শোক শক্তি হয়েই ফিরেছে
এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন : শোক, দীপ্ত শপথের উচ্চারণেও ধ্বনিত হয়। গোষ্ঠীগত প্রতিজ্ঞায় মহান পূর্বসূরীর আদর্শকে সমুন্নত রাখার উদ্যোগেই আজকের বাংলাদেশ। আমরা আমাদের জাতির জনকের কোন কিছুকেই ভুলিনি। মনেপ্রাণে ধারণ করে গিয়েছি। বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জীবনের প্রতিটি ক্ষণে তাঁর পিতার সকল স্বপ্ন পূরণে দিবানিশি পরিশ্রম করে আজকের পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক হতে পেরেছেন।
তিনি একাই অসম একটি প্রচলিত রাজনৈতিক ধারা রুখে দিয়ে বলতে পেরেছেন যে, শোক অনেক সময় একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণেও শক্তি হয়ে ফিরে আসতেই পারে। শেখ হাসিনা সেটা করে দেখিয়েছেন। তাঁর সংগ্রামী পথচলায় প্রায় আড়াই যুগে কতজনাকে বিশ্বাসী সহকর্মী হিসাবে পেয়েছেন, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন রয়েছে।
বিশ্বাসী হওয়ার শর্ত পূরণ করা সহজ নয়। সবিশেষ যোগ্যতা লাগে। যোগ্যতা না বলে প্রতিশ্রুতি বলাই শ্রেয়। প্রথমত, নিজের সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হয়। শপথ নিয়ে ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠিগত আস্থার প্রতিদানে নিজেকে সঁপে দিতে হয়। দ্বিতীয়ত, কোন চিন্তা-ভাবনার, ঘটনার সাক্ষী থাকার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে বলতে হয়, হ্যাঁ, আমাকে বিশ্বাসী হিসাবে দেখতেই পারো।
রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাভাষ্য বলে, আদেশক্রমে অনুরোধের গোপনীয়তা রক্ষা করা এবং শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য রাখার অনুশীলনে ভর করে বহু জাতি রাজনৈতিক বন্ধনের প্রতিজ্ঞায় হিরো পেয়েছে। যেমনটি, এই প্রিয় বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালি জাতির সত্যিকারের হিরো। সঙ্গত কারণেই তিনি বাংলাদেশের জাতির পিতা হতে পেরেছিলেন। তাঁর ভাগ্যও ভাল ছিল। বিশ্বাসী নেতা হিসাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এএইচ এম কামারুজ্জামান কিংবা মনসুর আলীদের পেয়েছিলেন।
১৫ আগস্ট, ২০২৩, অযাচিত, অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত, ঐতিহ্যবিরুদ্ধ, গৌরববিরুদ্ধ ও পৈশাচিক কান্ড একটি অপশক্তি ঘটালো। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালিকে হত্যা করার ওই অপউদ্যোগের পেছনের শক্তিকে গোছালভাবে অবশ্য তুলে ধরা যায় নি। বিপথগামী সেনাকর্মকর্তাদের মাস্টারমাইন্ড পরবর্তীতে জোর করে দেশ দখলও করেছিল। খুব স্পষ্টভাবে ইতিহাসের সেই সত্যটি আমরা তুলে না ধরতে পেরে একরকম ব্যর্থই হয়ে যাচ্ছি।
বঙ্গবন্ধুকে অকালে হারানোর ক্ষত, প্রতিটি রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিকে ভাবায়, কাঁদায়। ওই মানুষটি বেঁচে থাকলে ১৯৮৫ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ আজকের সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়া পর্যায়ে চলে যেত। আমার বাবা ও চাচাতুল্য কামারুজ্জামান ও তাজউদ্দীনেরা তাঁর সাথে ওই বিশ্বাসী হয়ে থাকলেই সবকিছু ঠিকঠাক চলত। ২০০৮ সালে যদি রাজনৈতিক ধারাভাষ্য প্রদান করতে হত, তখন আমাকে বলতে হত যে, ৩৬ বছর বয়স হয়েও দেশ পিছিয়ে আছে বিশ বছরের মত। প্রকৃতিও যেন তাই জবাব দিয়ে গেল। আজ ২০২৩ সালে এসে দাঁড়িয়ে উচু স্বরে বলতে পারছি, ওই বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনার হাত ধরে গেল সাড়ে ১৪ বছরে পিছিয়ে থাকা কুড়ি বছরের রিকভারি করতে পারা গেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ফলত তাই সম্ভাবনাময় দেশ হয়ে সাড়ে ১৪ বছরে ৩৫ বছর এগিয়ে গিয়েছে।
জনপ্রিয়তা ও জনআস্থা অর্জন করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কার্যত সফলতা। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই রাজনৈতিক সত্তা, যার মধ্যকার দেশপ্রেম ও সততা অতি উচ্চ পর্যায়ের ছিল। পাশাপাশি আবেগ ছিল তাঁর মনের আবহে চোখ ও মুখে। এমনিতেই দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বক্তা হওয়ার গুনাবলি ছিলই … উপরন্ত, ঘটনা প্রবাহের সাথে তাল মিলিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা, তাঁকে অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে।
তবে নিজের সত্তায় থাকা প্রবল দূরদৃষ্টির সক্ষমতার ধর্মটি, তাঁর সাথে কাজ করতে থাকা নেতাকর্মীরা অতটা বুঝতে পারেনি। এখানেই রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত হওয়া আর না হওয়ার বোধের ঘাটতি। বঙ্গবন্ধুর অতি উচ্চতার জ্ঞান ও স্বাপ্নিকবোধ সম্যক ধারণা তাঁর সমসাময়িক অন্যজনেরা বুঝতে পারেনি। এই বুঝতে না পারার কথিত বুদ্ধিজীবি রাজনীতিকদের কেহ কেহ তাই দিনশেষে অবিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতাদের তাঁবুতে যেয়ে ফলত এক সামরিক অফিসারের উচ্চাভিলাসী অভিলাষের সড়কে পথিক হন। যাদের কেহ কেহ এখনো বেঁচে আছেন, কিন্তু তারা রাজনীতিক হতে পারেনি। আদর্শিক অবস্থান সম্পর্কে বাংলাদেশের ব্যাখাও তারা করতে পারেন নি। বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করতে হলেও নিদেনপক্ষে যে দুই যুগ সময় লাগে বা লাগবে, সে অব্দি অপেক্ষা করার প্রস্তুতি অনেকের ছিল না।
বিদেশি রাজনৈতিক অপশক্তি যখন দেখতে পেল, এই বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তাঁদের স্বার্থ অর্জিত হবে না…অন্যদিকে স্বাধীনতা পরবর্তী জাসদের মত দল গঠন করা, আওয়ামী লীগে অবিশ্বাসী নেতৃবৃন্দের ওপর আস্থা রাখা এবং একাত্তরের পরাজিত শক্তির নতুন প্রতীকী নেতা হিসাবে জিয়াউর রহমানের নেপথ্য ভুমিকা ও অপরাপর ঘটনাগুলোর প্রেক্ষাপট তৈরির মধ্য দিয়েই ১৫ আগস্ট, যা সারা দুনিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে জঘন্যতম ঘটনার একটি বলে অনুমিত হয়।
বলাবাহুল্য, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের নিজ বাসায় সপরিবারে নিহত হন। সেদিন তিনি ছাড়াও নিহত হন তার স্ত্রী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। এছাড়াও তাদের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনসহ নিহত হন আরো ১৬ জন। ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু পুত্র শেখ রাসেল; পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজী কামাল; ভাই শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণি। বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসেন কর্নেল জামিলউদ্দীন, তিনিও তখন নিহত হন। দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান শেখ হাসিনা ও তার ছোটবোন শেখ রেহানা।
বঙ্গবন্ধু একদিনে তৈরি হন নাই। তিনি খুব কাছ থেকে হোসেন সোহরাওয়ার্দী, শের-এ-বাংলা, মওলানা ভাসানীদেরকে দেখেছিলেন। তাঁদের আদেশগুলোকে ধারণ করতেন। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল বলেছিলেন, যে রাজনৈতিক সত্তা কোনদিন আদেশ মানতেই শেখেনি, সে কোনদিন নেতা হয়ে ভাল কোন আদেশ দিতেই পারবে না।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই নেতা যিনি ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে এক করতে পেরেছিলেন। অধিকার নিয়ে আদেশ দিতে পারতেন। মহান নেতা হিসাবে মানুষের মধ্যে থেকেই নেতৃত্ব দিতেন।ওয়রেন বেনিস বলেছিলেন, তিনিই নেতা, যিনি তাঁর চিন্তাগুলোকে বাস্তবে পরিণত করতে পারেন। বঙ্গবন্ধু হলেন সেই নেতা, যিনি সোনার বাংলাদেশ গড়ার নিমিত্তে ঝুঁকি নিতেন- নিয়েছিলেন, যে ঝুঁকির মাশুলে তাঁর প্রাণ চলে গেলেও সুগভীর বাস্তবতায় তাঁর মত নেতা বা রাষ্ট্রনায়ক এই বিশ্বে কয়জনা এসেছেন, এমন প্রশ্ন রাখার প্রেক্ষাপট উত্তীর্ণ হয়।
বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির ইতিহাসের আদ্যপান্তকে এক কথায় বলতে গেলে, ১৫ আগস্ট শুধুমাত্র বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বিয়োগের দিন নয়। একজন শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে আমরা অনেক আগেই উন্নত জাতি হিসাবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতাম। আমরা অসম্ভব পর্যায়ের মেধাবী শেখ কামালকেও হারিয়েছি। যা পূরণ হওয়ার নয়। ১৫ আগস্ট, আমাদেরকে অন্ধকার গন্তব্য নির্দেশ করলেও, এক অতি মানবিক সত্তা শেখ হাসিনায় আলোকিত পথের সন্ধানও ধরা দিয়েছে। যেখানে শোক ফলত শক্তি হয়েই প্রত্যাবর্তন করেছে… ইতিহাসের এমন দিকটি নিয়ে ধারাভাষ্য না দেয়াটাও অন্যায়।
লেখক : সভাপতিমন্ডলির সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, মেয়র, রাজশাহী সিটি করপোরেশন