ইচ্ছেমতো ওষুধের দামবৃদ্ধি, কাটা হচ্ছে জনগণের পকেট

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৩; সময়: ১০:০৭ পূর্বাহ্ণ |
ইচ্ছেমতো ওষুধের দামবৃদ্ধি, কাটা হচ্ছে জনগণের পকেট

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ভালো নেই দেশের সাধারণ মানুষ। ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবন। প্রতিনিয়ত বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। সেই সঙ্গে ইচ্ছেমতো বাড়ানো হচ্ছে জীবন বাঁচাতে ব্যবহার হওয়া বিভিন্ন ওষুধের দাম। চাল, ডাল, মাংস, ডিমের মতো এসব নিত্যব্যবহার্য ওষুধের দামেও পকেট কাটা হচ্ছে সাধারণ জনগণের।

রাজধানীর বনশ্রীর বাসিন্দা সাবেক স্কুলশিক্ষক সাবেরা খাতুন। স্কুলশিক্ষক ষাটোর্ধ্ব এই নারী বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছেন। বয়সের সাথে সাথে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা অসুস্থতায় ভুগছেন। মাসের শুরুতে পেনশনের টাকা তোলার পর একসাথে পুরো মাসের ওষুধ কেনেন তিনি।

নিজের ওষুধ কেনার অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, এলাকার ফার্মেসি থেকে মাসের একটা নির্দিষ্ট দিনে কয়েক বছর ধরে নিজের ওষুধ নিজেই কিনছি। ওষুধের দাম প্রতি বছই কিছু না কিছু বাড়ে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে প্রতিমাসেই বাড়ছে। প্রতিবার এসে দেখছি কোনো না কোনো ওষুধের দাম বেড়ে গেছে। আগে যে টাকায় ওষুধ কিনতাম এখন তা দিয়ে হচ্ছে না। আমাদের খরচের একটা নির্দিষ্ট হিসেব থাকে। প্রতি মাসে কোন কাজে কত টাকা খরচ করব, সেটার একটা পরিকল্পনা টাকা হাতে আসার আগেই করে রাখি। ইদানিং সব জিনিসপত্রের সাথে ওষুধের দামও বেড়েছে। ফলে বাজেটের মধ্যে কোনো কিছুই ঠিকঠাক মতো করা সম্ভব হচ্ছে না।

ক্যাব এর সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, যথেচ্ছা দাম বাড়ানোর পাশাপাশি বাজারে ভেজাল ওষুধেরও ছড়াছড়ি। সেই বিষয়েও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটির তেমন কোনো তৎপরতা নেই। ভোক্তা অধিকার কিংবা এ ধরনের সংস্থাগুলো যখন ফার্মেসিগুলোতে অভিযান চালায় তখন দেখা যায় বস্তায় বস্তায় নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে। এটা ঔষুধ প্রশাসন অধিদফতরের দেখার কথা। কিন্তু তারা দেখছে না।

মায়ের ওষুধ কিনতে আসা জাহিদ বলেন, আমার মা ডায়াবেটিস, আর্থাইটিসসহ নানা স্থায়ী রোগে ভুগছেন। ফলে তিনি নিয়মিত নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ খান। সাধারণত মাসের শুরুতে ১৫ দিন অথবা এক মাসের ওষুধ কিনি। এ মাসে ছাড়সহ ২ হাজার ৫৫০ টাকার ওষুধ কিনেছি। গত কয়েক মাস ধরে এর কাছাকাছি খরচ হচ্ছে। অথচ মাস ছয়েক আগে এই ওষুধ কিনতে আমার দুই হাজার থেকে দুই হাজার একশ টাকা খরচ হতো। এমনিতেই দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে যদি ধারাবাহিকভাবে ওষুধের দামও বাড়তে থাকে! সব কিছু বাদ দিলেও খাবার আরও ওষুধ তো বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। ফলে অন্যদিকে বাজেট কমাতে হচ্ছে।

সাবেরা খাতুন কিংবা জাহিদের মতো ওষুধ কিনতে ফার্মেসিতে গিয়ে সবারই একই অভিজ্ঞতা। শুধু তারা নয়, ক্রেতাদের দাম সংক্রান্ত নানা প্রশ্নে জর্জরিত ফার্মেসি দোকানি থেকে বিক্রয় কর্মীরাও।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খুচরা ওষুধ বিক্রয় চেইন তামান্না ফার্মেসির এক কর্মী বলেন, ওষুধের দাম নিয়ে প্রতিনিয়ত ক্রেতাদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। সবার একই কথা, ‘গতবার কিনে গেলাম এত দিয়ে, এবার অত চাচ্ছেন কেন?’ এখন দাম তো আসলে আমার নির্ধারণ করি না। আর খুচরা বিক্রেতা হিসেবে কোনো ওষুধের দাম ইচ্ছামতো কম-বেশি করার কোনো সুযোগই আমাদের নেই। তাই জবাবে কোম্পানি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে বলে জানাচ্ছি।

ওষুধের বাজারের বর্তমান অবস্থা

রাজধানীর বিভিন্ন ফার্মেসি ও ওষুধ বিক্রি করা প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, গত তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে বিভিন্ন ওষুধের দাম বেড়েছে। এর কিছু সরকারি তথা ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের সিদ্ধান্তে এবং বাকিগুলোর দাম কোম্পানিগুলো বাড়িয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক কয়েক মাসে বহুল ব্যবহৃত ওষুধের মধ্যে ফেনাডিন ১২০ মিলিগ্রাম ৮ টাকার পরিবর্তে ১২ টাকা, সেফাক্লাভ ৫০০ মিলিগ্রাম ৫০ টাকার পরিবর্তে ৬০ টাকা, এমডোক্যাল ৫ মিলিগ্রাম ৫ টাকা পরিবর্তে সাড়ে ৫ টাকা, ৫০০ মিলিগ্রাম নাপা ৮ টাকার পরিবর্তে ১২ টাকা, ৫০ মিলিলিটার নাপা সিরাপ ২০ টাকা ৭০ পয়সার পরিবর্তে ৩৫ টাকা, মোনাস ১০ মিলিগ্রাম ১৬ টাকার পরিবর্তে সাড়ে ১৭ টাকা এবং এ জেড ৫০০ মিলিগ্রাম ৩৫ টাকার পরিবর্তে ৪৫ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে। ডায়াবেটিস রোগীদের ইনসুলিন ল্যান্টাস পেনফিল ৭৮৫ টাকার পরিবর্তে ৯৮২ টাকা এবং হুমুলিন ৩০/৭০ (ভেইল) ৭৫০ টাকার পরিবর্তে ৮৩৩ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে।

অর্থাৎ ডায়াবেটিস থেকে শুরু করে বিভিন্ন রোগের প্রায় সব ওষুধের দামই বেড়েছে। গ্যাস্ট্রিকের একই গ্রুপের ওষুধ ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানির দামের মধ্যে বেশ তফাৎ। বেশি প্রচলিত ওষুধগুলোর দাম আগে থেকেই বেশি। সেগুলোর দাম স্থির থাকলেও একই গ্রুপের অন্য ওষুধের (কম প্রচলিত) দাম কিছুটা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ফার্মেসি সংশ্লিষ্টরা।

ওষুধের ঘোষিত মূল্যবৃদ্ধি

২০২২ সালের ৩০ জুন প্রাথমিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ওষুধের দামবৃদ্ধির ঘোষণা দেয় নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ঔষুধ প্রশাসন অধিদফতর। ওইদিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত মূল্য নির্ধারণ কমিটির ৫৮তম সভায় এসব ওষুধের পুনর্নির্ধারিত দাম অনুমোদন করা হয়। এর আগে ২০১৫ সালে কয়েকটি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সরকারিভাবে এ সংক্রান্ত কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করা হলেও ঘোষণার বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই বাজারে বহুল ব্যবহৃত ২০টি জেনেরিকের ৫৩ ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বৃদ্ধি পায়।

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য তালিকাভুক্ত ১১৭টি ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা থাকে সরকারের হাতে। ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল, এক্সিপিয়েন্ট, প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, পরিবহন ও ডিস্ট্রিবিউশন ব্যয়, ডলারের বিনিময়মূল্য, মুদ্রাস্ফীতিসহ নানা কারণে ওষুধ উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। এসব কারণে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে বলে জানায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

এরপর বছরের শেষে (২০২২) আরেক দফা বাড়ানো হয় ওষুধের দাম। স্যালাইনসহ ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লিবরা ইনফিউশন লিমিটেডের ২৪ ধরনের ওষুধের দাম প্রকারভেদে ৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দেয় সরকার। হাইকোর্টে কোম্পানিটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশনায় এসব ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে বলে জানায় বাংলাদেশ ঔষুধ প্রশাসন অধিদফতর।

এছাড়া বিভিন্ন ওষুধ উৎপানকারী প্রতিষ্ঠান ঘোষণা দিয়ে বা ঘোষণা ছাড়ায় তাদের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করে। উৎপাদন খরচ, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণ দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো ওষুধের দামের সমন্বয়ের কথা উল্লেখ করে দাম বাড়িয়েছে।

ওষুধের দামবৃদ্ধির প্রক্রিয়া জনবিরোধী

বিভিন্ন ধাপে ওষুধের দাম বৃদ্ধি ও জনগণের উপর চাপের বিষয়ে জানতে চাইলে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, এটি খুবই অস্বাভাবিক একটা অবস্থা। বিশেষ করে যে মেডিসিনগুলো সবসময় প্রয়োজন হয়, যেমন ডায়াবেটিস বা ইনসুলিন সংক্রান্ত যে ওষুধগুলো আছে, এগুলোর দাম নিয়মিত বাড়ছে। ওষুধ কোম্পানিগুলো ধারাবাহিকভাবে সেই দাম বৃদ্ধি করছে। মাসের শুরুতে যে দাম, মাস শেষে দেখা যায় তা পরিবর্তন হয়ে গেছে।

এ প্রক্রিয়াটি দীর্ঘদিন ধরে চলমান আছে। আমরা এই বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতকে জানিয়েছি, মাসের শুরুতে ওষুধের যে দাম থাকছে, মাসের শেষে তা থাকছে না। জবাবে তারা বলছে, তারা যে ১০৭টির দাম বাড়িয়েছিল এগুলো তার বাইরে। এর মাধ্যমে তারা বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এখানে ঔষধ প্রশাসনের তেমন নজরদারি নেই। ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ধরনের নজরদারি প্রয়োজন ছিল তারা তা করছে না। এটি না থাকার কারণে কোম্পানিগুলো আইনের নানা ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিপরীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানটি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।

ঔষুধ প্রশাসন অধিদফতরের নিস্ক্রিয়তার সমালোচনা করে তিনি বলেন, যথেচ্ছা দাম বাড়ানোর পাশাপাশি বাজারে ভেজাল ওষুধেরও ছড়াছড়ি। সেই বিষয়েও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটির তেমন কোনো তৎপরতা নেই। ভোক্তা অধিকার কিংবা এ ধরনের সংস্থাগুলো যখন ফার্মেসিগুলোতে অভিযান চালায় তখন দেখা যায় বস্তায় বস্তায় নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে। এটা ঔষুধ প্রশাসন অধিদফতরের দেখার কথা। কিন্তু তারা দেখছে না। তারা কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার কারণে ভোক্তা বা রোগীর স্বার্থ উপেক্ষা করছে বলে আমাদের ধারণা।

ওষুধের দাম ও ভোক্তার অধিকার রক্ষায় ক্যাবের ভূমিকার বিষয়ে জানতে চাইলে ক্যাব-এর সহ-সভাপতি আরও বলেন, আমরা ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরকে একাধিকবার লিখিতভাবে আমাদের অভিযোগের কথা জানিয়েছি। তারা যদি একশনে না যায় তাহলে এ নিয়ে বিবৃতি, কথা বলা বা স্মারকলিপি দেওয়া ছাড়া আমাদের কিছুই করার নেই। আমরা ধারাবাহিকভাবে নানা কর্মসূচি পালন করছি যেন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে