শেখ রাসেল বেঁচে থাকবে চিরকাল
ড. মোঃ শফিকুল ইসলাম : শেখ রাসেল আমাদের সেই ছোট্ট শিশু। যিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ সন্তান। শেখ রাসেল ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকায় ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবনে জন্মগ্রহণ করেন। আজ তার ৬০ তম জন্মদিন। এই দিন শেখ রাসেল দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই ছোট শিশুকে সেই দিন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা রেহাই দেননি। তাকেও তার পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে হত্যা করা হয়। যা বাঙালি জাতির জীবনে এক কালো অধ্যায়। এর মতো ঘৃণিত কাজ আর পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। কিভাবে এই জঘন্যতম ঘটনা ঘটাল, আজও তা কল্পনা করতে পারি না।
এই ছোট শিশু ছিল অবুঝ, তার মতো নির্দোষ মানুষটিকে মারতে পারে মানুষ। এরা মানুষ নয়, বরং জাতির জীবনে এই কুলাঙ্গার। তবে এর সাথে জড়িত যারা এদের মধ্যে এখনও অনেকের বিচার হয়নি। তাদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করতে পারলে দেশ ও জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে। জাতি চায় সরকার যেন তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে দ্রুত ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা সেদিন বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। তাই শেখ রাসেলকে রেহাই দেয়নি। যা খুবই দুঃখজনক। এদের ক্ষমা করার কোন প্রশ্ন আসে না।
এই ছোট্ট ছেলেটি শৈশব থেকে পিতার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কারণ তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই সময়ে জাতির মুক্তির জন্য অধিকাংশ সময়ে জেলে থাকতে হয়েছে। যার কারণে তার বাবাকে সর্বদা কাছে পায়নি। কারাগারে দেখা করার সময় রাসেল কিছুতেই তার বাবাকে রেখে আসবে না। এ কারণে তার মন খারাপ থাকতো। কারাগারের রোজনামচায় ১৯৬৬ সালের ১৫ জুনের দিনলিপিতে রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না- যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল।
আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়। এথেকে বুঝা যায় শেখ রাসেলের জীবনে কত বড় কষ্ট নিয়ে তার সময় অতিবাহিত করছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তার ভূমিকা অপরিসীম। কারণ শেখ রাসেল তার মূল্যবান সময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে কাটাতে পারেননি। কারণ তার পিতা ত কারাগারে। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শেখ রাসেলের ত্যাগ অনেক। আজ যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে দেশের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ হিসেবে কাজ করতেন। বঙ্গবন্ধুর ছায়া হিসেবে তার প্রিয় বোন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে থেকে জাতিকে নেতৃত্ব দিতে পারতেন।
শেখ রাসেল ছিলেন দুরন্ত প্রাণবন্ত। তিনি বেঁচে থাকলে আজ দেশে একজন মেধাবী নেতা পেতেন। যাকে নিয়ে দেশ ও জাতি গর্ব করতে পারতেন। দেশের শিশু-কিশোরদের নিকট শেখ রাসেল এক তারুণ্যর নাম, এক ভালোবাসার নাম। তাই বর্তমান প্রজন্মকে শেখ রাসেলকে জানাতে তার নামে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা দরকার। সেখানে তাকে নিয়ে অধ্যায়ন হতো, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারত।
শেখ রাসেলকে নিয়ে গবেষণা হতো, ছোট শিশু শেখ রাসেল চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। কী কী গুণ তার মধ্যে ছিল তা বর্তমান প্রজন্ম জানতে পারত। মাত্র ১১ বছর বয়সে ঘাতকের নির্মম বুলেটে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন শেখ রাসেল। বেঁচে থাকলে তার কর্মের মাধ্যমে বাঙালি জাতির জীবনে উজ্জ্বল অবদান রাখতে পারতেন। যা তিনি তার ছোট জীবনে ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে প্রকাশ করে গেছেন। শেখ রাসেলের নামকরণের পিছনে একটি সুন্দর গল্প আছে। বঙ্গবন্ধু সব সময় শান্তি ও সহাবস্থানের পক্ষে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নোবেল বিজয়ী দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেলের ভক্ত ছিলেন। তারই আলোকে শেখ রাসেলের নামকরণ করা হয়।
শেখ রাসেল ছিলেন নিষ্পাপ, তারপরও রাজনীতিতে নিজের কোনো অংশগ্রহণ না থেকেও, রাজনীতির যূপকাষ্ঠে তাকে জীবন দিতে হয়। এর চেয়ে বেদনার জিনিস কী আর হতে পারে। শহীদ শেখ রাসেলকে নিয়ে রাজনীতির কোথায় কোন বিতর্ক নেই। তাই তাকে নিয়ে একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারলে জাতি তার মত নিষ্পাপ একটি শিশুকে উদ্দেশ্য করে নানা বিষয়ে গবেষণা এবং অধ্যায়ন করতে পারতেন।
শেখ রাসেল বাবাকে না পেয়ে তার মেয়েকে বাবা বলতেন। মাকে আব্বা ডাকে শুনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একদিন জিজ্ঞাসা করলেন -ব্যাপার কী? বঙ্গমাতা উত্তর দিলেন বাড়িতে আব্বা, আব্বা করে কাঁদে। তাই আমি ওকে আমাকে আব্বা বলে ডাকতে বলেছি। যা কারাগারের রোজনামচায় লেখা আছে। একটি শিশু তার পিতার মায়া, আদর, স্নেহ ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিল । অর্থাৎ বিশাল ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন এবং একটি ভূখণ্ড পেয়েছি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার কারণে ১৯৭১ সালে শেখ রাসেল তার মা, দুই বোনসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর বাড়িতে বন্দি থাকেন। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর মুক্তি পান। মুক্তি পেয়ে জয় বাংলা বলে স্লোগান দেন।
শেখ রাসেল দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ অনেক উদ্যোগ নিয়েছেন। সকল উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। এমন উদ্যোগ নিতে হবে যাতে মানুষ তার ইতিহাস, তার কর্ম এবং তার চিন্তা জানতে পারে। তরুণ প্রজন্ম তার দুরন্ত চেতনায় তাদের জীবন অতিবাহিত করতে পারে। শেখ রাসেলের সত্তা ধারণ করে দেশের সকল জাতি বেড়ে উঠুক এটাই হোক আমাদের প্রত্যশা।
শেখ রাসেলের জন্মদিনকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করায় সরকারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এই দিবসের মাধ্যমে মানুষ শেখ রাসেলকে নতুন প্রজন্ম নতুনভাবে চিনতে পারবেন এবং জানতে পারবেন। শেখ রাসেল এক উদীয়মান তরুণ ছিলেন। কিন্তু নরপশুরা তাকে বাচতে দেয়নি। বেঁচে থাকলে এক বুদ্ধিদীপ্ত নেতা পেতাম। যিনি জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতেন।
আজ তার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাই এবং তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। তিনি আছেন আমাদের হৃদয়ে, থাকবে চিরকাল যতদিন পৃথিবী আছে।
শেখ রাসেল ছিলেন এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। বাঙালি জাতি তার মধ্যে আবিস্কার করে তাদের জীবনের শৈশব কাল। শহীদ শেখ রাসেলের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকুক আপামর বাঙালির শৈশব। শেখ রাসেল দিবসের মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল শিশু, কিশোর-কিশোরীর নিকট জাতির জনকের আদর্শ, শেখ রাসেলের ব্যক্তিত্ব, সরলতা এবং দুরন্ত ও নির্ভীক শৈশবের গল্প পৌছিয়ে দিতে পারলে দিবসটির তাৎপর্য সফল হবে।
ড. মো. শফিকুল ইসলাম : সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য-পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ