করোনাকালেও কমেছে বন, বেড়েছে দখল

প্রকাশিত: মার্চ ২১, ২০২২; সময়: ১০:৩০ পূর্বাহ্ণ |
করোনাকালেও কমেছে বন, বেড়েছে দখল

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও দেশে (২০২০ সালে) ৫৩ হাজার একর বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে। যাতে স্পষ্ট বুঝা যায, বন খেকোরা মহামারিতেও বন উজাড়ে ব্যাস্ত ছিলো।

তথ্য বলছে, ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে প্রায় চার লাখ ৯৪ হাজার ২১১ একর। এই বিশাল এলাকার গাছগাছালি ধ্বংস না হলে ৭৩ দশমিক ৪ মেগাটন কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ ঠেকানো যেত। যা উঠে এসেছে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট পরিচালিত প্ল্যাটফর্ম গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের এক গবেষণায়।

যদিও ২০২০ সালের মধ্যে দেশের মোট ভূখেন্ডের ১৭ শতাংশকে রক্ষিত বনাঞ্চল করার ঘোষণা দিয়ে আসছে সরকার। বাস্তবতা ভিন্ন। ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের মাত্র ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ এলাকাকে রক্ষিত বন করতে পেরেছে। অন্যদিকে সরকারের লক্ষ ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে বৃক্ষাচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ ২৪ শতাংশে উন্নীত করার। সেই সাথে দেশের অবৈধ বনভূমি দখলমুক্ত করার।

ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট পরিচালিত প্ল্যাটফর্ম গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ গবেষণার তথ্যে মতে, দেশে ২০১০ সালেও প্রায় ৪৯ লাখ সাড়ে ৯৬ হাজার একর (২০ লাখ ২২ হাজার হেক্টর) বনভূমি ছিল। যা মোট ভূভাগের ১৬ ভাগ। প্রতিবছরই সেই বনভূমি কমে আসছে। ২০২০ সালে প্রায় ৫৩ হাজার ১২৮ একর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। এর আগের বছর কমেছিল ৫৪ হাজার ৬১০ একর বন। অন্যান্য বছরের মতো ২০২০ সালেও বেশির ভাগ বন উজাড় হয়েছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে- ৫১ হাজার ৮৯২ একর। ২০২০ সালে সারাদেশে এক হাজার ১৩৬ একর আদি বন ধ্বংস হয়েছে।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দেশের ভূখন্ডের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি অপরিহার্য বলা হয়। বাংলাদেশে বন আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মোট ভূমির ১২ দশমিক ৮ শতাংশের বেশি নয় বলছে বন বিভাগ। এর আগে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী যা ছিল ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। এই হিসাবে বনের বাইরের গাছ আমলে নেওয়া হয়নি। দেরশর মোট বনভূমির একটি বড় অংশ বেদখলে রয়েছে বলছে বন অধিদফতর।

দেশে বনভূমি কমছে এমন তথ্য নতুন কিছু নয়। তবে এ কমে যাওয়া মাত্রা পরিবেশে প্রভাব ফেলার পাশাপাশি দায়ত্বরতদের তৎপরতা ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর বন অধিদফতরের প্রকাশিত তথ্য বনভূমি কমার ইঙ্গিত স্পষ্ট। দখলে যাওয়া এসব বনভূমি উদ্ধারে উদাসীন সরকারি এ সংস্থাটি। দখল করে নিয়েছে বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

অধিদফতরে তথ্য বলছে, দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ একর। এর মধ্যে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৪৫২ একর বনভূমি বেদখলে। যা দখল করে নিয়েছে বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। জেলা হিসেবে যা সবচেয়ে বেশি দখলে কক্সবাজার জেলার বনভূমি। যার মোট পরিমাণ ৫৯ হাজার ৪৭১ একর। যদিও বন অধিদফতরের দখদখলের পরিমাণ জানালেও কারা এসব জমি দখলে রেখেছেন তা জানায়নি। এ নিয়ে তৈরি হয়েছে ধূম্রজাল।

এদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলছে, অধিদপ্তর কর্তৃক সর্বশেষ পাঁচ বছরে মাত্র আট হাজার ৭৯২ একর (৩%) উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। বাকিগুলো উদ্ধার কিংবা বন খেকোদের হাত থেকে বন বাঁচাতেও তেমন আগ্রহ নেই সরকারি এ সংস্থাটির।

তারা বলছেন, সরকার উন্নয়নকাজের নামে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য বনভূমি বরাদ্দ দিয়েছে বন মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে বড় বরাদ্দ নিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা), বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফআইডিসি), গ্যাসক্ষেত্র ও সড়ক কর্তৃপক্ষ। রোহিঙ্গাদের বসতির কারণে ধ্বংস হওয়া বনভূমি এ হিসাবের বাইরে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) কক্সবাজারের বনভূমি নিয়ে করা গবেষণায় উঠে আসে, বনভূমি ধ্বংসে বেশি ভূমিকা রাখছে সরকারি প্রতিষ্ঠান। শুধু কক্সবাজার জেলার দুই লাখ ৬০ হাজার ৪৬ একর বনভূমির মধ্যে দখল হয়ে গেছে ৪৫ হাজার ৯৯০ একর জমি। অবৈধ দখলদার ৪৩ হাজার ৫৬৮ ব্যক্তি ও ৬৯৬ প্রতিষ্ঠান। রোহিঙ্গাদের দখলে যাওয়া জমির পরিমাণও নেহায়েত কম নয়। প্রায় ছয় হাজার ১৬৪ একর।

গবেষণার তথ্যমতে,বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে ১৪ হাজার ৩৭২ একর বনভূমি। বন বিভাগ থেকে ভূমি মন্ত্রণালয়কে হস্তান্তর করা হয়েছে ১০ হাজার ৪৬০ একর। সোনাদিয়া দ্বীপ ও টেকনাফে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) আট হাজার ৮৮৪ একর, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে ২০২ একর ও ডুলাহাজারা খ্রিষ্টান মেমোরিয়াল হসপিটালকে ১৪ একর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়াও হর্টিকালচার, সড়ক ও জনপথ, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, আবহাওয়া অধিদপ্তর, পর্যটন করপোরেশন, সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি বেশ কিছু সংস্থার নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জমি। সব প্রতিষ্ঠানই গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে। গত এক বছর চালানো এ গবেষণায় ১৯ মার্চ পর্যন্ত সব কথ্য মিলেছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বন সংরক্ষণে বড় ঘাটতি বন সংরক্ষণ আইনেই। ১৯২৭ সালের বন আইন দিয়ে এখনও বন বিভাগ চলছে। যেখানেবনের সংজ্ঞা নেই, বনের ধরন, বন সংরক্ষণ প্রক্রিয়া ও উন্নয়নকাজে বনের জমি ব্যবহার এবং বরাদ্দ প্রদানের বিষয় নেই। কোনো বিধিমালা নেই। ফলে ঢালাওভাবে ব্যবহূত হচ্ছে বনভূমি। এ ছাড়া দুর্নীতি ও অদক্ষতাও এমকটি বড় প্রতিবন্ধকতা।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে