আসল টাকায় উঠছে না পেঁয়াজ চাষিদের

প্রকাশিত: এপ্রিল ১০, ২০২২; সময়: ৭:৪৭ অপরাহ্ণ |
আসল টাকায় উঠছে না পেঁয়াজ চাষিদের

রাজিউর রহমান রুমী, পাবনা :  আশায় ছিলাম, ”রমজানের সময় পেঁয়াজের উত্তোলন মৌসুম হওয়ায় এবার ভালো দাম পাব, কিন্তু বাজারের যে পরিস্থিতি, তাতে লাভ তো দূরের কথা, আসল টাকাই উঠছে না”। অন্তত পেঁয়াজ উত্তোলনের তিন মাস বিদেশ থেকে আমদানি বন্ধ রাখলে কৃষক ক্ষতির হাত থেকে থেকে রেহাই পেত।’ আক্ষেপ করে বললেন পাবনার সুজানগর উপজেলার নরোসিংহ পুরের পেঁয়াজ চাষি শাহীন মোল্লা।

তিনি বলেন পেঁয়াজ চাষে প্রচুর পরিমাণ সার, ওষুধ ও সেচের প্রয়োজন হয়। এবার সব কিছুরই দাম বেশি। ফলে অন্য ফসলের চেয়ে পেঁয়াজে খরচ বেশি। এক মণ পেঁয়াজ উৎপাদন করতে সব মিলিয়ে খরচ হচ্ছে ৯ থেকে সাড়ে ৯শ টাকা।
পাবনার সুজানগর, আতাইকুলা, বনগ্রাম,চিনাখড়া,হাজির হাট ঘুরে দেখা যায়,হাটের চারদিকে পেঁয়াজের ছড়াছড়ি। বাজার সরগরম নাই পাইকার ব্যাপারীদের হাঁকডাকে । ব্যাপক সরবরাহে দাম কমে যাওয়ায় হতাশ চাষিরা।

নিজেদের উৎপাদিত পেঁয়াজ সামনে নিয়ে বসে আছেন মন ভার করে। দরদামের হাঁকাহাঁকিতেও নেই খুব বেশি আগ্রহ। কৃষকরা জানান, গুণগত মানে সবচেয়ে ভালো পেঁয়াজ প্রতি মণ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায়। এতে উৎপাদন খরচ উঠছে না তাদের।

পাবনায় জেলায় এবার কন্দ, চারা মিলে প্রায় ৪৪ হাজার ৮১০ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষ হয়েছে। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৭ লাখ ৪৯ হাজার ৩৪ টন। পাবনার নয় উপজেলাতেই পেঁয়াজের আবাদ হয়। তার মধ্যে প্রথম সুজানগর ও দ্বিতীয় সাঁথিয়া। এছাড়াও পাবনা সদর, বেড়া, আটঘড়িয়া, ফরিদপুর, ভাংগুড়া, চাটমোহর ও ঈশ্বরদীতেও ব্যাপক পেঁয়াজের চাষাবাদ হয়।

আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় পুরো জেলায় এবার পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে পেঁয়াজে। দাম কম।ভাল মানের পেঁয়াজ খুচরা বাজারে ২২-২৩টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজ চাষিরা ফলনে খুশি হলেও দামে বেজার। তাদের অভিযোগ, বাজারে যে দামে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে তাতে ন্যায্যমূল্য তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচই উঠছে না।

পাবনার সুজানগর উপজেলা উত্তরবঙ্গে পেঁয়াজের ভান্ডার বলে পরিচিত । এখন হালি পেঁয়াজ উত্তোলন শুরু হয়েছে। সপ্তাহ খানেকেরে মধ্যে শুরু হবে পুরোপুরি। ফলন ভালো দামে অখুশি কৃষকরা। কৃষি বিভাগ সুত্রে জানা গেছে, গত বছর এ জেলায় ১৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে চারা পেঁয়াজের আবাদ হলেও এবার আবাদ হয়েছে ১৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে। অনুকূল আবহাওয়া ও সঠিক সময়ে সার বীজ দিতে পারায় সাধারণ জাতের ক্ষেত্রে প্রতি বিঘা জমিতে ৪০ থেকে ৫০ মণ এবং হাইব্রিড জাতের চারা থেকে ৮০-৯০ মণ পর্যন্ত পেঁয়াজ এবার ঘরে তুলতে পারছে কৃষক। কিন্তু সরবরাহ বেশি থাকায় ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না তারা।

সুজানগরের চরদুলাই গ্রামের কৃষক আবদুর রউফ বলেন, ‘ছয় বিঘা জমিতে তাহেরপুরী জাতের পেঁয়াজ আবাদ করেছি। আবহাওয়া ভালো ছিল, প্রতি বিঘায় গড়ে ৪০ থেকে ৪৫ মণ পেঁয়াজের ফলন হয়েছে। সার, বীজ, তেলের দাম বাড়ায় প্রতি মণে প্রায় এক হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু বাজারে প্রতি মণ পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০০-৮৫০ টাকায়। এতে খরচই উঠছে না।’ প্রতি মণ পেঁয়াজ কমপক্ষে ১২০০ টাকায় বিক্রি করতে পারলে, একটু লাভবান হতাম।

সদর উপজেলার ভাঁড়াড়া গ্রামের কৃষক মুতালেব বলেন, ‘যখন কৃষকের হাতে পেঁয়াজ থাকে, তখন সরকার বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে। আর কৃষকের পেঁয়াজ ফুরিয়ে গেলে পেঁয়াজ আমদানিও বন্ধ করে দেয়। এতে মজুদদার সিন্ডিকেট লাভবান হলেও, কৃষক, ভোক্তা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।এ বছর রমজানে পেঁয়াজের ভরা মৌসুম। ফলে বাজারে সংকট পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করা দরকার বলেন তিনি।’

ভারতের পেঁয়াজ আসা নিয়ে এখন দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন চাষীরা । পেঁয়াজ চাষী মশিউল সরকার জানান, সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় উত্তোলন মৌসুমে পেঁয়াজ কমদামে বিক্রি করে লোকসান গুণতে হয় তাদের। চাটমোহরের সাবেক পৌর কমিশনার চঞ্চল বলেন, প্রতিবছর পেঁয়াজ ওঠার সময় ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির কারণে দাম কমে যায়।

এছাড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় একসাথে কৃষককে উৎপাদিত পেঁয়াজ কমদামে বিক্রি করে দিতে হয়। সরকার আলু, ধানসহ বিভিন্ন ফসল সংরক্ষণে ব্যবস্থা নিয়েছে। এমন ব্যবস্থা পেঁয়াজের জন্য করা হলে, কৃষক ন্যায্য মূল্য পাবে, পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও বাজারে কারসাজি করতে পারবে না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পাবনার উপপরিচালক মিজানুর রহমান জানান, ‘দেশের উৎপাদিত মোট পেঁয়াজের এক-চতুর্থাংশ সরবরাহ হয় পাবনা থেকে। চলতি মৌসুমে জেলায় ৫৩ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। মাঠের পরিস্থিতি বলছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও উৎপাদন বেশি হবে।

চাষিরা উত্তোলন মৌসুমে বকেয়া পরিশোধের চাপ থাকায় সব বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন । ফলে দাম কম পান। বর্তমানে পেঁয়াজের বাজার নিম্নমুখী। ক্ষতি পোষাতে কৃষকদের কিছুটা বেগ পেতে হবে।কিছুদিন পর দাম একটু বাড়বে। আমরা জেলায় সরকারি পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার তৈরির প্রস্তাবনা দিয়েছি। সংরক্ষণের সুযোগ থাকলে কৃষকের হাতে পেঁয়াজ থাকবে, ন্যায্যমূল্যও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।’

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে