আমরা আর মামুদের খেলায়’ লাভ কিন্তু বিএনপির

প্রকাশিত: জুন ১৪, ২০২৩; সময়: ১২:১৪ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
আমরা আর মামুদের খেলায়’ লাভ কিন্তু বিএনপির

পদ্মাটাইমস ডেস্ক: খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারেরটা সরকার পেল। বিরোধীদের যা প্রাপ্য সেটিও তারা পেয়েছে। কিন্তু কী পেল বর্তমানের একমাত্র অবাধ ও স্বাধীন বিরোধী রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ? এ ব্যাপারে একটি নীতিকাহিনি শোনা যাক। কিছু চতুর ব্যক্তি একবার মহামতি যিশুকে পরীক্ষা করতে এসেছেন। তাঁরা জানতেন, তিনি সত্য ছাড়া মিথ্যা বলবেন না। তখন ফিলিস্তিনে রোমান সিজারের শাসন চলে। কিন্তু যিশু প্রচার করছিলেন ন্যায়রাজ্যের কথা, যেখানে সাম্য থাকবে; সম্রাটের আনুগত্য করতে হবে না কাউকে। চতুর অবিশ্বাসীরা চেয়েছিলেন যিশুখ্রিস্টের মুখ দিয়ে যদি সিজারের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলানো যায়, তাহলে তাঁকে বিপদে ফেলা যাবে। তো তাঁরা যিশুকে জিজ্ঞাসা করলেন, সম্রাট সিজারকে রাজস্ব দেওয়া বিধিসংগত কিনা?

 

যিশু চালাকিটা ধরে ফেললেন। বললেন, আমাকে কেন পরীক্ষা করতে এসেছ? আচ্ছা যাও, তোমরা এই রাজ্যের একটা মুদ্রা নিয়ে আস। তাঁরা নিয়ে এলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, এর ওপর কার প্রতীক আঁকা? তাঁরা বললেন, সিজারের। তখন তিনি বললেন, ‘যাঁর জিনিস তাঁকেই দিয়ে আস। যা সিজারের তা সিজারকে দাও, যা খোদার তা খোদার কাছে সমর্পণ করো।’

সংবাদ থেকে জানা গেল, খুলনার ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী মাওলানা আবদুল আউয়াল অভিযোগ করেছেন যে, ইভিএম মেশিনে তাঁদের দলীয় প্রতীক হাতপাখায় চাপ দিলে নৌকায় চলে যাচ্ছে। অভাজনের প্রশ্ন– এই ইভিএম কে দিয়েছে? সরকার। গত কয়েক বছর এই হাতপাখার গায়ে বাতাস দিয়ে গেছে কে? উত্তর হবে– ক্ষমতাসীন দল ও সরকার। যখন কেউ কোথাও কোনো প্রতিবাদ করতে পারতেন না; বড় জনসভা বা মিছিল করা যেত না; তখনও চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বিনা বাধায় রাজনীতি করেছে। স্বাধীন জবানে বক্তৃতা করেছেন তাঁদের নেতারা। সুতরাং হাতপাখা তো সিজারের অর্থাৎ ক্ষমতাসীনদের। তাই হাতপাখার ভোট তো নৌকাতেই যাবার কথা। এতে অবাক হওয়ারই বা কী আছে? দুঃখ পাওয়ারই বা কী আছে? যা সিজারের প্রাপ্য, তা তো সিজারের ঘরেই জমা দিতে হবে।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি কোনো ধরনের নির্বাচন করবে না– বলেছে। তারা দেখাতে চেয়েছে, এই ইসি নিরপেক্ষ নয়। তা প্রমাণের জোগান তারা বরিশাল ও খুলনা থেকে পেয়ে গেছে। বরিশালে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী চরমোনাই পীরের ভাই মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমকে হামলা করে রক্তাক্ত করা হয়েছে। ভোটে কারচুপি ও অনিয়মের আরও আলামত মিলেছে। বিএনপির তো এটাই চাই। এখন তারা যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বলতে পারবে– বলেছিলাম না, এই সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না! ভিসা নিষেধাজ্ঞার প্রবক্তা দেশের দূতাবাসও পেয়ে গেল নিষেধাজ্ঞার যৌক্তিকতা। আর আওয়ামী লীগ গাজীপুরে যা পায়নি, সেই জয় পেয়ে গেল খুলনা ও বরিশালে। এখন দলের কর্মীরা বলতে পারবেন, আমরাই বিজয়ী।

ইসলামী আন্দোলন আগামী সব নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। ফলে সিলেট ও রাজশাহীর মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দূরে থাক, কিছুটা প্রতিযোগিতা করার মতো প্রার্থীও রইল না। দিনশেষে হাওয়াটা বিএনপির পক্ষেই গেল।
তাহলে গাজীপুরে কী হলো? সেখানে তো আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিপক্ষে জিতে গেলেন আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের মা। এককথায় এর উত্তর– এটা তো আমরা আর আমাদের মামুদের ব্যাপার। এক লোককে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনাদের গ্রামে ভালো কে? সে বলল, আমরা আর আমাদের মামুরা। আর খারাপ? সে-ও আমরা আর আমাদের মামুরা। গাজীপুরে সেটিই হয়েছে। তা ছাড়া সিটি নির্বাচনের গোড়াতেই বড় গলদ হয়তো দেখাতে চাননি সরকারের রাজনৈতিক কৌশলীরা। তাই জাহাঙ্গীরের মা জিততে পেরেছেন।

এখানেই প্রশ্ন জাগে, আসল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে কার সঙ্গে কার? স্বাভাবিক গণতন্ত্রে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। প্রতিযোগিতা হয় বিরোধী দলগুলোর মধ্যে– কে কার চাইতে বেশি ভোট পাবে। কিন্তু বিশেষ রকমের গণতন্ত্রে, যেমন চীন বা উত্তর কোরিয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। সেখানে একই দলের বিভিন্ন ফ্র্যাকশন বা উপদলের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। গাজীপুর থেকে খুলনা-বরিশালে যা হয়েছে, তা একই পক্ষের মধ্যকার প্রতিযোগিতা।

ইসলামী আন্দোলন বা জাতীয় পার্টি প্রার্থী দিলেই সেটিকে বহুদলীয় নির্বাচন বলা যায় না। জাতীয় পার্টি গত মেয়াদে সরকারের জোটসঙ্গী ছিল। দলটির মহাসচিব জি এম কাদের পর্যন্ত বলেছেন, জনগণ তাঁদের সরকারের ‘দালাল’ বলে থাকে।

ঘটে যাওয়া সিটি নির্বাচনগুলোর ফল দেখলেও বোঝা যায়, এটি ‘আমরা আর আমাদের মামুদের খেলা’। আওয়ামী লীগের জয় নিশ্চিতের বাইরে যেটি হয়েছে, সেটি হলো জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় ইসলামী আন্দোলন এগিয়ে থাকায় অন্তত ভোট গুনে বলা যাবে, বিএনপি কোন ছার; দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল হলো ইসলামী আন্দোলন।

ক’দিন আগে রাজধানীতে জামায়াতে ইসলামীর বড় জনসভা হয়ে গেল। গত ১০ বছরে যাঁরা পারিবারিক জমায়েত থেকেও আটক হচ্ছিলেন, তাঁরা সারা ঢাকা থেকে মিছিল নিয়ে রাজধানীর বুকে সরকারের বিরুদ্ধে কড়া বক্তব্য দিলেন! এর পর সিটি নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের দ্বিতীয় স্থান অর্জন এবং হামলার জবাবে পরের ভোটগুলি বর্জন কী ইঙ্গিত দেয়? এ থেকে অনেকেই দুয়ে দুয়ে চার মেলাবেন– সরকার বোঝাতে চাইছে: ১. দেশে মতপ্রকাশ ও রাজনীতি করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে; এমনকি ইসলামীরাও অবাধে কর্মসূচি পালন করতে পারে; ২. আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ আসলে বিএনপি না; ইসলামপন্থি ও মুসলমানবাদী দলেরা; যেমন হেফাজত, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ইত্যাদি। ৩. অতএব, ধর্মীয় রক্ষণশীলদের (বিদেশিদের চোখে মৌলবাদী) উত্থান ঠেকাতে আওয়ামী লীগের কোনোই বিকল্প নাই!

ভোট বর্জন করে ইসলামী আন্দোলন কি বাকি ইসলামী দল যেমন জামায়াতে ইসলামী এবং মুসলিম ভাবাবেগের পাওয়ার হাউস হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে যাবে? যেতেও পারে। যেহেতু বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির পক্ষে জামায়াত দূরের কথা, নরমপন্থি কোনো ইসলামী দলের সঙ্গেও জোট করা আত্মঘাতী হবে, সেহেতু এই ইসলামী জোটই কি বিএনপির জায়গায় প্রধান বিরোধী জোট হিসেবে রাজনীতির খেলায় নামবে? সেটি হলে ক্ষমতাসীনদের মস্ত সুবিধা হয়। যে দেশে বড় বৃক্ষ নেই, সেখানে খেজুর গাছকেই মহিরুহ মনে হতে পারে। কিন্তু রাজনীতির ফাঁকা মাঠে যাদের বড় মনে হচ্ছে; বড় জনসমর্থনপুষ্ট দলের আন্দোলন শুরু হলে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে সেসব সাজানো ও পালিত বিরোধীদের। তখন হয় তারা সরকারের বি টিমের ভূমিকা পালন করবে, নয়তো স্বতন্ত্রভাবে হলেও বিএনপির দাবি সমর্থনে বাধ্য হবে। সরকারের কৌশল তখন বুমেরাং হয়ে যেতে পারে। সিটি নির্বাচনের মৌসুম কোরবানির ঈদের আগেই শেষ হয়ে যাবে। তার পর রাজনীতিতে থাকবে একমাত্র একটি প্রশ্ন– আগামী জাতীয় নির্বাচন কোন পথে হবে, কার ছকে হবে। বিএনপি তার দলীয় ঐক্যের প্রমাণ রেখেছে সিটি নির্বাচনে। দলটির হেভিওয়েট আঞ্চলিক নেতা সিলেটের বর্তমান মেয়র আরিফুল হক দলের সিদ্ধান্ত মেনে প্রার্থী হননি। অন্য বিভাগেও একই অবস্থা।

 

বিপরীতে গাজীপুর থেকে বরিশাল পর্যন্ত দেখা গেল ক্ষমতাসীনদের বিভক্তি। নির্বাচন এলেই দলটি আঞ্চলিক পর্যায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এমনকি সংলাপ ইস্যুতেও একেক নেতা একেক রকম বয়ান দিয়েছেন। দলের ভেতরের গভীর কলহ নিয়ে নির্বাচন কিংবা বিরোধীদের আন্দোলন মোকাবিলা করা কতটুকু সম্ভব? জ্ঞানীরা একটি কথা বলেন– শক্তিশালী প্রতিপক্ষ তোমাকেও শক্তিশালী করবে; দুর্বল প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেললে তুমিও দুর্বল হবে। আওয়ামী লীগই ঠিক করবে তারা সাজানো ও বানানোদের নিয়ে পাতানো খেলা খেলবে, নাকি সত্যিকার খেলায় নেমে নিজেদের সেরাটা হাজির করবে। কেননা, অতীতে যে মন্ত্র পড়ে নদী পার হওয়া গেছে, সেই একই মন্ত্র আবার কাজ নাও করতে পারে।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক এবং সমকালের পরিকল্পনা
সম্পাদক ও সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান
[email protected]

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে