প্রাণঘাতী মহামারির অপেক্ষায় দিন গুনছে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: আগস্ট ১০, ২০২৩; সময়: ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ |
খবর > মতামত
প্রাণঘাতী মহামারির অপেক্ষায় দিন গুনছে বাংলাদেশ

ড. আবুল হাসনাত মোহাঃ শামীম : বেশিরভাগ দৈনিক পত্রিকা ও গণমাধ্যম থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞরা বহু আগে থেকে সতর্ক করেছেন ‘এবার ডেঙ্গু ভয়ানক রূপ নিতে পারে’। এমনকি খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকেও জানানো হয়েছিল এবার ঢাকার ৯৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৫টিই ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। পাশাপাশি ডেঙ্গুর মৌসুম গত বছরের মতো দীর্ঘ হওয়ার শঙ্কার কথাও জানানো হয়েছিল।

বিষয়গুলোকে সত্য প্রমাণ করে রাজধানীসহ সারাদেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। এবারের ভয়ানক বিষয় হচ্ছে শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটেছে পুরো দেশে।

বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল ২০১৯ সালে। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাক-বর্ষা জরিপ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, এবারের পরিস্থিতি ২০১৯ সালের চেয়েও কয়েকগুণ খারাপ হতে পারে। বিশেষত, গত পাঁচ বছরের মধ্যে এবার এডিস মশার ঘনত্ব এবং সম্ভাব্য প্রজননস্থলের সংখ্যা সর্বোচ্চ হয়ে গেছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে দেখা যাচ্ছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৫টিই ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। পক্ষান্তরে ২০১৯ সালে উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ওয়ার্ডের সংখ্যা ছিল ২১টি।

২০১৯ সালের পর দেখতে দেখতে পার হয়েছে আরও চার বছর। এই দীর্ঘদিনের পথ পরিক্রমায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের উচিত ছিল যেভাবেই হোক মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংসে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কিন্ত সিটি করপোরেশন লোক দেখানো নানা কর্মকাণ্ডে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ায় এই কাজ পুরোপুরি আড়ালে থেকে যায়। ফলে মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস দূরে থাক আরও বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। আর এজন্যই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, প্রাক-বর্ষা জরিপ অনুযায়ী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সব এলাকাতেই ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার উপস্থিতি বেশি।

ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেলসহ আরও নানা অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি অনেক অপরিকল্পিত সব স্থাপনা নির্মাণ করতে গিয়ে সেখানে আবদ্ধ পানির আধার তৈরি করা হয়েছে। চলতি বর্ষা মৌসুমের প্রথম বৃষ্টিপাত থেকেই এইসব স্বচ্ছ পানির আধারগুলো হয়ে উঠেছে এডিস মশার স্বর্গরাজ্য। তারা অপরিকল্পিত উন্নয়নের নামে নির্মিত ইতস্তত অবকাঠামোগুলোতে সৃষ্টি হওয়া জলাধারে নির্বিঘ্নে বেড়ে উঠছে। তাই বিগত যেকোনো বছরের তুলনায় এবারের এডিস মশার সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ।

গত ৮ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত ৭ আগস্ট সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে ৩৪০ জনের মৃত্যু হলো। এ সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৭৪২ জন। যার মধ্যে ঢাকায় ১ হাজার ২ জন এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ৭৪০ জন। সূত্রটি আরও বলছে, চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৭২ হাজার ২২৫ জন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৩৭ হাজার ৭২২ জন এবং ঢাকার বাইরে ৩৪ হাজার ৫০৩ জন। এই তথ্যসূত্র ও সংবাদ পর্যালোচনা করতে গেলে দেখা যায় পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে বছরের প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গু আর কখনো এমন ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারেনি। এমনকি ডেঙ্গুর ভয়াবহতম বছর সেই ২০১৯ সালেও প্রথম ছয় মাসে মারা গিয়েছিলেন মাত্র ৮ জন। এর বিপরীতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২ হাজার ২০৮ জন। অন্তত এই পরিসংখ্যান আমলে নিলে ২০২৩ সালের ডেঙ্গু এক ভয়াবহ মহামারি হিসেবে চোখ রাঙাচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মোট ৯৮টি ওয়ার্ডের ৩ হাজার ১৪৯টি বাড়িতে যে জরিপ পরিচালনা করা হয়েছিল তার হাউস ইনডেক্স এবং ব্রুটো ইনডেক্স দুইটাতেই ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে।

প্রসঙ্গত, বলে রাখা ভালো এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচককে বলা হয় ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ আর কতগুলো বাড়িতে এডিস মশার উপস্থিতি রয়েছে তা পরিমাপ করা হয় হাউস ইনডেক্স দিয়ে।

বিভিন্ন সংবাদ থেকে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৪০টি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৫৮টি ওয়ার্ডে মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন জরিপকারীরা। দুই সিটি করপোরেশনের এসব ওয়ার্ডের ৩ হাজার ১৪৯টি বাড়ি পরিদর্শন করে ৫৪৯টি বাড়িতেই এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। ডিএনসিসির ২৭১ এবং ডিএসসিসির ২৭৮টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। সে হিসেবে ঢাকা উত্তর সিটির মগবাজার, আদাবর, মোহাম্মদপুর, মণিপুর ও উত্তর বাড্ডা এলাকায় মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে দক্ষিণ সিটির নবাবপুর, ডিস্টিলারি রোড, আজিমপুর, হাজারীবাগ, কাঁঠালবাগান ও সায়েন্স ল্যাব এলাকায় মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। বিষয়টি একটু গুরুত্বসহকারে দেখলে ঢাকার কোনো এলাকাই এখন এডিস সংক্রমণ থেকে নিরাপদ নেই।

বিগত বছরগুলোতে কোনো ওয়ার্ডের হাউস ইনডেক্স ১০-এর বেশি হলেই তাকে উদ্বেগজনক ধরা হয়েছিল। এবার ৯৮টি ওয়ার্ডের ৮০টি ওয়ার্ডেই হাউস ইনডেক্স ১০-এর বেশি পাওয়া গেছে। গত বছর হাউস ইনডেক্স ১০-এর বেশি ছিল ১৯টি ওয়ার্ডে। এখান থেকেই অনুমান করা যায় কতটা ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

অন্যদিকে জরিপের তথ্য অনুযায়ী, এবার বহুতল ভবনে (প্রায় ৪৪ শতাংশ) এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এরপর সবচেয়ে বেশি লার্ভা (প্রায় ৪০ শতাংশ) পাওয়া গেছে নির্মাণাধীন নানা অবকাঠামোতে। বিভিন্ন নির্মাণাধীন প্রকল্পের নানা স্থানে জামে থাকা পানি, ভেজা মেঝে, প্লাস্টিক ড্রাম ও পাত্র এবং ফুলের টবে লার্ভা বেশি পাওয়া গিয়েছিল। চলমান ডেঙ্গুর ভয়াবহতা সামনে আরও বড় হুমকি হয়ে আসছে তা এর থেকে নিশ্চিত করে বলা যায়।

চলতি বছরে ডেঙ্গুর এই চলমান ভয়াবহতার দায় পুরোপুরি দুই সিটি করপোরেশনের ওপর বর্তায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কয়েক মাস আগে এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক করেছিল। তাদের অভিযোগের পরেও মশক নিধনে ঢাকার দুই সিটি যথাযথ উদ্যোগ নেয়নি। এমনকি ঢাকা উত্তরের উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত তার মতামতে সুস্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘সিটি করপোরেশনের মশকনিধনে আমার কাজে আমি সন্তুষ্ট না। সিটি করপোরেশন জনসচেতনতা বাড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। ৮ থেকে ১৩ জুলাই বিশেষ অভিযান চালাবে সিটি করপোরেশন।’

সাধারণ কোনো ব্যক্তি নন খোদ ঢাকা উত্তরের উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার এমন বক্তব্য প্রমাণ করে দুই সিটি করপোরেশন মশক নিধন অভিযানে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন।

চলতি বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপের শঙ্কার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বিলম্বে হাসপাতালে ভর্তির কারণে মৃত্যু ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। পাশাপাশি সবার জন্য হাসপাতালগুলোতে স্থান সংকুলানও সম্ভব হচ্ছে না।

সামনের দিনগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ার বিপরীতে মৃত্যুর সংখ্যাও ভয়াবহরকম বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর গুরুত্ব না দেওয়ায় দেশের প্রায় সব জেলায় এডিস মশা ছড়িয়েছে। গত দুই দশকে জুলাই মাসের শেষে বা আগস্টের শুরু থেকে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এ বছর জুলাই মাসের শুরু থেকেই পরিস্থিতি যেভাবে খারাপের দিকে যাচ্ছে এর চূড়ান্ত অবস্থা কী হয় তা বলা কঠিন।

ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে সহজেই অনুমান করা যায় এডিস মশা এবং ডেঙ্গু এখন কেবলমাত্র ঢাকা মহানগরের সমস্যা নয়, এটি এখন সারা দেশের মানুষের সমস্যা। আগের কয়েক দশকের হিসেবে যেকোনো সময়ের চেয়ে বছরের প্রথম ছয় মাসে এবার আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। শুরু থেকেই মশক নিধনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে সামনের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে সংক্রমণ বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সবাই।

জ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। আর যারা মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসছে তাদেরও দীর্ঘদিন সংগ্রামের পরে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ হচ্ছে। মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাবসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ধুঁকতে থাকা মানুষগুলোর দুঃখ যাতনা শোনার কেউ নেই। তারপরেও যেন হিতাহিত জ্ঞান নেই কর্তৃপক্ষের। বাস্তবে করোনার চেয়ে ভয়াবহ রূপ নিলেও নির্বাচনের ডামাডলে হারিয়ে যাচ্ছে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা।

প্রতিদিন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক আর টিভি পর্দার শিরোনাম এখন ‘গণতন্ত্র ফেরানোর সংগ্রাম বনাম উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা ধরে রাখার সরকারি প্রচারণা’। শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘এত ছোট কথা অত বড় কানে পৌঁছায় না’। তেমনি ডেঙ্গুর খবর এতটাই ছোট, নির্বাচন আর আন্দোলন সংগ্রামের অত বড় খবরের ভিড়ে তার আর জায়গা হয় না।

একটি সক্রিয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে মেয়ররা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব লাভ করলে নিজের পদ ও জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা থাকে। প্রতিষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা স্বাধীনভাবে কাজ না করার ফলে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তার সামান্য একটি খণ্ডচিত্র হচ্ছে সিটি করপোরেশন।

তাদের নানা অনিয়ম ও দায়িত্বহীনতার মধ্যে ভয়াবহ একটি নজির হচ্ছে মশক নিধনে অনীহার বিপরীতে সীমাহীন ব্যর্থতা। কিন্ত ডেঙ্গু থেকে মুক্তি পেতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি মশকনিধনের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনগুলোর সক্রিয়তা আরও বৃদ্ধি করা।

অন্যদিকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় প্রচার-প্রচারণা জোরদার করা গেলে সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছু সচেতনতা তৈরি হতে পারে। কিন্ত সমালোচিত নির্বাচনের মাধ্যমে চেয়ারে বসা মেয়র এবং কাউন্সিলরা এ ব্যাপারে কতটা জনবান্ধব হবেন তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। ফলে বাংলাদেশ নতুন একটা ভয়াবহ মহামারির অপেক্ষায় দিন গুনছে এটা নিঃসন্দেহে বলাই যায়।

(লেখক: অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।)

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে