অতিরিক্ত ব্যাংক ঋণ প্রভাব ফেলবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে

প্রকাশিত: জুন ১৪, ২০২০; সময়: ৬:০৮ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
অতিরিক্ত ব্যাংক ঋণ প্রভাব ফেলবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে

সাইফুল ইসলাম : আমাদের মতো দ্রুত-বর্ধনশীল ও উন্নয়নশীল দেশের বাজেট ঘাটতি একটা প্রচলিত ও অতি পরিচিত বিষয়। যতটুকু ঘাটতি থাকে তার কিছু অংশ বৈদেশিক ঋণ দিয়ে আর বাকি অংশ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিয়ে মেটানো হয়। এভাবেই চলে আসছে আমাদের বিগত বাজেটের প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কাজ। বাজেটের আকার যত বড় হবে, আয় যদি সেই অনুপাতে না বাড়ে তাহলে ঋণ—তাই সে বিদেশি হোক বা দেশি হোক বাড়বে। সরকার যেভাবে হোক তার বাজেটের খরচ মেটানোর চেষ্টা করবে।
বলে রাখা ভালো যে সরকার বাজেটে প্রথমে খরচের খাত ও পরিমাণ ঠিক করে নেয়, পরে সেই খরচ কীভাবে মেটানো যাবে তার জন্য আয়ের খাত ঠিক করে আয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করে। এখানে ব্যক্তিগত বাজেট আর সরকারি বাজেটের পার্থক্য কারণ ব্যক্তি তার আয়ের ওপর নির্ভর করে ব্যয়ের বাজেট তৈরি করে।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিভিন্ন কারণে এই বাজেট গুরুত্বপূর্ণ। করোনা ভয়াবহ স্বাস্থ্য বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা যেমন জরুরি, তেমনি দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষকে, কর্মহীন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা এবং বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করাও জরুরি। এই সার্বিক বিচারে এই বাজেট প্রণয়ন খুব কঠিন ছিল।

অনেকে বাজেটকে ভালোভাবে দেখছেন, অনেকে মনে করছেন গতানুগতিক, আবার অনেকে বলছেন এটা দুর্নীতি উস্কে দেওয়া ও লুণ্ঠন করার বাজেট। অনেকে অনেক কথা বলবেন এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু দেশের এই চরম দুঃসময়ে একটা আপাত কল্যাণচিন্তামুখী বাজেট পেশ করা এবং পরবর্তীতে তার সফল বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন। আমাদের দেশে বোধ করি সবচেয়ে বড় সংকট বাস্তবায়নে, প্রণয়নে নয়। তাই যে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে সেটা কতটুকু সফল হবে, ৮.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে কিনা সেটা মূল্যায়ন করতে হলে অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

বাজেটের বেশকিছু দিক ভালো হয়েছে বিশেষ করে সাধারণ মানুষের জন্য। প্রস্তাবিত এই বাজেটে যে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা হলো কোভিড-১৯ মহামারির বিবেচনায় জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা, খাদ্য নিরাপত্তাসহ সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা বিস্তৃত ও জোরদার করা এবং কৃষি ও কৃষিবহির্ভূত বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য নানা ধরনের ভর্তুকি ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। গরিব ও অসহায় মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা জাল বিস্তৃত হয়েছে কিন্তু সেটা মনে হয় যথেষ্ট নয়। যদি মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা হয়তো ২২-২৩ শতাংশে গিয়ে ঠেকবে তখন সাহায্যের পরিমাণ হয়তো বাড়ানো লাগবে।
উল্লেখ্য, এবারের বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৩.২ শতাংশ বেশি। প্রস্তাবিত বাজেটে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৮২ হাজার ১৩ কোটি টাকা। ঘাটতি ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা, বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ ৭৬ হাজার ৪ কোটি টাকা, বৈদেশিক সহায়তা ৪ হাজার ১৩ কোটি টাকা ও অন্যান্য খাতের সহায়তা ধরা হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি কিন্তু বছরের প্রথম অর্ধ-বছরেই সরকারের এই ঋণ ৪৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অর্থবছর শেষে সেই ঋণ হয়তো এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এবার যে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হবে তার প্রভাব অর্থনীতিতে কি বা কেমন পড়বে সেটা বিচার্য।

আমরা সবাই জানি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের চিত্র। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণ ও সুশাসনের অভাব। খেলাপি ঋণের ভারে ব্যাংকিং খাত ক্ষতবিক্ষত। আইএমএফের হিসাবে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর মোট প্রদত্ত ঋণের প্রায় ২৫-২৬ শতাংশ খেলাপি যদিও সরকারি হিসেবে সেটা ১১-১২ শতাংশ হবে। অন্যদিকে কিছু কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫০ শতাংশের বেশি যেমন বেসিক ব্যাংক, আইসিবি ইসলামি ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ইত্যাদি। ৫ শতাংশের নিচে কোনও ব্যাংকের খেলাপি আছে কিনা সন্দেহ। ২০১৯ সালে ব্যাংকগুলোর ক্রেডিট প্রবৃদ্ধি খুব কম হয়েছে বলা যায়। তারল্য সংকট এখনও কাটেনি সব ব্যাংকে। তাছাড়া সরকারের প্রণোদনা বাস্তবায়নের প্রচণ্ড চাপ আছে ব্যাংকিং খাতের ওপর। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর সুদের হার ৯ শতাংশে নির্ধারণ করে দেওয়ার কারণে সুদ আয় কমে গেছে অনেক পরিমাণে যা চলতি বছরের আয়ে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। আবার করোনার কারণে দুই মাসের সুদ আয় ব্যাংকের আয়ে না নিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, ফলে সার্বিক বিচারে বেশ কিছু ব্যাংকের অবস্থা করোনা সংকট দীর্ঘ হলে এমন হতে পারে যে তারা অস্তিত্বের সংকটে পড়তে পারে, মার্জার অথবা আকুইজিশানে যেতে বাধ্য হবে কেউ কেউ। কোভিডের কারণে সারা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যে অচলাবস্থা শুরু হয়েছে তাতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আরও ৫ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

অন্যদিকে মানুষের আয় কমে যাওয়াতে মানুষ ব্যাংক থেকে জমা টাকা উঠিয়ে খরচ সামলাচ্ছে, টাকা জমা দিতে ব্যাংকে যাচ্ছেন খুব কম লোকজন। জমার ওপর সুদের হার কমে যাওয়াতে অনেকে ব্যাংকে টাকা রাখা লাভজনক মনে করছেন না। তারা বেশি লাভের আশায় শেয়ারবাজার, জমি, ফ্ল্যাট, কো-অপারেটিভ, এনজিও ইত্যাদিতে টাকা রাখছেন ফলে ব্যাংকে জমার পরিমাণ দিনে দিনে কমছে এবং ক্ষুদ্র আমানতকারীরা ঝুঁকিতে পড়ছেন। বছর শেষে ব্যাংকের তারল্য কোথায় গিয়ে ঠেকে সেটা বলা মুশকিল, সরকার যদিও ইতোমধ্যে তারল্য বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে মনিটরি পলিসি কাটছাঁট করে, তারপরও।
এই বাস্তবতায় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিলে তার একটা প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। ব্যাংক অবশ্য একটা দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। সুবিধাটা হচ্ছে ব্যাংকের এই ঋণটির আদায় হবে নিশ্চিত, কারণ সরকার ঋণ নিলে ফেরতের নিশ্চয়তা থাকে। সেই দিক থেকে ব্যাংকের সুদ ও কমশন আয় প্রাপ্তি এবং খেলাপি না হওয়ার নিশ্চয়তা থাকছে। কোনও কারণে ফেরত পেতে দেরি হতে পারে কিন্তু সেটা সাময়িক। এজন্য ব্যাংকে যারা টাকা জমা রেখেছেন তারা নিরাপদে থাকবেন।

তাহলে সমস্যা কী? এখানে প্রভাবটা অর্থনৈতিক। সরকার ঋণ নিয়ে হয়তো তার উন্নয়নমূলক কাজ করবে, কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন দেবে, বিদেশি ঋণ পরিশোধ করবে বা অন্য যা কিছুই করুক না কেন সেটা ব্যক্তিগত খাতে বিনিয়োগে ঋণাত্মক প্রভাব ফেলবে। ব্যাংক যে টাকা ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ করতো, কলকারখানা স্থাপনে বিনিয়োগ করতো সেই টাকা চলে যাবে সরকারের অনুৎপাদনশীল খাতে। ফলে ঋণ প্রবাহ ও প্রবৃদ্ধি কমে যাবে, কমে যাবে বিনিয়োগ, প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত আয়, ব্যয় এবং ব্যাংকের আয় এবং অবশেষে সরকারের রাজস্ব আয়।

অন্যদিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি বিঘ্নিত হবে নতুন নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ার কারণে। সরকারি খাতে যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না তা নয় তবে সেটা ব্যক্তি খাতের চেয়ে নিঃসন্দেহে কম। আবার ব্যাংকেও কর্মসংস্থান সৃষ্টি বিঘ্নিত হবে ঋণের প্রবৃদ্ধি না হওয়ার কারণে। আর সার্বিক প্রভাব জাতীয় আয়েও গিয়ে পড়বে। তবে ব্যাংকের এই ঋণ ব্যক্তি খাতে দিলে খেলাপি হওয়ার ভয় থাকছে। যদি খারাপ গ্রাহক বা খেলাপি মানসিকতার কোনও গ্রাহক প্রেসার খাটিয়ে ঋণটি বের করে ফেরত না দেন তাহলে খেলাপি ঋণ বাড়ার সম্ভাবনা আছে।

সরকারেরও হয়তো ব্যাংক ঋণ নেওয়ার এই পথে হাঁটা ছাড়া বিকল্প নেই। কোভিডের এই প্রলয়ের সময়ে যে প্রকল্পগুলো পিছিয়ে দেওয়া যেতো সেগুলো সরকার পিছিয়ে দিতে পারতো কিন্তু দিচ্ছে না হয়তো অর্থনীতিতে সামগ্রিক ব্যয় প্রবাহ ঠিক রাখার জন্য। প্রকল্প পিছিয়ে দিলে কিছু খরচ বাঁচতো, ফলে ব্যাংক থেকে কম ঋণ নিলে অসুবিধা হতো না। তাছাড়া সরকার যদি এখন অপচয় রোধ, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি রোধ, কালো টাকা আদায়ে বিশেষ ব্যবস্থা, পাচারকৃত টাকা ফেরত আনার ঐকান্তিক চেষ্টা ইত্যাদি করে তাহলেও অনেক টাকা আদায় হবে এবং বাঁচবে। মোটকথা সরকার অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে এবং বাজেটে অ্যাডজাস্টমেন্ট করেও ব্যাংক ঋণের নির্ভরতা কমাতে পারলে সার্বিকভাবে দেশের মঙ্গলই বেশি হবে।

 

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
সূত্র : বাংলাট্রিবিউন

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে