রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সহযাত্রী

প্রকাশিত: জুন ২১, ২০২৩; সময়: ৮:৫০ পূর্বাহ্ণ |
খবর > মতামত
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সহযাত্রী

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : পিতৃদত্ত নাম মুহম্মদ শহিদুল্লাহ কিন্তু বাংলা কবিতায় তিনি পাঠকনন্দিত হয়েছেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ নামে।‘রুদ্রকবি’ অভিধায় তিনি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম আমাদের কবিতার ভুবনে। কাব্যচর্চার সূচনায় গল্প ও কবিতার বিভেদ ঘুচিয়ে একধরনের নতুন রচনা উপহার দিতে চেয়েছেন রুদ্র।

আধুনিক কবিতার তথাকথিত দুর্বোধ্যতা হটিয়ে কবিতাকে লোকপ্রিয় করতে চেয়েছেন তিনি। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জন্ম নেওয়া অকালপ্রয়াত কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ দ্রোহ ও প্রেমের অনুপম কাব্যভাষা নির্মাণে বাঙালি কবিদের মধ্যে উজ্জ্বলতম। সমকালের সংগ্রাম ও দ্বন্দ্বকে আত্মস্থ করে নিজের কবিতায় তিনি তুলে এনেছেন দেশ ও জাতির স্পন্দন। মাটি ও মানুষের কথকতা কিংবা মানবিকতা ও নান্দনিকতার মিশেলে অনন্য হয়ে ওঠে রুদ্রের শিল্পভুবন।

বাগেরহাট জেলার মোংলার মিঠেখালিতে জন্ম নেওয়া রুদ্র সত্তরের ব্যতিক্রমী কণ্ঠস্বর। নিজেকে ‘শব্দশ্রমিক’ হিসেবে ঘোষণা করা এই কবি কবিতার ক্ষেত্রে নিবিড় নিরীক্ষাপ্রিয়। ব্যক্তিজীবনে উচ্ছন্নতা কিংবা বোহেমিয়াপনা থাকলেও কবিতার প্রতি তিনি ছিলেন প্রগাঢ় নিষ্ঠাবান।

শিল্পসম্মত জীবনায়নের সমান্তরালে এক সুষম সমাজবিন্যাসের চিরস্বাপ্নিক ছিলেন রুদ্র। রাজনৈতিক উচ্চকণ্ঠ, উদ্দাম আবেগ এবং সংস্কারমুক্ত জীবনাবেগ প্রথম থেকেই পাঠকমহলের কাছে সমাদৃত করে তোলে রুদ্রকে। তার কবিতার কেন্দ্রে ছিল স্বদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, গণ-আন্দোলন, অসাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি। অসংকোচ প্রকাশের দুঃসাহস রুদ্রের কবিতাকে পাঠকপ্রিয় করে তোলে ব্যাপকভাবে।

জাতির শেকড়সন্ধানী এই কবি নিজেকে তুলে ধরেছেন অনার্যপুত্ররূপে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অকুতোভয় চারণকবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। কবির জীবদ্দশায় প্রকাশ পায় মাত্র সাতটি কাব্যগ্রন্থ। অথচ মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে এক বৈচিত্র্যময় সমৃদ্ধ কাব্যসম্ভার।

বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জন্ম নেওয়া অকালপ্রয়াত কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ দ্রোহ ও প্রেমের অনুপম কাব্যভাষা নির্মাণে বাঙালি কবিদের মধ্যে উজ্জ্বলতম।

কবিতা, গান, গল্প, প্রবন্ধ, কাব্যনাট্য, সম্পাদকীয়, সাক্ষাৎকার, চিত্রনাট্য, চলচ্চিত্রকাহিনি, পত্রগুচ্ছ ইত্যাদি মিলিয়ে দু’খণ্ডে প্রকাশিত তার রচনাবলি। রুদ্রের বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীলতারই পরিচয় বহন করে এই রচনাবলি।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কাব্যলোককে দ্যুতিময় করে তুলেছে যেসব কাব্যগ্রন্থ তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—‘উপদ্রুত উপকূল (১৯৭৯)’, ‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম (১৯৮১)’, ‘মানুষের মানচিত্র (১৯৮৬)’, ‘ছোবল (১৯৮৬)’, ‘দিয়েছিলে সকল আকাশ (১৯৮৮)’, ‘মৌলিক মুখোশ (১৯৯০)’ প্রভৃতি।

‘উপদ্রুত উপকূল (১৯৭৯)’ দিয়ে রুদ্রের কাব্যযাত্রার সূচনা। তারপর সারাজীবন কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক প্রত্যয় ও বিশ্বাসের প্রতি অবিচল ছিলেন কবি। এরমধ্যে অন্যতম হলো তার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং স্বদেশ-সমাজের প্রতি গভীর ভালোবাসা। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উত্থান এবং সামাজিক বৈষম্যের ব্যাপকতায় ক্ষুব্ধ কবি লিখলেন—

জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন

বাতাসে লাশের গন্ধ—

নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দোলে মাংসের তুফান।

মাটিতে রক্তের দাগ-

চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়। (বাতাসে লাশের গন্ধ)

রুদ্র বাংলাদেশের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতার মূল্য জানেন বলেই এই সামাজিক বৈষম্যকে মেনে নিতে পারেন না। ফলে একই কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেন অসামান্য কিছু অনুভব—

রক্তের কাফনে মোড়া—কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে,

সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা।

স্বাধীনতা—সে আমার স্বজন হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন,

স্বাধীনতা—সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।

ধর্ষিতা বোনের শাড়ি ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।

এদেশের কোমল সোঁদা মাটি থেকে জন্ম নেওয়া কবি মানসদৃষ্টিতে প্রথমাবধি প্রতিবাদধর্মী। সামাজিক ন্যায়ের প্রতি ব্যক্তিগত সততার সম্মিলনে রুদ্র সৃষ্টি করেন এক অনন্য বোধের জগৎ। ‘অবেলায় শঙ্খধ্বনি’ কাব্যের কবিতায় এই চেতনার বাক্সময় প্রকাশ অভিভূত করে পাঠকদের—

অতোটা হৃদয় প্রয়োজন নেই

কিছুটা শরীর কিছুটা মাংস মাধবীও চাই।

এতোটা গ্রহণ এতো প্রশংসা প্রয়োজন নেই,

কিছুটা আঘাত অবহেলা চাই প্রত্যাখ্যান।

তার কবিতার কেন্দ্রে ছিল স্বদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, গণ-আন্দোলন, অসাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি। অসংকোচ প্রকাশের দুঃসাহস রুদ্রের কবিতাকে পাঠকপ্রিয় করে তোলে ব্যাপকভাবে।

অনাহার ও বৈষম্যক্লিষ্ট সমাজে ব্যক্তির প্রেমারতি কোনো মূল্য বহন করে না। কাব্যচর্চার শুরুতেই এই উপলব্ধিতে পৌঁছেছিলেন কবি। ফলে পরাভূত প্রেমের একাকীত্ব থেকে কবি সন্ধান করেছেন আত্ম-উত্তরণ। অস্তিত্বের সাধনাই কবির চোখে প্রকৃত সত্য হিসেবে ধরা পড়েছে—

বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এইতো জীবন

এইতো মাধুরী, এইতো অধর ছুঁয়েছে সুখের সুতনু সুনীল রাত।

তুমি জানো নাই—আমি তো জানি। (অভিমানের খেয়া)

নজরুল-সুকান্তের মতোই রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ রাজনীতির পাঠকে শিল্পের সার্থক অবয়বে অঙ্গীকৃত করতে সক্ষম
হয়েছেন। সমাজ ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিপুষ্ট না হলে কিংবা গভীর রাজনৈতিক অভিজ্ঞান ছাড়া রাজনীতি ও শিল্পের এই সমন্বয় সম্ভব নয়। রুদ্র এই শৈল্পিক-রাজনৈতিক অভিজ্ঞানে অসামান্য কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন—

বিপ্লবের স্বর শুনে মানুষেরা যে-ভাবে ঘুমায়

যে-ভাবে তোমার চোখে মিশে থাকে বেদনার লাভা

বিস্ফোরণ বুকে নিয়ে আমিও তেমনি আছি।

আমার নিকটে রাখো, বুকে রাখো শীতার্ত স্বদেশ-

প্রয়োজন ছাড়া আমি জ্বলি না কখনো। (নিরাপদ দেশলাই)

রুদ্র প্রবলভাবে জীবনবাদী কবি। নন্দনতত্ত্বের ঘেরাটোপে বন্দি কবিতাকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন, যেভাবে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন সেনাতন্ত্রকে। জীবনবিচ্ছিন্ন বুর্জোয়া শিল্পকলার প্রতি তিনি বীতরাগ, বিভ্রমের পরিবর্তে বস্তুসমগ্রতায় আস্থাশীল কবি।

ক্ষুধাপীড়িত স্বদেশে রোমান্টিক মায়াবী কবিতাচর্চাকে রুদ্র প্রতারণা বলে মনে করতেন। তাই নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান নিয়েও তার নিজস্ব জীবনালোকন প্রকাশ পেয়েছে। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ মানুষের জীবনযাপনের প্রাত্যহিক ছকে বিন্যাস করেই তার কাব্যচর্চা করে গেছেন। রুদ্রের কবিতা তাই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সহযাত্রী, রুদ্রের কবিতায় দেখা যায় চিরচেনা মানুষের মুখ।

ড. চঞ্চল কুমার বোস ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে