ইউনূস ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি বাংলাদেশের আত্মমর্যাদায় আঘাত

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩, ২০২৩; সময়: ১২:১৩ পূর্বাহ্ণ |
ইউনূস ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি বাংলাদেশের আত্মমর্যাদায় আঘাত

সৈয়দ বদরুল আহসান : শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘন ও দুর্নীতির মামলা নিয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন বিশ্বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্বস্থানীয় ১৭৭ জন ব্যক্তি। তাদের মধ্যে শতাধিক নোবেল বিজয়ীও রয়েছেন। চলমান মামলার বিরুদ্ধে একজন ব্যক্তিকে নিয়ে এ ধরনের চিঠিকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের আত্মমর্যাদায় আঘাত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

চিঠিতে তারা লিখেছেন, ‘সম্প্রতি বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি যে হুমকি দেখা গেছে, তা নিয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা বিশ্বাস করি, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া এবং নির্বাচনকালীন প্রশাসন দেশের প্রথম সারির দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিগত দুটি নির্বাচনে বৈধতার ঘাটতি রয়েছে।’

‘বর্তমান পরিস্থিতিতে মানবাধিকারের প্রতি যেসব হুমকি রয়েছে, তার মধ্যে একটি আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। সেটি হলো শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা। আমরা এ কারণে শঙ্কিত যে সম্প্রতি তাকে নিশানা করা হয়েছে। এর মধ্যদিয়ে তিনি ধারাবাহিক বিচারিক হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে আমরা মনে করি। তার নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে ৪০ জন বিশ্বনেতা আপনার কাছে যে চিঠি লিখেছিলেন, তার ওপর ভিত্তি করেই এই চিঠি লেখা হয়েছে।’

‘আমরা সম্মানের সঙ্গে আপনার প্রতি অবিলম্বে অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান বিচারিক কার্যক্রম স্থগিতের আহ্বান জানাচ্ছি। এরপর একটি নিরপেক্ষ বিচারক প্যানেলের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করা হোক। ওই বিচারিক প্যানেলে আন্তর্জাতিকভাবে আইনবিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃত ব্যক্তিরা ভূমিকা রাখবেন। আমরা আত্মবিশ্বাসী যে তার বিরুদ্ধে দুদক ও শ্রম আইনে যেসব মামলা চলছে, সেগুলো পর্যালোচনা করলে তার দোষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।’

চিঠিতে তারা আরও বলেন, ‘আমরা আশা করি, আপনি এসব আইনগত বিষয়ের যথাযথ, নিরপেক্ষ ও ন্যায্যতা নিশ্চিতে ভূমিকা রাখবেন। পাশাপাশি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করবেন। একই সঙ্গে সব ধরনের মানবাধিকার রক্ষার প্রতি সম্মান দেখানো নিশ্চিত করবেন। আগামী দিনগুলোতে এসব বিষয়ের সুরাহা কীভাবে হবে, তা দেখার জন্য বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ নজর রাখছে। আমরাও সেই সব মানুষের কাতারে রয়েছি।’

বিশ্লেষকরা বলেন, এটা স্পষ্ট যে, নোবেল বিজয়ী এবং বিশ্বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিরা অধ্যাপক ইউনূসের আইনি বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গত কয়েক দশক ধরে ড. ইউনূস বাংলাদেশের জনগণের কাছে একজন সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, এটি বাংলাদেশের জনগণের কাছে অত্যন্ত সম্মানের বিষয়।

কিন্তু যে বিষয়টি উদ্বেগের তা হলো, প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠির ভাষা ও তাদের দাবি। তারা অবিলম্বে অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচারিক কার্যক্রম স্থগিতের দাবি জানিয়েছেন। এই দাবি শুধু মর্মান্তিকই নয়, আপত্তিকরও বটে। যেকোন আইনি প্রক্রিয়া এবং এর রায় নিয়ে যেকোনো ব্যক্তিরই আশঙ্কা থাকতে পারে, কিন্তু একটি মামলার চূড়ান্ত রায় দেয়ার কেউ সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। এছাড়া সরকারকে একটি মামলার আইনি প্রক্রিয়া বাদ দিতে আহ্বান জানানো কতটুকু যৌক্তিক সেই নৈতিক প্রশ্নটিও সামনে আসে।

বৈশ্বিক নেতাদের এমন দাবি একটি দেশের সার্বভৌম মর্যাদার লঙ্ঘন। অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার রায় কী হয় সেটার জন্য সবার অপেক্ষা করা উচিত। ধরা যাক, মামলায় রায় ড. ইউনূসের বিপক্ষে যাবে, তখন মামলার রায়েরে বিরুদ্ধে নোবেল বিজয়ীর আপিল করার সুযোগ পাবেন। বাংলাদেশে বা বিদেশের কোনো ব্যক্তি কর্তৃক আইনি ব্যবস্থার কাজে এমন হস্তক্ষেপ আইনের অবমূল্যায়ন করার সমতুল্য।

অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করলে তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া যাবে না জানিয়ে তাকে খালাস দেয়ার কথা জানিয়েছেন ওই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। আদালতে মামলা চলমান থাকা অবস্থায় তারা কীভাবে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তা আশ্চর্যের বিষয়। কোন দেশের কোন আইন বিশেষজ্ঞের এই ধরনের বিবৃতি দেয়া ঠিক নয়, যা আদালতকে প্রভাবিত করতে পারে। আদালতে মামলা চলমান থাকা অবস্থায় প্রত্যেকের জন্য আদর্শ হলো প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার জন্য এবং রায়ের জন্য অপেক্ষা করা।

এখানে আরেকটি বড় প্রশ্ন সামনে আসে, সেটি হলো- একটি দেশের সরকারপ্রধানকে একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সমস্ত আইনি প্রক্রিয়া স্থগিত করা এবং তার বিরুদ্ধে সমস্ত মামলা বাতিল করার অনেুরোধ জানানো কতটা নৈতিক। বরং তারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলোয় ন্যায়বিচার নিশ্চিতের আহ্বান জানাতে পারতেন।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে কিছু বিদেশি সরকার ও সংস্থা বাংলাদেশে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে সমন্বিত প্রচারণা চালাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার যাতে দেশটির আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে পুনরায় নির্বাচিত না হতে পারেন তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে বলে বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। চিঠির লেখকরা অধ্যাপক ইউনূসের মামলার কথা উল্লেখ করার পাশাপাশি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছেন। অথচ দুটি বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা, ড. ইউনূসের মামলার সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের কোনো সম্পর্কই নেই, যদিও তারা বিষয়টি এক করে ফেলেছেন।

চিঠিটির আরেকটি গুরুতর দুর্বলতা হলো- এটি সরকার প্রধানের কাছে একটি খোলা চিঠি হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। নিয়মানুযায়ী, একটি দেশের কূটনৈতিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে বিষয়টি জানাতে হবে, যা পরে সরকার প্রধানের অফিসে পাঠানো যেতে পারে।

ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকরা আসন্ন নির্বাচন নিয়ে যেভাবে প্রকাশ্যে মন্তব্য করছেন, বাংলাদেশের কোনো লেখক বা বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা সংশ্লিষ্ট বিদেশি কূটনীতিকদের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে একই ধরনের বিষয়ে খোলা চিঠি লেখার কথা কল্পনাও করতে পারেন না। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নবিদ্ধ এই চিঠিটি কূটনৈতিক শিষ্টাচারের খেলাপ হয়েছে। একজন ব্যক্তি ইস্যুতে প্রকাশ্যে এ ধরনের চিঠি একটি সরকার এবং প্রকৃতপক্ষে একটি দেশকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সামনে বিব্রত করার পদক্ষেপ।

এ ধরনের চিঠির পর আরও কয়েকটি বিষয় সামনে আসে, সেগুলো হলো- ২০০১ সালের অক্টোবরে সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরপরই বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তাণ্ডব চালানোর পর বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে কী এই ধরনের উদ্বেগের চিঠি পাঠানো হয়েছিল?

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের কট্টর বিরোধী আলেক্সি নাভালনকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করার পর রুশ প্রেসিডেন্টের কাছে এ ধরনের কোনো চিঠি দিয়েছিলেন?

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের দুই ঘাতক যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় পালিয়ে রয়েছেন। তাদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কী তারা ওয়াশিংটন ও অটোয়া প্রশাসনের কাছে কোনো আহ্বান জানিয়েছেন?

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে সমস্ত আইনি পদক্ষেপ স্থগিত করার এবং তাকে মুক্তি দেয়ার বিষয়ে কী দেশটির কর্তৃপক্ষের কাছে তারা এ ধরনের কোনো চিঠি দিয়েছেন?

ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যার পর দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে বিস্তারিত জানার দাবিতে সৌদি সরকারের কাছে এমন কোনো খোলা চিঠি পাঠানো হয়েছিল কি?

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের একজন সম্মানিত ব্যক্তি। বর্তমানে তিনি তার সম্মান রক্ষার জন্য একটি কঠিন আইনি পরীক্ষায় রয়েছেন। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।

বাংলাদেশ কোনো বানানা রিপাবলিক (কলা প্রজাতন্ত্র) নয়। দেশটির জাতীয় আত্মসম্মান বলে কিছু আছে। বাংলাদেশের জনগণের কাছে এটি খুবই মূল্যবান।

লেখক : সৈয়দ বদরুল আহসান, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে