গ্রামের মানুষ, শহরের মানুষ: আয় ও ব্যয়

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৮, ২০২৩; সময়: ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ |
খবর > মতামত
গ্রামের মানুষ, শহরের মানুষ: আয় ও ব্যয়

ড. মাহবুব হাসান : বাসার কাজের মহিলা ফাহিমা আসন্ন ঈদের পর গ্রামের বাড়িতে যাবে, সে আর ফিরে আসবে না। তার স্বামী মাটি কাটার কাজ করে। সেও ফিরে আসবে না। কারণ হিসেবে বলেছে তাদের পোষায় না। দুজনে যা ইনকাম করে তা দিয়ে চার বাচ্চাসহ সংসার চলে না। কিন্তু গ্রামে কি তাদের কোনো কাজ আছে? স্বামীটি হয় তো কৃষিকাজ করে রোজগার করতে পারবে। কিন্তু তাতে কি ওই সংসার চলবে?

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি জরিপ করেছে গ্রামের গরিব মানুষের আয় ও ব্যয় নিয়ে। প্রতিষ্ঠানটি কয়েক বছর পর পর এ জরিপ গবেষণা করে। ওই জরিপ গবেষণা থেকে আমরা এমন কিছু তথ্য পাবো যা দেশের গরিব মানুষের প্রকৃত চেহারা দেখতে পাওয়া যাবে। বিবিএস’র ‘খানা আয় ও ব্যয়’ সম্পর্কিত প্রতিবেদনের তথ্য দেওয়া যাক।

আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের মিল না থাকলেও গ্রামীণ মানুষের ব্যয় আর জাতীয় স্তরের মানুষের ব্যয়ের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। কারণ, আমদানিকৃত ও দেশীয় পণ্যের মূল্যের বা মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে তেমন কোনো হেরফের নেই। শহরে ও গ্রামে প্রায় একই দর বহমান। শহরের মানুষের ইনকাম বেশি সে তবুও মানিয়ে নিতে পারে, কিন্তু গ্রামের মানুষ কি দিয়ে তা মানিয়ে নেবে? তার তো বাড়তি ইনকাম নেই।

গ্রামের মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। সেখানে একটি পরিবারে প্রতি মাসে গড়ে ২৬ হাজার ১৬৩ টাকা আয় করে। অথচ ব্যয় হয় গড়ে ২৬ হাজার ৮৪২ টাকা। অর্থাৎ প্রতি পরিবারে মাসে যা আয় করে তার চেয়ে ব্যয় বেশি হয় ৬৬৯ টাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপে গ্রামের এই চিত্র উঠে এসেছে। গত বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়। (সমকাল/এপ্রিল ১৪, ২০২৩) এর আগে ২০১৬ ও ২০১০-এ বিবিএস এই খানা জরিপ করেছিল। ওই দুই সনের গরিব পরিবারের আয় ব্যয়ের হিসাবটাও দেখে নেওয়া জরুরি। তাহলে গ্রামের গরিব পরিবারের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে।

বিবিএসের বিগত খানা আয়-ব্যয় জরিপ বিশ্লেষণেও গ্রামীণ পরিবারে আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয়ের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ২০১৬ সালের জরিপে গ্রামীণ পরিবারে মাসিক আয় ছিল ১৩ হাজার ৮৬৮ টাকা। ওই সময়ে ব্যয় ছিল ১৪ হাজার ১৫৬ টাকা। অর্থাৎ ওই সময়ে মাসিক আয়ের চেয়ে ব্যয় ২৮৮ টাকা বেশি ছিল। এবারের জরিপে পরিবারের গড় সদস্য সংখ্যা পাওয়া গেছে ৪ দশমিক ২৬ জন। (সমকাল/১৪ এপ্রিল,২৩)

এই জরিপ সরকারের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের। ফলে এই জরিপ গবেষণা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেওয়ার কথা নয়। আমরা সেটা করছি না। প্রশ্নটি এখানেই যে গাঁয়ের মানুষের মাসিক আয় গড়ে ২৬ হাজার ১৬৩ টাকা হলে ওই জরিপের নিম্নআয়ের মানুষের মাসিক আয় কতো? এটা তো গড় আয়। গড় আয়ের উচ্চস্তরটি কতো? আর নিম্নআয়ের স্তরটি কতো?

এটা জানা জরুরি এ কারণে যে গড় হিসাব দিয়ে খানাগুলোর আর্থিক সঙ্গতি বোঝা কঠিন। ফাহিমার গ্রামের ইনকাম প্রতি মাসে ২৬ হাজার ১৬৩ টাকা হবে না। আমি নিশ্চিত। তাহলে তার পরিবারের প্রকৃত আয় কতো। আর সেই আয়ে তার চার সদস্যের ব্যয় কি মেটানো যাবে?

গড় করে অর্থনৈতিক হিসাব কষার যিনি বা যারা উদ্ভাবক, তারা কি করে গরিবকে ধনবান হিসেবে দেখানোর কৌশলটি নির্মাণ করেছেন, তারা যে অর্থনীতি বিচারে ধনিক শ্রেণির মানুষ, তা বলাই বাহুল্য। কারণ ফাহিমাদের মাসিক বা বাৎসরিক ইনকামের হিসাবকে, একজন শিল্পপতির বাৎসরিক ইনকামের সঙ্গে মিলিয়ে যে গড় দেখানো হয়, তার ফলে যে অংকটা বেরিয়ে আসে, তাই প্রমাণ করে গরিব কেমন করে ধনবান হয়ে ওঠে।

এটা যে মিথ্যা এবং প্রতারণা গরিব মানুষের সঙ্গে মশকরা- এই কথাটি সাধারণ মানুষ বোঝে না। কিংবা বুঝলেও তাদের কথা তো নিয়ন্ত্রক সরকার তা শুনবেন না। ফলে গড় করে দেখা অর্থ গরিবের পকেটে না থাকলেও সরকারের রাজনৈতিক ঢেঁকুর তোলার বহুৎ সুযোগ এসে জুটে যায়। জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের হিসাবও ঠিক একই রকম। আমাদের মাথাপিছু আয় এখন তিন হাজার ডলারেও বেশি। কিন্তু আমার আপনার পকেটে কি তিন হাজার ডলার আছে?

আবার শিল্পপতির পকেটে কিন্তু তিন লাখ কোটি বা তিরিশ লাখ কোটি টাকা আছে। গড়ে হিসাব কষায় একটি ভালো চেহারা দেখানোর অপূর্ব সুযোগ আছে। সরকার, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সেই সুযোগ নেয়। খানা আয় ও ব্যয়ের জরিপ প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে একই রকম চিত্র। ডিটেলস আলোচনায় গেলে আরও অসঙ্গতি উঠে আসবে। সে পথে না গিয়ে আমরা অন্য কথা বলি, তাতে অন্য কিছু প্রকাশ হতে পারে।

নতুন জরিপে দেখা গেছে, গ্রামীণ খানা পর্যায়ে আয় জাতীয় পরিমাণের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার টাকা কম। সারাদেশে পরিবারপ্রতি গড় আয় ৩২ হাজার ৪২২ টাকা। অন্যদিকে ব্যয়ের ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ের চেয়ে ব্যবধান তুলনামূলক কম। ৪ হাজার ৬৫৮ টাকা। পরিবার প্রতি জাতীয় ব্যয় ৩১ হাজার ৫০০ টাকা। এর অর্থ জাতীয় আয়ের চেয়ে গ্রামের পরিবারগুলো অনেক পিছিয়ে। তবে জাতীয় ব্যয়ের ক্ষেত্রে প্রায় সমান চাপ সামলাতে হচ্ছে।

উদ্ধৃতির এই অংশটুকু এটাই প্রমাণ করে গ্রামীণ থানা পর্যায়ের আয়ের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ের আয়ের/ ব্যয়েরও মিল নেই। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের মিল না থাকলেও গ্রামীণ মানুষের ব্যয় আর জাতীয় স্তরের মানুষের ব্যয়ের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। কারণ, আমদানিকৃত ও দেশীয় পণ্যের মূল্যের বা মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে তেমন কোনো হেরফের নেই। শহরে ও গ্রামে প্রায় একই দর বহমান। শহরের মানুষের ইনকাম বেশি সে তবুও মানিয়ে নিতে পারে, কিন্তু গ্রামের মানুষ কি দিয়ে তা মানিয়ে নেবে? তার তো বাড়তি ইনকাম নেই। তাহলে গ্রামের মানুষ যে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করতে বাধ্য হচ্ছে, সেটা তারা করছে কীভাবে।

বিবিএস’র জরিপ সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেছেন তারা ধারদেনা করে চলছে। কিন্তু গরিব মানুষকে কেউ ধার দিতেও ভয় পায়। কারণ সে টাকা ফেরৎ দিতে পারবে না। ধনীকে ধার দিতে/লোন দিতে ভয় পায় না কেউ। বিশেষ করে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ধনীদের প্রতি দরদ অবারিত। তারা ঋণের জন্য যে সব কাগজপত্র জমা দেয়, সেগুলোর বৈধতা নিয়ে ব্যাংকাররা তেমন কোনো প্রশ্ন তোলে না। আর সেই কাগজপত্র বৈধ কি অবৈধ তা বোঝা বা যাচাই করার আগেই ঋণ দিয়ে দেয়।

ঋণখেলাপিদের পুনরায় ঋণ দিতে তাদের উৎসাহে কোনো ভাটা নেই। খেলাপি ঋণ পরিশোধে তাই খেলাপিদেরও কোনো উৎসাহ নেই। খেলাপি ঋণ পরিশোধে এতো সব প্রণোদনা সত্ত্বেও ঋণীদের মন ভেজানো যায়নি। এসব আর্থিক অভিঘাত জাতীয় স্তর থেকে স্থানীয় স্তরে গিয়ে লাগে। সিন্ডিকেটেড ব্যবসায়ীদের ফাঁপিয়ে তোলা মূল্যস্ফীতির অভিঘাতেও গ্রামীণ জনপদের লোকেরা হারাতে থাকে তাদের আয়ের একটি অংশ, কিন্তু তারা তা বোঝে না। যারা সয়াবিন তেলের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বাড়ালো সেই তেল শহরে ও গ্রামে কিন্তু একই দামে বিক্রি হবে।

ওই বাড়তি টাকা তো গরিবের পকেট থেকেই বেশি গেলো। গরিবের সংখ্যা কিন্তু ধনবানের চেয়ে শতগুণ বেশি। এটা মনে রাখতে হবে। খানা আয় আর ব্যয়ের গড়ে তাই প্রতিফলিত হয়। ব্যয়ের ক্ষেত্রে যে বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে গ্রামীণ মানুষকে, সেই দায় মেটাতে গিয়েই তো তারা নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে একদিন উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়।

পাকিস্তানি আমলে, গোটা পাকিস্তানে ছিল ২২টি ধনিক পরিবার। স্বাধীন বাংলাদেশে মাত্র ৫০ বছরের ইতিহাসে আমরা লাখপতি বানিয়েছি লাখে লাখে। আর কোটিপতি বানিয়েছি কয়েকশ আর শত শত ও হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বানিয়েছি গুটিকতক। তাদের সংখ্যাও আঙুলে গোনা যাবে না। এই অর্থনৈতিক ডেভেলপমেন্ট তো দেশেরই উন্নতিকে চোখ ঠারে।

তবে ক্ষতি বা অসমতা হচ্ছে ধনবানের সঙ্গে ধনহীন মানুষের সংখ্যা আকাশপাতাল ব্যবধানের। এই ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির গরিব দেশে এ ব্যবধান বাড়তেই থাকবেই। কারণ পুঁজির ধর্মই এটা। পুঁজির ধর্ম গরিব বাঁচানো নয়। গড় হিসাব দেখিয়ে বিত্তহীনকে বিত্তের অধিকারী দেখানো, প্রতারণা। এই মিথ্যাই আমাদের প্রধান অন্তরায়।

লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে