যেসব কারণে রোযা ভাঙ্গে না
হোছাইন আহমাদ আযমী : এমন কিছু কাজ আছে, যার দ্বারা রোযার কোনো ক্ষতি হয় না। অথচ অনেকে এগুলোকে রোযা ভঙ্গের কারণ মনে করে। ফলে এমন কোনো কাজ হয়ে গেলে রোযা ভেঙ্গে গেছে মনে করে ইচ্ছাকৃত পানাহার করে। পক্ষান্তরে কেউ কেউ এসব কাজ পরিহার করতে গিয়ে অনাবশ্যক কষ্ট ভোগ করে। সুতরাং এসব বিষয়েও সকল রোযাদার অবগত হওয়া জরুরি।
কোনো রোযাদার রোযার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার করলে তার রোযা নষ্ট হবে না। তবে রোযা স্মরণ হওয়ামাত্রই পানাহার ছেড়ে দিতে হবে। হাদীস শরীফে এসেছে- যে ব্যক্তি ভুলে আহার করল বা পান করল সে যেন তার রোযা পূর্ণ করে। কারণ আল্লাহই তাকে পানাহার করিয়েছেন। (সহীহ মুসলিম ১/২০২)
চোখে ঔষধ-সুরমা ইত্যাদি লাগালে রোযার কোনো ক্ষতি হয় না। হযরত আনাস রা. রোযা অবস্থায় সুরমা ব্যবহার করতেন। (সুনানে আবু দাউদ ১/৩২৩)
রাত্রে স্ত্রী সহবাস করলে বা স্বপ্নদোষ হলে সুবহে সাদিকের আগে গোসল করতে না পারলেও রোযার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে কোনো ওযর ছাড়া, বিশেষত রোযা অবস্থায় দীর্ঘ সময় অপবিত্র থাকা অনুচিত। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, কখনো কখনো গোসল ফরয অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সকাল হত। অতঃপর তিনি গোসল করে রোযা পূর্ণ করতেন।
বীর্যপাত ঘটা বা সহবাসে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে স্ত্রীকে চুমু খাওয়া জায়েয। এতে রোযার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে তরুণদের যেহেতু এ আশঙ্কা থাকে তাই তাদের বেঁচে থাকা উচিত। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটে ছিলাম। ইতিমধ্যে একজন যুবক এল এবং প্রশ্ন করল, আল্লাহর রাসূল! আমি কি রোযা অবস্থায় চুম্বন করতে পারি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না। এরপর এক বৃদ্ধ এল এবং একই প্রশ্ন করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হাঁ। আমরা তখন অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি জানি, তোমরা কেন একে অপরের দিকে তাকাচ্ছ। শোন, বৃদ্ধ ব্যক্তি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। (মুসনাদে আহমদ ২/১৮০, ২৫০)
হযরত আবু মিজলায রাহ. বলেন, ইবনে আব্বাস রা.-এর নিকট এক বৃদ্ধ রোযা অবস্থায় চুমু খাওয়ার মাসআলা জিজ্ঞাসা করল। তিনি তাকে অনুমতি দিলেন। অতঃপর এক যুবক এসে একই মাসআলা জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাকে নিষেধ করলেন। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/১৮৫)
অনিচ্ছাকৃত বমি হলে (এমনকি মুখ ভরে হলেও) রোযা ভাঙ্গবে না। তেমনি বমি মুখে এসে নিজে নিজেই ভেতরে চলে গেলেও রোযা ভাঙ্গবে না। হাদীসে এসেছে- অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো ব্যক্তির বমি হলে তার রোযা কাযা করতে হবে না। (জামে তিরমিযী ১/১৫৩, হাদীস : ৭২০)
শরীর বা মাথায় তেল ব্যবহার করলে রোযা ভাঙ্গবে না। হযরত কাতাদাহ রা. বলেন, ‘রোযাদারের তেল ব্যবহার করা উচিত, যাতে রোযার কারণে সৃষ্ট ফ্যাকাশে বর্ণ দূর হয়ে যায়। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/৩১৩)
শুধু যৌন চিন্তার কারণে বীর্যপাত হলে রোযা ভাঙ্গবে না। তবে এ কথা বলাই বাহুল্য যে, সব ধরনের কুচিন্তা তো এমনিতেই গুনাহ আর রোযার হালতে তো তা আরো বড় অপরাধ।
* কামভাবের সাথে কোনো মহিলার দিকে তাকানোর ফলে কোনো ক্রিয়া-কর্ম ছাড়াই বীর্যপাত হলে রোযা ভাঙ্গবে না। তবে রোযা অবস্থায় স্ত্রীর দিকেও এমন দৃষ্টি দেওয়া অনুচিত। আর অপাত্রে কু-দৃষ্টি তো কবীরা গুনাহ। যা রোযা অবস্থায় আরো ভয়াবহ। এতে রোযাদার রোযার ফযীলত ও বরকত থেকে মাহরূম হয়ে যায়। হযরত জাবির ইবনে যায়েদকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীর দিকে কামভাবের সাথে তাকিয়েছে। ফলে তার বীর্যপাত ঘটেছে তার রোযা কি ভেঙ্গে গেছে? তিনি বললেন, ‘না। সে রোযা পূর্ণ করবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬-২৫৯ আরো দেখুন : সহীহ বুখারী ১/২৫৮)
মশা-মাছি, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি অনিচ্ছাকৃত পেটের ভেতর ঢুকে গেলেও রোযা ভাঙ্গবে না।
* ধোঁয়া বা ধুলোবালি অনিচ্ছাকৃতভাবে গলা বা পেটের ভেতর ঢুকে গেলে রোযা ভাঙ্গবে না। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘কারো গলায় মাছি ঢুকে গেলে রোযা ভাঙ্গবে না। (মুাসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/৩৪৯)
স্বপ্নদোষ হলে রোযা ভাঙ্গে না। হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ ভরে বমি হল। তিনি তখন বললেন- তিনটি বস্তু রোযাভঙ্গের কারণ নয় : বমি, শিঙ্গা লাগানো ও স্বপ্নদোষ। (সুনানে কুবরা বাইহাকী ৪/২৬৪)
চোখের দু’ এক ফোটা পানি মুখে চলে গেলে রোযার ক্ষতি হয় না। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘রোযা অবস্থায় সিরকা অথবা অন্য কোনো বস্তুর স্বাদ গ্রহণ করলে যদি তা গলার ভেতর না যায় তাহলে রোযা ভাঙ্গে না। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/২০২)
সুস্থ অবস্থায় রোযার নিয়ত করার পর যদি অজ্ঞান, অচেতন বা পাগল হয়ে যায় তাহলে রোযা নষ্ট হবে না। হযরত নাফে রাহ. বলেন, হযরত ইবনে ওমর রা. নফল রোযা অবস্থায় বেহুশ হয়ে যেতেন কিন্তু এ কারণে রোযা ভেঙ্গে ফেলতেন না।(সুনানে কুবরা বাইহাকী ৪/২৩৫)
যাদের জন্য রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রতি ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমাদের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি হয়। গণা-গুনতি কয়েক দিন রোযা রাখতে হবে। তারপরও যদি তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে, তবে অন্য সময়ে সে সমান সংখ্যা পূরণ করবে। যারা এর শক্তি রাখে তারা একজন মিসকীনকে খাবার খাইয়ে (রোযার) ফিদয়া আদায় করতে পারবে। এছাড়া কেউ যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো পুণ্যের কাজ করে, তবে তার পক্ষে তা শ্রেয়। আর তোমাদের যদি সমঝ থাকে, তবে রোযা রাখাই তোমাদের জন্য বেশি ভালো। রমযান মাস-যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা আদ্যোপান্ত হিদায়াত এবং এমন সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি সম্বলিত, যা সঠিক পথ দেখায় এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেয়। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ মাস পাবে সে যেন এ সময় অবশ্যই রোযা রাখে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে, তবে অন্য সময় সে সমান সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ সেটাই করতে চান।
তোমাদের জন্য জটিলতা সৃষ্টি করতে চান না, যাতে তোমরা রোযার সংখ্যা পূরণ করে নাও এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যে পথ দেখিয়েছেন, সেজন্য আল্লাহর তাকবীর পাঠ কর এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (সূরা বাকারা :১৮৩-১৮৫১)