দেনমোহর হিসেবে গাছ নিয়ে প্রশংসায় ভাসছেন নাটোরের নবদম্পতি

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৪, ২০২৩; সময়: ১২:৪৫ অপরাহ্ণ |
দেনমোহর হিসেবে গাছ নিয়ে প্রশংসায় ভাসছেন নাটোরের নবদম্পতি

নিজস্ব প্রতিবেদক, নাটোর : বিয়েতে দেনমোহর হিসেবে ৫টি ফলদ ও বনজ গাছ নিয়ে প্রশংসায় ভাসছেন নাটোরের কনে সুকৃতি আদিত্য ও বর কুমিল্লার নাবিন আদনান দম্পতি।

দেনমোহর নিয়ে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাঝে এমন ব্যতিক্রমী দেনমোহরের কারণে আলোচিত হচ্ছেন তারা। বিয়ের সামাজিকতা শেষে বিয়ের দিনই কনের বাবার বাড়িতে ৫টি পরিবেশ বান্ধব গাছ রোপণ করেছেন বর কনে।

গত শুক্রবার নাটোরের দিঘাপতিয়া এলাকায় উত্তরা গণভবনের পাশে কনের বাবার বাড়িতে কনে সুকৃতি আদিত্যের এমন বিয়ের আয়োজনে এলাকায় সৃষ্টি হয় চাঞ্চল্য।

এলাকাবাসী জানায়, বিয়ের দিন সুকৃতিদের বাড়িতে আনন্দ উল্লাস হৈ,হুল্লোড় ও চেচাঁমেচি সবই ছিল। দুজনার পূর্ব পরিচয় থাকলেও দুই পরিবারের সম্মতিতে ঘরোয়া পরিবেশেই বিয়ে সম্পন্ন হয় সুকৃতি আদিত্য -নাবিন আদনানের। বিয়ের পড়ানোর সময় বিয়ের অন্যতম আকর্ষণ ছিল দেনমোহর হিসাবে পরিবেশবান্ধব গাছ।

কনে সুকৃতি ও তার বাবা মায়ের গাছ এবং পরিবেশের প্রতি রয়েছে অগাধ ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা থেকে তিনজনের পরিকল্পনা অনুযায়ী সুকৃতি তার বিয়ের মোহরানা হিসেবে বেছে নেন গাছ।

পারিবারিকভাবে ধুমধাম করেই তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের আসরেই মোহরানা হিসেবে ৫টি ফলদ ও বনজ গাছ হস্তান্তর করেন বরপক্ষ। ব্যতিক্রমি এই আয়োজনে চাঞ্চল্য তৈরী হয় পুরো এলাকা জুড়ে।

বিয়ে পড়ানোর পর পরই বর-কনে বাড়ির আঙ্গিনায় দেনমোহর হিসেবে পাওয়া গাছের চারা রোপণ করেন। রোপণকৃত গাছের চারাগুলি তারা দুজনেই পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করেন।

এ ঘটনায় প্রথমে বরযাত্রী, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশী রীতিমতো অবাক হয়ে গেলেও পরে সকলেই প্রসংশায় ভাসিয়েছেন নব দম্পতিকে। জীবনের প্রথম এমন বিয়ে দেখে রীতিমতো হতবাক তারা।

স্থানীয় বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধ আব্দুস সাত্তার, জানান, তিনি তার জীবনে এমন ব্যতিক্রম বিয়ে দেখেননি। বিয়ে বাড়িতে এসে বর কনের গাছ লাগানো দেখে তার খুবই ভাল লেগেছে। নতুন দম্পতি সুখে শান্তিতে থাকুক এমন শুভকামনা জানান তিনি।

কনের নিকটাত্মীয় সাংস্কৃতিকর্মী সৈয়দ মাসুম রেজা বলেন, দেনমোহরে সবসময় কনেদের বা কনেপক্ষকে টাকার অংক বাড়াতে দেখেছি। কিন্তু সুকৃতির বিয়েতে ব্যতিক্রম দেখলাম। তার চিন্তা চেনতা অবশ্যই সাধুবাদ প্রাপ্য।

নাটোরের দিঘাপতিয়া এলাকার বাসিন্দা লিটন-সুস্মিতা দম্পতির একমাত্র কন্যা সুকৃতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগ থেকে মাস্টার্স এবং বর কুমিল্লার বাসিন্দা নাবিন আদনান একই অনুষদের অংকন ও চিত্রায়ণ বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।

নাবিন এখন ঢাকায় শিল্প নির্দেশক হিসাবে কাজ করছেন। বছর ছয়েক আগে তাদের পূর্ব পরিচয় থেকে ভালবাসার বন্ধনে জড়িয়ে পড়েন। পরে দুই পারিবারের সম্মতি নিয়েই সুকৃতি ও নাবিন পরস্পর বিয়ের পিঁড়িতে বসেন।

কনে সুকৃতি আদিত্য বলেন, বর্তমানে প্রায় প্রতিটি বিয়েতেই দেনমোহর নিয়ে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। আমার মনে হয় তা থেকে বেড়িয়ে আসা উচিত। কারণ বিয়ে মানেই আর্থিক লেনদেনটা মুখ্য না।

দুটি মানুষের মনের মিল হওয়াটাই বড় বিষয়। সেখান থেকে মনে হলো যে যদি এমন কিছু করা যায় যা আমাদের প্রকৃতিকেও সুস্থ রাখবে। সেই সাথে আমাদের সম্পর্কটাও সুস্থ রাখবে।

তাই নতুন জীবন শুরু করার পূর্বে আমার মনে হয়েছে, গাছ একটা দারুণ উপকরণ হতে পারে, যেটার মাধ্যমে পরিবেশটাও সুস্থ থাকলো এবং পরিবেশের সুস্থতা দেখে আমরাও খুশি থাকলাম।

বর নাবিন আদনান বলেন, দেনমোহরের বিষয়টা হচ্ছে নিরাপত্তা। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমাদের নিরাপত্তার চাইতে পরিবেশের নিরাপত্তা বেশী জরুরী। এটা একটা প্রতীকী ব্যাপার। এর বাইরে বিশেষ কিছু নয়।

প্রতীকী ব্যাপার হিসাবেই আমরা চর্চা করলাম যাতে আমরা পরিবেশ, প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে থাকতে পারি। সুকৃতির ভিন্ন চিন্তাকে স্যালুট জানাই।

কনের বাবা সিসিমপুরের প্রধান লেখক ও সাবেক অংকন শিল্পি এম. আসলাম লিটন জানান, দেনমোহরনার নামে সমাজে যে অসুস্থ প্রতিযোগীতা চলছে,সেই জায়গায় তার মেয়ে সুকৃতি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেজন্য তিনি কনের বাবা হিসেবে গর্বিত বোধ করছেন।

মেয়েকে তিনি সাধুবাদ জানান এবং তার মেয়ের এই সিদ্ধান্ত নতুন প্রজম্মদের কাছে অনুকরণীয় হবে বলে বিশ্বাস করেন। তিনি আর বলেন, তার মেয়ে সুকৃতি আদিত্য সিন্ধান্ত নিয়েছিল যে, বিয়েতে সে মোহরানা নেবে না।

নিলেও সে একটা টোকেন নিতে চায়। অভিভাবক হিসাবে তারা সুকৃতির সেই সিন্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তার মেয়ে মনে করে মোহরানা নিয়ে টাকার অংক বাড়িয়ে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

সেই প্রতিযোগিতায় সুকৃতি থাকবে না। সমাজকে সে একটা বার্তা দিতে চায় যে, মোহরানাটা মুল নয়। মুলটা হচ্ছে দু’টি মানুষের বন্ধন। দু’টি মানুষের হৃদয় মন এক হয় বিয়ের মধ্য দিয়ে। এই বন্ধনটাই আসল।

কোন অর্থনৈতিক বা সম্পদের জায়গায় গিয়ে চুক্তিবন্ধ হওয়ার চাইতে আত্মার চুক্তিবন্ধ হওয়া বেশী জরুরী। সেই জায়গাটা সুকৃতি অনুভব করেছে। বাবা হিসাবে তিনি গর্বিত যে তার মেয়ে এমন ব্যতিক্রম একটা সিন্ধান্ত নিয়েছে।

 

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে