পেরিয়ে যাচ্ছে ক্ষমার দিন
হোছাইন আহমাদ আযমী : আল্লাহ তাআলা গাফফার-মহা ক্ষমাশীল; তিনি ক্ষমা করতেই ভালোবাসেন। তাই তো ক্ষমার জন্য তিনি রেখেছেন- বিভিন্ন উপলক্ষ; এই উপলক্ষে সেই উপলক্ষে তিনি বান্দাকে ক্ষমা করেন। পৃথিবী-ভর্তি গোনাহও তিনি ক্ষমা করে দেন। প্রয়োজন শুধু ফিরে আসা। তওবার মাধ্যমে তাঁর ক্ষমার দুয়ারে ধরনা দেওয়া। ব্যস, বান্দার ক্ষমা চাইতে দেরি, ক্ষমা করতে দেরি নেই। আর শুধু ক্ষমা নয়, ক্ষমা করে তিনি টেনে নেন রহমতের ছায়ায়; এমনকি কখনো পাপের সংখ্যা পরিবর্তন করে দেন পুণ্য দিয়ে।
বান্দাকে হতে হবে ‘তাওয়াব’-গোনাহ হয়ে গেলেই সাথে সাথে তওবা করতে হবে। তওবা করতে হবে দিল থেকে, অনুশোচনার সাথে। তাহলেই লাভ করা যাবে ‘গাফফার’-এর ক্ষমা। হাদীস শরীফে ইরশাদ-
প্রতিটি বনী আদম ‘খাত্তা’-বারংবার পাপকারী। তবে ‘খাইরুল খাত্তাঈন’ অর্থাৎ পাপকারীদের মধ্যে উত্তম হল তারা, যারা ‘তাওয়াবূন’ অর্থাৎ যারা বেশি বেশি তওবা করে; গোনাহ হলেই তওবা করে নেয়। (জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৯৯)
হাঁ, গোনাহ হলে তওবা করে নেওয়াই তো মুমিনের গুণ। মুমিনের এ গুণের বর্ণনা এসেছে কুরআনে, এভাবে- “এবং তারা সেই সকল লোক, যারা কখনো কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা (অন্য কোনোভাবে) নিজেদের প্রতি যুলুম করলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার ফলশ্রুতিতে নিজেদের গোনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া কেই বা আছে, যে গোনাহ ক্ষমা করতে পারে? আর তারা জেনেশুনে তাদের কৃতকর্মে অবিচল থাকে না।” (সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৩৫)
এই আয়াতের এক আয়াত আগে আল্লাহ বান্দাকে মাগফিরাত ও জান্নাতের দিকে প্রতিযোগিতামূলক ধাবিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এরপর (উপরের আয়াতে) বর্ণনা করেছেন- যারা তাঁর মাগফিরাত ও জান্নাত পাবে, তাদের গুণ ও বৈশিষ্ট্য।
এর পরও কি গোনাহের পাল্লা ভারি হবে?
বান্দার নেকী-বদী লিপিবদ্ধ করা হয়; কিয়ামতের দিন বান্দার সামনে তা মেলে ধরা হবে। ছোট বড় সবকিছু লেখা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার দয়া দেখুন- নেক কাজের ইচ্ছা করলেই একটি নেকী লেখা হয় আর সে নেক কাজটি করলে দশ থেকে সাতশটি পর্যন্ত নেকী লেখা হয়; কখনো আল্লাহ আরো বাড়িয়ে দেন। পক্ষান্তরে কেউ যদি কোনো গোনাহের ইচ্ছা করে, তো যতক্ষণ গোনাহটি না করে ততক্ষণ কোনো গোনাহ লেখা হয় না। তারপর যদি গোনাহটি করে ফেলে তখন মাত্র একটি পাপ লেখা হয়।
“কেউ কোনো সৎ কাজ করলে সে তার দশ গুণ পাবে আর কেউ কোনো অসৎ কাজ করলে তাকে শুধু একটি পাপের শাস্তি দেওয়া হবে। আর তাদের প্রতি কোনো যুলুম করা হবে না।” (সূরা আনআম (৬) : ১৬০)
হাদীসে কুদসীতে হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন- “বান্দা যখন কোনো নেক কাজের ইচ্ছা করে, উক্ত নেক কাজ না করলেও (এ ইচ্ছার কারণে) একটি নেকী লেখা হয়। যদি সে নেক কাজটি করে তাহলে দশ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত নেকী লেখা হয়। আর যখন কোনো গোনাহের ইচ্ছা করে, কিন্তু ওই পাপ কাজটি করে না; তখন (এ ইচ্ছার কারণে) কোনো গোনাহ লেখা হয় না। হাঁ, যদি ওই পাপ কাজটি করে বসে তখন মাত্র একটি পাপ লেখা হয়।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১২৮)
কোথায় এক আর কোথায় দশ থেকে সাতশ! এছাড়া গোনাহ মাফ হওয়ার বিভিন্ন প্রসঙ্গ তো রয়েছেই। এই আমল করলে পিছনের এক বছরের গোনাহ মাফ হয়। ওই আমল করলে গোনাহ মাফ। এর পরও কি নেকির পাল্লা ভারি হবে না!
পৃথিবী-ভর্তি পাপও তিনি ক্ষমা করেনঃ
বান্দা নিজের পাপ দেখে নিজেই নিরাশ হয়ে যায়- আমি যত পাপ করেছি, আমার ক্ষমা নেই। বান্দার পাপের সীমা আছে, কিন্তু রহমানুর রাহীমের ক্ষমার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। একটি হাদীসে কুদসীতে এরই একটা উদাহরণ টেনেছেন আল্লাহ তাআলা। বান্দা! কত গোনাহ করেছ? তোমার গোনাহ দ্বারা পৃথিবী পূর্ণ হয়ে গেছে, আসমান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে তোমার পাপরাশি! শিরক থেকে মুক্ত হয়ে, তওবা করে ফিরে আস আমার কাছে, সকল পাপ ক্ষমা করে দিব; কোনো পরোয়া করব না!
(হাদীসে কুদসী) আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা বলেছেন- বনী আদম! তুমি যতক্ষণ আমাকে ডাকতে থাকবে, আমার কাছে (ক্ষমার) আশা করতে থাকবে, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিব; কোনো পরোয়া করব না।
বনী আদম! তোমার পাপরাশি যদি মেঘমালা পর্যন্ত পৌঁছে যায়, অতপর তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাও আমি ক্ষমা করে দিব; কোনো পরোয়া করব না।
বনী আদম! তুমি যদি পৃথিবী-ভর্তি পাপ নিয়ে আমার কাছে আস এবং শিরক থেকে মুক্ত হয়ে আমার সাথে সাক্ষাৎ কর আমি পৃথিবী-ভর্তি ক্ষমা নিয়ে তোমার সাথে সাক্ষাৎ করব। (জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৪০)
নিরাশ হয়ো না, তিনি সব গোনাহ মাফ করে দেনঃ
পাপের বোঝায় ন্যুব্জ কোনো বান্দা মনে করতে পারে- আমার গোনাহ তো অনেক বেশি; কয়েক পৃথিবী পূর্ণ হয়ে যাবে আমার পাপ দ্বারা। মদ, যিনা, হত্যা, লুণ্ঠন কোন পাপ নেই যা আমি করিনি; জীবনটাই কেটেছে পাপের মাঝে। এখন আর তওবা করে কী হবে? তাছাড়া আমার মত পাপীকে কি আল্লাহ ক্ষমা করবেন!
তো এমন পাপীর জন্যও আল্লাহ ক্ষমার ঘোষণা দিলেন- তুমিও নিরাশ হয়ো না আল্লাহর রহমত থেকে; তোমারও সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত- কিছু মুশরিক নবীজীর কাছে এল, যারা মানুষ হত্যা করেছে; অগণিত মানুষকে হত্যা করেছে। যারা যিনা করেছে; প্রচুর পরিমাণে যিনা করেছে। তারা বলল, আপনি যা বলেন এবং যেদিকে আহ্বান করেন তা তো খুব সুন্দর ও উত্তম। যদি আপনি আমাদের বলতেন যে, আমাদের অতীত পাপের কাফফারা আছে! তখন নাযিল হল- এবং যারা আল্লাহর সাথে অন্য কোনো মাবুদের ইবাদত করে না। এবং আল্লাহ যে প্রাণকে মর্যাদা দান করেছেন তাকে অন্যায়ভাবে বধ করে না এবং ব্যভিচার করে না। (যে ব্যক্তিই এরূপ করবে তাকে তার গোনাহের শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। কিয়ামতের দিন তার শাস্তি বৃদ্ধি করে দ্বিগুণ করা হবে। এবং সে লাঞ্ছিত অবস্থায় তাতে সর্বদা থাকবে। তবে কেউ তওবা করলে, ঈমান আনলে এবং সৎকর্ম করলে, আল্লাহ এরূপ লোকদের পাপরাশিকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তিত করে দেবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।) [সূরা ফুরকান (২৫) : ৬৮-৭০]
এবং নাযিল হল- বলে দাও, হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের উপর অবিচার করেছ- আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। (আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।) [সূরা যুমার (৩৯) : ৫৩; সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮১০]
সূরা যুমারের ৫৩ নং আয়াতের তাফসীরে ইবনে কাসীর রাহ. কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করেন। এরপর বলেন- এসকল হাদীস থেকে বুঝা যায়, এ আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য, আল্লাহ সকল গোনাহ ক্ষমা করেন- তওবার শর্তে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা যুমার, ৫৩ নং আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য)
আল্লাহ ক্ষমা করার জন্য বাহানা তৈরি করেনঃ
দেখুন, বান্দা যখন তওবা করে ফিরে অসে তখন আল্লাহ শুধু ক্ষমাই করেন না, বরং ক্ষমার জন্য বাহানা তৈরি করেন। বনী ইসরাঈলের নিরানব্বই হত্যাকারীর ঘটনা অনেকেরই জানা। সে তওবা করে ফিরে এল এবং নেককারদের এলাকার দিকে রওয়ানা হল। পথিমধ্যে যখন তার মৃত্যুক্ষণ ঘনিয়ে এল তখন রহমত ও আযাবের ফিরিশতা এল এবং প্রত্যেকে তার জান কবয করতে চাইল। এক পর্যায়ে ফয়সালা হল, সে যদি নেককারদের এলাকার কাছাকাছি হয় রহমতের ফিরিশতারা তাকে নিয়ে যাবে, অন্যথায়…।
উক্ত ঘটনার যে দিকটি আমাদের আলোচ্য বিষয় তা হল- আল্লাহ নেককার লোকদের ভূমিকে বললেন, তুমি নিকটবর্তী হও। আর অপর ভূমিকে বললেন, তুমি দূরবর্তী হও। তারপর যখন ভূমির দূরত্ব মাপা হল, দেখা গেল সে নেককারদের এলাকার দিকে এক বিঘত এগিয়ে রয়েছে। তখন তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হল (এবং রহমতের ফিরিশতা তার জান কবয করল)। (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৪৭০)
একটু লক্ষ্য করুন, ঘটনার বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, সে নেককারদের ভূমির দিকে এগিয়ে ছিল না। আল্লাহর আদেশে তা নিকটবর্তী হয়েছে। অর্থাৎ, সে যখন তওবা করে ফিরে এসেছে তো আল্লাহ তার ক্ষমার জন্য নিজ রহমতে বাহানা তৈরি করে দিয়েছেন! হাঁ, আল্লাহ এমনই গাফূরুর রাহীম। প্রয়োজন শুধু বান্দার একটু এগিয়ে আসা।
এ যেন ঐ হাদীসেরই একটি বাস্তব উদাহরণ, যে হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেছেন- বান্দা যদি আমার দিকে এক বিঘত এগিয়ে আসে আমি বান্দার দিকে এক হাত এগিয়ে আসি…। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৪০৫)
আল্লাহ ক্ষমা করে খুশি হনঃ
তওবা অর্থ- ফিরে আসা। পাপের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ থেকে অনেক দূরে সরে যায় আর তওবার মাধ্যমে ফিরে আসে। পাপী বান্দা যখন তওবার মাধ্যমে ফিরে আসে তখন আল্লাহ কত খুশি হন- একটি হাদীসে তার উদাহরণ টানা হয়েছে এভাবে- এক ব্যক্তি বিরান মরুভূমিতে চলছিল। তার খাদ্য-পানীয় সব ছিল তার বাহন জন্তুটির পিঠে। (সে এক স্থানে বিশ্রামের জন্য নামল এবং ঘুমিয়ে গেল। উঠে দেখল,) খাদ্য-পানীয়সহ বাহন জন্তুটি পালিয়ে গেছে। সে নিরাশ হয়ে একটি গাছের ছায়ায় শুয়ে গেল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখল, বাহন জন্তুটি (খাদ্য-পানীয়সহ) উপস্থিত! সাথে সাথে বাহনের লাগাম ধরে ফেলল এবং আনন্দের আতিশয্যে বলে উঠল- আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা আমি তোমার রব! আনন্দের আতিশয্যে সে উল্টো বলল (সে বলতে চেয়েছিল, আল্লাহ! তুমি আমার রব আর আমি তোমার বান্দা!)। বান্দার তওবায় আল্লাহ ঐ ব্যক্তির চেয়েও বেশি খুশি হন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭৪৭)
তো যে রব আকাশসম গোনাহ ক্ষমা করে দেন, ক্ষমা করার জন্য বাহানা তৈরি করেন এবং বান্দার তওবায় এত খুশি হন তাঁর বান্দার কি গোনাহ রয়ে যাবে?
লেখক, শিক্ষক জামিয়া উসমানিয়া হোছাইনাবাদ কাটাখালী রাজশাহী।