজ তা বলাই বাহুল্য।

মহিলাদের সমকামিতায় (যা হারাম) শুক্রক্ষরণ ঘটলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। হাদীস শরীফে কামেচ্ছা চরিতার্থ থেকে বিরত থাকাকে রোযার অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ঐ সত্ত্বার কসম, যার হাতে আমার জান। রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ তাআলার নিকট মেশকের চেয়েও বেশি প্রিয় (আল্লাহ তাআলা বলেন) রোযাদার আমার জন্য পানাহার করা থেকে এবং কামোচ্ছা চরিতার্থ করা থেকে বিরত থাকে। (সহীহ বুখারী ১/২৫৪)

রোযা অবস্থায় হায়েয বা নেফাস শুরু হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। পরে তা কাযা করতে হবে।

যে হায়েযা মহিলা সুবহে সাদিকের পর পবিত্র হয়েছে তার সম্পর্কে হাসান বসরী রাহ. বলেন, সে অবশিষ্ট দিন আহার করা থেকে বিরত থাকবে। (অর্থাৎ রোযার মর্যাদা রক্ষার্থে সাদৃশ্য অবলম্বন করবে)। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, হাদীস : ৯৪৩২)

ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.ও বলেছেন, সে আহার করা থেকে বিরত থাকবে যাতে (রমযানের দিবসে পানাহারের কারণে) অমুসলিমদের সাথে সাদৃশ্য সৃষ্টি না হয়। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, হাদীস : ৯৪৩৪)

মাথার এমন যখমে ওষুধ লাগালে রোযা ভেঙ্গে যাবে, যা দিয়ে ওষুধ মস্তিষ্কে চলে যায়। বিশেষ প্রয়োজনে এমন স্থানে ওষুধ লাগাতে হলে পরে সে রোযা কাযা করে নিতে হবে। পেটের এমন ক্ষত যাতে ওষুধ লাগালে রোযা ভেঙ্গে যাবে, যা দিয়ে ওষুধ পেটের ভেতর চলে যায়। বিশেষ প্রয়োজনে এমন ক্ষতে ওষুধ লাগালে পরে সে রোযার কাযা করে নিতে হবে। নাকে ওষুধ বা পানি দিলে তা যদি খাদ্যনালিতে চলে যায় তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা করতে হবে।

গুহ্যদেশের ভেতর ওষুধ বা পানি ইত্যাদি গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, শরীর থেকে (কোনো কিছু) বের হলে অযু করতে হয়, প্রবেশ করলে নয়। পক্ষান্তরে রোযা এর উল্টো। রোযার ক্ষেত্রে (কোনো কিছু শরীরে) প্রবেশ করলে রোযা ভেঙ্গে যায়, বের হলে নয় তবে বীর্যপাতের প্রসঙ্গটি ভিন্ন। (সুনানে কুবরা, বায়হাকী ৪/২৬১)

সুবহে সাদিকের পর সাহরীর সময় আছে ভেবে পানাহার বা স্ত্রীসঙ্গম করলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। তেমনি ইফতারির সময় হয়ে গেছে ভেবে সূর্যাস্তের পূর্বে ইফতার করে নিলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে।

রোযার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার করল অতঃপর রোযা নষ্ট হয়ে গেছে ভেবে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করল তাহলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে এবং কাযা করা জরুরি হবে।

বমি হওয়ার কারণে রোযা নষ্ট হয়ে গেছে মনে করে রোযা ভেঙ্গে ফেললে কাযা করতে হবে। আউন রাহ. থেকে বর্ণিত, মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন রাত্র বাকি আছে ভেবে সাহরী খেলেন। তারপর জানতে পারলেন, তিনি সুবহে সাদিকের পর সাহরী করেছেন তখন তিনি বললেন, ‘আমি আজ রোযাদার নই।’ (অর্থাৎ আমাকে এ রোযার কাযা করতে হবে)।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/১৪৯ আলী ইবনে হানযালা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রোযার মাসে ওমর রা.-এর নিকট ছিলেন। তার নিকট পানীয় পেশ করা হল। উপস্থিতদের কেউ কেউ সূর্য ডুবে গেছে ভেবে তা পান করে ফেলল। এরপর মুয়াযযিন আওয়াজ দিল, হে আমীরুল মুমিনীন! সূর্য এখনো ডুবেনি। তখন ওমর রা. বললেন, ‘যারা ইফতারি করে ফেলেছে তারা একটি রোযা কাযা করবে। আর যারা ইফতারি করেনি তারা সূর্যাস্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/১৫০)

রোযা ভঙ্গের কারণসমূহ : যেসব কারণে কাযা ও কাফফারা উভয়টি জরুরিঃ
রমযানে রোযা রেখে দিনে স্ত্রী সহবাস করলে বীর্যপাত না হলেও স্বামী-স্ত্রী উভয়ের উপর কাযা ও কাফফারা জরুরি হবে। একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বলল, আমি রোযা রেখে স্ত্রী সহবাস করেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উপর কাফফারা আবশ্যক করেছিলেন। (সহীহ বুখারী ৬৭০৯; জামে তিরমিযী ৭২৪; মুসান্নাফ আবদুর রযযাক ৭৪৫৭; মুসনাদে আহমদ ২/২৪১)

মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ ব্যক্তিকে (যে স্ত্রীসহবাসে লিপ্ত হয়েছিল) কাফফারা আদায়ের সাথে কাযা আদায়েরও আদেশ করেছিলেন। (মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৭৪৬১)

বিখ্যাত তাবেয়ী আতা রাহ. বলেন, ‘স্বামী-স্ত্রী যখন মিলিত হয় তখন তাদের রোযা ভেঙ্গে যায়।’ (প্রাগুক্ত ৭৪৬৭)

রোযা রেখে কোনো প্রকার শরীয়তসম্মত ওযর ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করলে কাযা ও কাফফারা উভয়টি জরুরি হবে। এক ব্যক্তি রমযানে রোযা রেখে (ইচ্ছাকৃতভাবে) পানাহার করল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আদেশ করলেন, যেন একটি দাস আযাদ করে বা দুই মাস রোযা রাখে বা ষাট মিসকীনকে খানা খাওয়ায়। (সুনানে দারাকুতনী ২/১৯১)

ইমাম যুহরী রাহ. বলেন, ‘রমযানে রোযা রেখে যে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করবে তার হুকুম ইচ্ছাকৃতভাবে দিনে সহবাসকারীর অনুরূপ।’ অর্থাৎ তাকে কাযা ও কাফফারা উভয়টি আদায় করতে হবে। (মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক, হাদীস : ৭৪৬৮)

বিড়ি-সিগারেট, হুক্কা পান করলেও রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা ও কাফফারা উভয়টি জরুরি হবে। এই মাসআলার দলীল বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনার জন্য (ঝাজরু আরবাবির রায়্যান আন শুরবিদ দুখান; তারবীহুল জানান বিতাশরীহি হুকমি শুরবিদ দুখান আল্লামা আবদুল হাই লাখনোবী রাহ.)

সুবহে সাদিক হয়ে গেছে জানা সত্ত্বেও আযান শোনা যায়নি বা এখনো ভালোভাবে আলো ছড়ায়নি এ ধরনের ভিত্তিহীন অজুহাতে খানাপিনা করা বা স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হওয়া হারাম। এতে রোযা সহীহ হবে না। আর যদি রোযার নিয়ত করার পর কেউ এমনটি করে থাকে তাহলে কাযা-কাফফারা দু’ টোই জরুরি হবে। (সূরা বাকারা : ১৮৭; মাআরিফুল কুরআন ১/৪৫৪-৪৫৫)

কাফফারা আদায়ের নিয়মঃ
একটি রোযার জন্য দুই মাস ধারাবাহিকভাবে রোযা রাখতে হবে। অসুস্থতার কারণে ধারাবাহিকতা ছুটে গেলে পুনরায় নতুন করে রোযা রাখতে হবে। পেছনের রোযাগুলো কাফফারার রোযা হিসাবে ধর্তব্য হবে না। তবে মহিলাদের হায়েযের কারণে ধারাবাহিকতা নষ্ট হলে অসুবিধা নেই। ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন, ‘যার উপর কাফফারা হিসাবে দুই মাস ধারাবাহিকভাবে রোযা রাখা জরুরি সে যদি মাঝে অসুস্থ হওয়ার কারণে রোযা ভেঙ্গে দেয় তাহলে নতুন করে রোযা রাখা শুরু করবে।(আলমুহাল্লা ৪/৩৩১)

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে