শেখ ফজিলাতুন্নেছা : বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে এক নিভৃত সৈনিক
মোস্তাফিজুর রহমান বাবু : শত ত্যাগ স্বীকার করে দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্তি দিয়ে বিশে^ গৌরবজনক স্থানে নিয়ে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এ কথা সকলে জানে।
কিন্তু সেই সংগ্রামী জীবনের সার্বক্ষণিক ছায়া হয়ে যিনি ছিলেন, স্বামীর যোগ্য সঙ্গী হয়ে যিনি তাঁর মুক্তিসংগ্রামের উৎসাহ, প্রেরণা ও শক্তি-সাহস যুগিয়েছিলেন, সেই নিভৃত সৈনিক শেখ ফজিলাতুন্নেছার অবদান কতজন অনুভব করতে পারে? যিনি প্রজ্ঞা, ধৈর্য্য, সাহসিকতা, মায়া মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে পালন করেছেন জীবনের সকল দায়িত্ব।
পাশাপাশি রাজনীতিবিদ না হয়েও দেশের দুঃসময়ে জনগণকে আগলে রেখেছেন নিজের মেধাও বিচক্ষণতা দিয়ে । যার জন্য সকলের কাছে তিনি বঙ্গমাতা হিসাবে সমাদৃত।
শাসক গোষ্ঠীর রক্ত চক্ষু, মাথার ওপর জেলের ভয়, প্রাণ নিয়ে শঙ্কা, তবুও দৃঢ় পাহাড়ের মত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মুক্তিসংগ্রামের শক্তিদায়ক হিসেবে। বুকে পাথর চেপে নীরবে সহ্য করেছেন বর্ণনাতীত কষ্ট।
বঙ্গবন্ধু নিজেই তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে সে কথা লিখেছেন, ‘সে তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে।’
আজ বাংলার মুক্তিসংগ্রামে নেপথ্যে নিভৃত নায়কের জন্মদিনে সেই ত্যাগী মহীয়সী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রতি শতকোটি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
শেখ ফজিলাতুন্নেছার জন্ম ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ জহুরুল হক ও হোসনে আরার ঘরে। ডাক নাম ছিলো রেণু। বাইগার নদীর পাড়ে হেসে খেলেই দিন পার হচ্ছিলো শিশু রেণুর। কিন্তু বয়স পাঁচ হতে না হতেই পিতামাতাকে হারালেন জনম দুঃখী রেণু।
কিন্তু কে জানতো এই দুঃখ তাকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে? চিরসাথী প্রিয় স্বামীকে বাংলার দুঃখী জনতার সংগ্রাম করতে হবে? ৭৫’র ১৫ আগস্টের কালো রাতে চোখের সামনে একে একে প্রিয় স্বামী, সন্তানদের নিহত হতে হবে? বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামে শত ত্যাগ করার প্রতিদান হিসেবে নিজেকেও প্রাণ দিয়ে দিতে হবে?
রেণুর বয়স যখন তিন বছর, পরিবারের বড়রা চাচাতো ভাই ১৩ বছর বয়সী শেখ মুজিবের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে। পাঁচ বছর পর ৮ বছর বয়সে ১৯৩৮ সালে বঙ্গবন্ধুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সেই থেকে আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর জীবনে এক ছায়াসঙ্গী হিসেবেই ছিলেন।
একে একে তাঁদের কোল জুড়ে আলো হয়ে আসে আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর সহদোর- শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা ও আদরের শেখ রাসেল।
কিন্তু আর দশটা বাঙালি নারীর মত সহজ সংসার জীবন হয় নি তার। বিয়ে হয়েছে যার সঙ্গে তাঁর ধ্যান জ্ঞানে বাঙালি জাতির মুক্তির নেশা। বিয়ে হবার পরই ঠিকই বুঝেছিলেন কিশোরী রেণু। এতে আর দশটা নারীর মত তীব্র অভিমান করে বঙ্গবন্ধুকে সংসারে মনযোগ দিতে বেঁকে বসার কথা।
কিন্তু তিনি তা করেন নি। স্বামীর আজীবন লালিত স্বপ্নের পথে বাঁধা না হয়ে হয়ে উঠেছিলেন যোগ্য পথচলার সঙ্গী। দু দিন পর পর গ্রেফতার হচ্ছেন স্বামী, বাড়িতে ছোট ছোট বাচ্চা-সংসার! দুশ্চিন্তায় কত শত বিনিদ্র রাত কেটেছে তাঁর! তবুও স্বামীকে নীরবে উৎসাহ যুগিয়েছেন।
এক হাতে সংসার সামলে স্বামীকে সংসার থেকে নির্ভার করে জাতির জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন! এত বড় ত্যাগ কি আর কোনো নারী করতে পারে?
পড়ালেখা খুব বেশি না করলেও প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা। গান ও বই পড়ার প্রতি গভীর টান ছিলো তাঁর।
ছিলেন মুক্তচিন্তার অধিকারী! তা না হলে এমনভাবে স্বামীকে জাতির মুক্তিসংগ্রামের জন্য উৎসর্গ করে দিতে পারতেন কি কেউ? শেখ মুজিব স্ত্রীর এমন প্রজ্ঞা দেখে মুগ্ধ ও বিমোহিত ছিলেন।
যোগ্য ও বিশ্বস্ত সহকর্মীর মতই দেখেছেন স্ত্রীকে। সহযোদ্ধা ফজিলাতুন্নেছার কাছে রাজনৈতিক সকল বিষয়ে আলাপ করতেন বঙ্গবন্ধু। পরামর্শও নিতেন তাঁর কাছ থেকে।
মাসের পর মাস জেলবন্দী বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে পরিবার ও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, শ্বশুর-শাশুড়ির দেখভালসহ রাজনৈতিক সংকট সামলাতেন তিনি সুনিপুণভাবে। বঙ্গবন্ধু জেলে থাকাকালে তাঁর সহযোদ্ধারা এসে তাঁর কাছে বুদ্ধি পরামর্শও করতেন। তাঁর বাড়ি ছিলো রীতিমত উন্মুক্ত হোটেল।
সারাদেশ থেকে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মী ও বঙ্গবন্ধুর শুভানুধ্যায়ীরা ছুটে আসতেন তাঁর বাড়িতে। আর শেখ ফজিলাতুন্নেছা সবাইকে নিজের আত্মীয়র মত করে আপ্যায়ন করেছেন, ফুফুর বাড়িতে গেলে যেমন ফুফু তাঁর প্রিয় ভাতিজাকে সমাদর করে!
বঙ্গবন্ধু নামে মাত্র পরিবার প্রধান ছিলেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় তো তিনি রাজনৈতিক কর্মসূচি, রাজপথ, সভা-সমাবেশ ও জেলে কাটিয়েছেন। কিন্তু শেখ পরিবারের আসল কর্তা ছিলেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা। পাখি যেমন তাঁর ছানা ও নিজের ছোট্টবাসাটিকে আগলে রাখে, সেভাবে পরিবারটিকে পরম মমতায় আগলে রেখেছিলেন ফজিলাতুন্নেছা।
তিনি ছিলেন অনুসরণীয় মা। বাবা বেশির ভাগ সময় জেলে থাকলেও সেই অভাবটি মায়ের পর মমতায় বুঝতেই পারেননি শেখ হাসিনারা। ফজিলাতুন্নেছার মধ্যে যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিকে সামালে নেয়ার মতো বুদ্ধিমত্তা, অসীম ধৈর্য্য ও সাহস দিয়ে মোকাবেলা করার শক্তি ছোট বেলা থেকেই ছিলো।
তিনি সেই গুণাবলী একে একে সঞ্চার করেছেন নিজের সন্তানদের মধ্যে! তাদের শিখিয়েছেন দেশের কাছে ব্যক্তি জীবনের চাওয়া পাওয়া সব কিছু তুচ্ছ। তাই তো আজ আমরা শত ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্যেও কিভাবে মানুষের জন্য কাজ করে যেতে হয় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাই প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নিরলস পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে। শেখ হাসিনা যেন শেখ ফজিলাতুন্নেছারই প্রতিমূর্তি!
শেখ রেহানার লিখনিতে মায়ের গুণাবলীর একটা দৃষ্টান্ত আমরা পাই। মায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শেখ রেহানা লিখেছেন- “গ্রামে জন্ম হওয়া একজন সাধারণ নারী আমার মা, ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়েছেন মিশনারি স্কুলে।
কিন্তু কী যে প্রজ্ঞা, কী যে তার ধৈর্য্য। আমার মায়ের কাছে আমাদের যে জিনিসটা সবার আগে শেখা উচিত, তা হলো ধৈর্য্য আর সাহস। সবাইকে এক করে রাখা।
এতগুলো লোক বাড়িতে খাচ্ছে, দাচ্ছে, আমাদের গ্রামে কোন মেয়ে ম্যাট্রিক পাস করেছে, তাকে এনে ঢাকায় কলেজে ভর্তি করে দাও, কাকে বিয়ে দিতে হবে! সব সামলাচ্ছেন। এর মধ্যে আমাদের সকালে কোরআন শরিফ পড়া শেখাতে মৌলভি সাহেব আসছেন, তারপর নাচ শিখছি, সেতার শিখছি, বেহালা শিখছি- সব কিন্তু মায়ের সিদ্ধান্ত।
কিন্তু তার নিজের বয়স কত! আমার তো মনে হয়, আমার মা কি কোনো দিন তাঁর শৈশবে কিংবা কৈশোরে একটা ফিতা বা রঙিন চুড়ি চেয়েছেন কারও কাছে! মা-ই তো সব থেকে বঞ্চিত ছিলেন। অথচ তিনি হাসিমুখে সব সামলাচ্ছেন।”
স্বামীর প্রতি ছিলো ফজিলাতুন্নেছার অগাধ ভালোবাসা, সে কথা বলাবাহুল্য। সে ভালোবাসা যেন অনন্য। আর দশটা নারীর মত স্বামীকে আটকে রেখে ভালোবাসা নয়, বরং দেশের জন্য স্বামীকে কাজ করতে ত্যাগ করার মাধ্যমে এক অনন্য ভালোবাসার নজীর সৃষ্টি করেছিলেন।
সত্যি! এমন মহিয়সী নারী পৃথিবীর ইতিহাসেই বিরল! তবে বঙ্গবন্ধুর জেল জীবন নিয়ে তিনি খুব দুশ্চিন্তায় থাকতেন। একবার একটানা ১৭/১৮ মাস জেলে থাকায় বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্য বেশ খারাপ হয়ে যায়। যা দেখে ফজিলাতুন্নেসা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন।
তিনি স্বামীকে ডেকে বলেন, ‘জেলে থাকো আপত্তি নেই। তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখো। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেনৃ তোমার কিছু হলে বাঁচব কি করে?’ আহা! কী গভীর ভালোবাসা। এমন গভীর ভালোবাসার বোধ, গল্প-উপন্যাসের আবেগকেও যেন হার মানায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৫ মার্চের উত্তাল সময়ে স্বামীকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল হানাদারেরা। প্রবল দুশ্চিন্তায় দিন কাটছিলো তাঁর। কি করবেন দিশা পাচ্ছিলেন না। এদিকে পাখির মত গুলি করে ঢাকায় মানুষ হত্যা করছিলো হায়েনারা। চারদিকে চরম আতঙ্ক আর ভয়।
এরই মধ্যে একা এক চরম দুঃসাহসিক নাবিকের মত প্রবল ঝড়ে যেন নৌকো নিয়ে প্রমত্ত সমুদ্রে শক্ত করে হাল ধরে ছিলেন। অকুতোভয় এই মহীয়সী দেশ ছাড়েননি। পরিবারের অন্যদের পরম মমতায় আগলে রেখে ঢাকার মগ বাজারের একটি বাড়িতে ছিলেন।
সবাই ভয় পেলেও নিজে শান্ত থেকে অন্য সবাইকে ভরসা দিয়ে যাচ্ছিলেন। ১২ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাঁকেও গ্রেফতার করে। তারপর ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। এসব গ্রেপ্তার ও বন্দী দশায় আজীবন সংগ্রামী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা ডরান না।
বিয়ের পরেই যে তাঁর সব স্বপ্ন-আশা-আকাক্সক্ষা জাতীর প্রতি উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন, তার আবার ভয় কিসের! ফজিলাতুন্নেছার এই ত্যাগ, স্বামীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা।
এমন মহিয়সী নারীকেই ৭৫’র কুলাঙ্গারেরা নিমর্মভাবে হত্য করলো। শুধু তাই নয়, চোখের সামনে প্রিয় স্বামী-সন্তান ও পরিবারের অন্য সদস্যদেরও নির্মমভাবে হত্যার নিষ্ঠুর দৃশ্যটা দেখতে হলো! এমন ট্রাজিডি পৃথিবীর ইতিহাসেই নজীরবিহীন।
যে পিতৃমাতৃহীন কিশোরীটি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গীনি হয়ে উঠলেন, একটা জাতিকে মুক্তি দিতে ছায়া সৈনিক হলেন, শত-ত্যাগ তিতিক্ষার পরও প্রিয়তম স্বামীর প্রতি ছিলেন অগাধ ভালোবাসার আধার, ৭৫’র ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমেই সেই গৌরবময় জীবনের অবসান হলো। ওই ১৫ আগস্টেই বৃন্ত থেকে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা নামের দুটো ফুল আলাদা হলো।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা আজ আমাদের মধ্যে নেই বটে, কিন্তু তাঁর অবদান এখনও রয়েছে। তাঁর পুরো জীবনটাই একটা আদর্শ জীবন। নারীকে জাগরনের যে মন্ত্র বেগম রোকেয়া শিখিয়ে ছিলেন, তা যেন ফজিলাতুন্নেছা বহন করে নিজের সন্তান শেখ হাসিনার মধ্যেই সম্পূর্ণ করেছেন।
তাই আজ প্রতিটি বাঙালি নারীর জন্য বেগম রোকেয়ার মতই শেখ ফজিলাতুন্নেছা আদর্শ হয়েই থাকবেন। জন্মদিনে তাঁর প্রতি আকুণ্ঠ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।
লেখক : মোস্তাফিজুর রহমান বাবু
গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ