বরাদ্দ নয়, বাড়াতে হবে সক্ষমতা; কমাতে হবে দুর্নীতি

প্রকাশিত: জুন ১৫, ২০২০; সময়: ২:০২ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
বরাদ্দ নয়, বাড়াতে হবে সক্ষমতা; কমাতে হবে দুর্নীতি

প্রভাষ আমিন : আ হ ম মুস্তফা কামালের জন্য আমার একটু খারাপই লাগছে। ছাত্রজীবনে মেধার কারণে লোটাস উপাধি পেয়ে তিনি মূল নামের চেয়ে ‘লোটাস কামাল’ নামেই বেশি পরিচিত হন। পরে ব্যবসায় সাফল্য পাওয়া লোটাস কামালের মূল পরিচয় ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে। একটু দেরিতে রাজনীতিতে আসলেও তার আগমনটা একদম ‘ভিনি, ভিডি, ভিসি’র গল্প। এলেন, দেখলেন আর জয় করলেন। এমপি হলেন, বিসিবির প্রেসিডেন্ট হলেন, আইসিসির প্রেসিডেন্ট হলেন এবং মন্ত্রী হলেন। আবুল মাল আবদুল মুহিত যতদিন কেবিনেটে ছিলেন, তততিন লোটাস কামাল পরিকল্পনামন্ত্রী। মুহিত অবসরে যাওয়ার পর পূরণ হলো লোটাস কামালের স্বপ্ন। তার স্বপ্ন ছিল অর্থমন্ত্রী হওয়ার, সংসদে বাজেট পেশ করার।

লোটাস কামাল অর্থমন্ত্রী হওয়ায় দেশবাসী অনেক অনেক দিন পর একজন অসিলেটীয়কে এই মন্ত্রণালয়ে দেখলো। আঞ্চলিকতায় আমার তেমন আগ্রহ নেই। তবু অর্থ মন্ত্রণালয়কে সিলেটের দখল থেকে বের করে প্রথম সুযোগেই কুমিল্লায় নিয়ে যাওয়ায় আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রতি একটা গোপন পক্ষপাত আছে। সেই কারণেই তার জন্য মনটা খারাপ। গতবছর দায়িত্ব নেয়ার ছয় মাসের মধ্যেই তাকে জাতীয় সংসদে তার জীবনের প্রথম বাজেট পেশ করতে যেতে হয়। প্রথম বাজেট, স্বপ্নপূরণ। কিন্তু স্বপ্নকে দুঃস্বপ্ন বানিয়ে দেয় ডেঙ্গু। বাজেট পেশ শুরু করলেও শেষ করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পক্ষে বাজেট উপস্থাপন করেন।

এবার অর্থমন্ত্রী সুস্থ, তবে করোনায় আক্রান্ত গোটা বিশ্ব। বিশ্বজুড়েই শোনা যাচ্ছে মহামন্দার পদধ্বনি। এমন সময়ে বাজেট উপস্থাপন যেকোনো অর্থমন্ত্রীর জন্যই চ্যালেঞ্জ। লোটাস কামাল সমস্যাটা বুঝেছেন, কিন্তু চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করেননি। হেঁটেছেন চেনা পথেই। আয়ের উচ্চাভিলাষী চিন্তা মাথাই রেখেই করেছেন বিশাল ব্যয়ের পরিকল্পনা। কোনো বছরই বাজেটে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলে না। ঘাটতি থাকে, ঋণ বাড়ে। তবে এ বছরটি অন্য সব বছরের মতো নয়। এবারের সংকট যেমন অভূতপূর্ব, সমাধানেও প্রয়োজন ছিল অতুলনীয় কোনো সৃজনশীলতা, আউট অব দ্য বক্স কোনো পরিকল্পনা।

লোটাস কামাল তার নামের অংশ হয়ে যাওয়া মেধার পদ্ম থেকে যদি একটু মধু এনে বাজেটে মেশাতে পারতেন, তাহলে তাতে অন্যরকম মাধুর্যের ছোঁয়া থাকতো। সেই মাধুর্যটা আমি প্রত্যাশা করেছিলাম, পাইনি, তাই হতাশ হয়েছে, মন খারাপ হয়েছে। আরও মন খারাপ হয়েছে, কারণ অর্থমন্ত্রী এবারও একটা পূর্ণাঙ্গ বাজেট উপস্থাপন করতে পারেননি। বাজেট পেশের সময় সংসদ যেমন গমগম করে, এবার তার সুযোগ ছিল না। দর্শক ও সাংবাদিক গ্যালারি ছিল শূন্য। সংসদেও একশোর বেশি এমপির প্রবেশাধিকার ছিল না। তাও সবার মুখ ছিল মুখোশে ঢাকা। অর্থমন্ত্রীও ডিজিটাল কৌশলে বাজেট দিয়েছেন।

প্রতিবারই বাজেট পেশের পর সমালোচকরা বলেন, গতানুগতিক, উচ্চাভিলাষী, বাস্তবায়নযোগ্য নয়। সবগুলোই সত্যি। প্রতিবছরই আকার বাড়া ছাড়া আর কিছুই ঘটে না। এ ধারকা মাল ও ধার। বাজেট যে পুরোপুরি বাস্তবায়নযোগ্য নয়, সেটা যেকোনো অর্থমন্ত্রীই পেশ করার আগেই জানেন। তাই তারা মনের মাধুরী মিশিয়ে কল্পনার হাওয়াই জাহাজে চড়ে বাজেট বানান। স্বপ্নে পোলাও খেলে ঘি বেশি দিতে আপত্তি কোথায়। শেষ পর্যন্ত সেই তো টানাটানির সংসারই। উচ্চাভিলাষী বাজেটে আমার আপত্তি নেই। সুন্দর স্বপ্ন দেখতে তো সমস্যা নেই। বরং উচ্চাভিলাষী নানা পরিকল্পনা দেখতে ভালোই লাগে। গতানুগতিক বাজেট নিয়েও আমার আপত্তি নেই। এমনিতে বাজেটে গতানুগতিকতার বাইরে যাওয়ার সুযোগও খুব একটা থাকে না। কিন্তু এবার সেই সুযোগ ছিল। কিন্তু অর্থমন্ত্রী সুযোগটা নেননি। চেনা পথেই গাড়ি হাঁকিয়েছেন। কিন্তু এবার চেনা পথ ভেঙেচুড়ে দিয়েছে করোনা, তাই গন্তব্যে পৌঁছানো সহজ হবে না।

স্বপ্নের পোলাওয়ে ঘি বেশি দিতে আমার আপত্তি নেই বটে, কিন্তু যখন এই করোনাধসেও আপনি জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরেন ৮.২, তখন মনে হয় এই পোলাও স্বপ্নে খেলেও বদহজম হবে। আসলে বাজেটের সবচেয়ে বড় গতানুগতিকতা হলো, সেই উন্নয়ন, জিডিপি, রাজস্ব, ঘাটতির চক্করে আটকে থাকা। এখন আসলে উন্নয়নের কথা ভাবার সময় নয়, সময় এখন টিকে থাকার, মাটি কামড়ে পড়ে থাকার, দু বেলা দু মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার। তবে দু বেলা দু মুঠো খাওয়া পেলেও এখন বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা নেই। করোনা আক্রান্ত অনেকের বাঁচতে হলে চিকিৎসা দরকার। সেখানেই বড় অসঙ্গতি। করোনা এসে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার নড়বড়ে কাঠামোকে প্রায় ধসিয়ে দিয়েছে। দুর্বলতাগুলো ওপেন করিয়ে দিয়েছে। তাই এবার বাজেটের আগে সবার নজর ছিল স্বাস্থ্যখাতের দিকে। বরাদ্দ বেড়েছে, তবে এখানেও দূরদর্শিতার ছাপ নেই। সবই যেন ‘থাউকা’।

প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে মোট ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে যা সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বা প্রায় ১৪ শতাংশ বেশি। অবশ্য এই বরাদ্দের বড় একটি অংশ খরচ হবে বেতন-ভাতা পরিশোধ এবং পরিচালন খাতে। বাড়লেও বরাদ্দের হিসেবে স্বাস্থ্যখাত এখনও পঞ্চম। অবশ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ছাড়াও আরও ১৩টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কাজে সম্পৃক্ত। সব যোগ করলে স্বাস্থ্যখাতে মোট বরাদ্দ দাঁড়ায় ৪১ হাজার ২৭ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্যখাতে জরুরি চাহিদা মেটাতে ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রেখেছেন অর্থমন্ত্রী।

অনেকেই করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানোর দাবি করেছেন। আমি কখনোই করিনি, এমনকি এই অতি জরুরি করোনা পরিস্থিতিতেও নয়। বরং আমি দাবি করছি, বরাদ্দ সঠিক ব্যবহার করুন। বরাদ্দ করলেই তো আর উন্নয়ন হয়ে যাবে না। গত বাজেটে ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও পরবর্তীতে তা সংশোধন করে ২৩ হাজার ৬৯২ কোটি টাকায় কমিয়ে আনা হয়েছে৷ শেষ পর্যন্ত সেই বরাদ্দের পুরোটাও খরচ করতে পারছে না মন্ত্রণালয়। তাহলে এমন একটি অথর্ব মন্ত্রণালয়কে বাড়তি বরাদ্দ দিতে হবে কেন? বরং যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে, সঠিক এবং দূরদর্শী পরিকল্পনায় তার সদ্ব্যবহার করতে পারলে এই টাকাতেই সমস্যার সমাধান সম্ভব। সমস্যা কিন্তু টাকায় নয়, সমস্যা পরিকল্পনায় আর সদিচ্ছায়।

বাংলাদেশে সব মন্ত্রণালয়েই কম-বেশি দুর্নীতি হয়। তবে আমার কাছে মনে হয় দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন স্বাস্থ্যখাত। এখানকার মতো লুটপাট আর অপচয় আর কোথাও হওয়া সম্ভব নয়। কদিন আগে আবজাল নামে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় হয়েছে। কারণ দেশে-বিদেশে তার হাজার কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ মিলেছে। একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর হাজার কোটি টাকা রূপকথাকেও হার মানায়। তবে আমার কল্পনাকে হার মানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বললেন, একজন হয়তো ধরা খেয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতরে এমন আরও অনেক আবজাল আছে। স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ যদি এই আবজালদের পকেটেই চলে যায়, তাহলে বরাদ্দ দিয়ে লাভ কী? ট্যাংকের ছিদ্রটা আগে সারাতে হবে। নইলে যতই পানি ঢালুন, তা ভরবে না। এমনকি এই করোনাকালেও এন-৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারি আমাদের কল্পনাকেও হার মানিয়েছে।

সেদিন টকশোতে বিশিষ্ট ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশিদ, স্বাস্থ্যখাতে সাত লাখ টাকার জিনিস ৯০ লাখ টাকায় কেনার গল্প করছিলেন। স্বাস্থ্যখাতে কোনো পরিকল্পনার ছাপ নেই। যে যেখানে সুযোগ পাচ্ছে, লুটে নিচ্ছে। যেখানে এক্স রে মেশিন দরকার, সেখানে এমআরআই মেশিন কেনা হয়ে যায়। কিন্তু চালানোর লোক না থাকায় সেই মেশিন কখনো খোলাই হয় না। বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোর গোডাউন খুঁজলে এমন অনেক বাক্সবন্দী অপ্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যাবে। প্রভাবশালী ঠিকাদাররা বিভিন্ন হাসপাতালকে বাধ্য করেন এসব জিনিস কিনতে। এক্স রে মেশিন আছে ফিল্ম নেই, অ্যাম্বুলেন্স আছে ড্রাইভার নেই, সিটি স্ক্যান মেশিন আছে অপারেটর নেই; এমন কত অসঙ্গতির গল্প যে হাসপাতালের চার দেয়ালে গুমড়ে কাঁদে; তার খবর কে রাখে?

আমি তাই কখনোই বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি করি না। আর আয় করার চেয়ে ব্যয় করা কঠিন। ব্যয় করা মানে কিন্তু ১০ তলার ছাদ থেকে টাকা ছড়িয়ে দেয়া নয়। ব্যয় করতে হলেও একটা পরিকল্পনা করতে হবে। এত লুটপাটের পরও গত অর্থবছরে বরাদ্দ অর্থের পুরোটা ব্যয় করতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এত যে করোনার ভয়, তারপরও ২০২০-২১ অর্থবছরের বরাদ্দের পুরো অর্থ খরচ করতে পারবে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাহলে বরাদ্দ বাড়িয়ে লাভ কী? প্রস্তাবিত বাজেটে থোক বরাদ্দের ১০ হাজার কোটি টাকা স্বচ্ছ ব্যবহার নিয়ে এরই মধ্যে কেউ কেউ শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। আসলে আমরা সব ঘর পোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পাই।

কথায় কথায় যে আমরা সিঙ্গাপুরের কথা বলি, দুর্নীতি আর অপচয় না হলে এই বরাদ্দ অর্থেই সিঙ্গাপুর না হলেও মানসম্মত একটা স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। সেই সম্ভবটা কি বাংলাদেশে কখনো সম্ভব হবে? নাকি আবজাল আর এন-৯৫ কেলেঙ্কারির পুনরাবৃত্তিই দেখতে হবে?

লেখক : সাংবাদিক
সূত্র : জাগোনিউজ

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে