মানব দরদি আইনবিদ ব্যারিস্টার রফিক উল হক
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : অসাধারণ একজন মাটির মানুষ, মানব দরদি আইনবিদ ব্যারিস্টার রফিক উল হক’ ২০২০ সালের ২৪ অক্টোবর ৮৪ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের, ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের, পাকিস্তানের এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অর্থাাৎ আন্ডার ফোর ফ্লাগস, চার দেশের নাগরিক। তার জন্ম ১৯৩৫ সালের ২ নভেম্বর কলকাতার সুবর্ণপুর গ্রামে। তার পিতা মুমিন-উল হক ছিলেন চিকিৎসক ও মা নূরজাহান বেগম।
তার বাল্যকাল কাটে কলকাতায়। কলকাতা চেতলা স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু। ইসলামিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট, ১৯৫৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, ১৯৫৭ সালে দর্শন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ১৯৫৮ সালে এলএলবি পাস করেন।
১৯৬০ সালে তিনি কলকাতা উচ্চ আদালতে আইনজীবী হিসেবে বারের সদস্য হন। এ বছরেই ডা. ফরিদা হকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং বিলেতে যান। ১৯৬২ সালে যুক্তরাজ্য থেকে বার এট ল’ সম্পন্ন করেন তিনি। তিন বছরের কোর্স দুই বছরে সম্পন্ন করেন এবং ‘অনার্স’ স্বীকৃতি লাভ করেন। ১৯৬২ সালে লিংকনস ইন -এ ডাক পান। ১৯৬২ সালে যুক্তরাজ্য থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে তৎকালীন পাকিস্তানের নাগরিক হয়ে চলে আসেন ঢাকায়। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা উচ্চ আদালতে যোগদান করেন এবং ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে অ্যাডভোকেট হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন তিনি।
১৯৭৫ সালে তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে সিনিয়র আইনজীবী হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৮৯-১৯৯০ সালে তিনি বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্ণাঢ্য জীবনে আইন পেশায় দীর্ঘ প্রায় ৬০ বছর পার করেন তিনি। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে কাজ করেছেন। বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জমানায় দুই নেত্রী যখন কারাগারে তখন তাদের জন্য অকুতোভয়ে আইনি লড়াই করেন তিনি। একই সঙ্গে দুই নেত্রীর সমালোচনা করতেও পিছপা হননি তিনি। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ভাবমূর্তি রক্ষায় বরাবরই সোচ্চার ছিলেন রফিক-উল হক।
একাগ্রচিত্তের মানুষ আইনজীবী রফিক-উল হক সবসময় সততা, দায়িত্বশীলতা ,নিষ্ঠা ও সমতার পরিচয় দিয়েছেন। কখনো তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল বিবেচনায় নেননি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পক্ষেও তিনি ওকালতি করেছেন। দুজনকেই তিনি সমভাবে ও সমদৃষ্টিতে দেখেছেন। আগ্রহ নিয়ে দুজনের মামলা পরিচালনা করেছেন। আইনের ব্যাপারে তার ছিল যেমন অগাধ জ্ঞান, তেমনি আইনকে তিনি আইনের দৃষ্টিতে দেখেছেন সবসময়। তার যুক্তিতর্ক খুবই স্পষ্ট ও সাবলীল। একজন স্পষ্টভাষী ও সাহসী মানুষ হিসেবেও তার সুনাম ছিল।
বিগত ওয়ান ইলেভেনের সময় ব্যারিস্টার রফিক-উল হক আইনজীবী হিসেবে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। ওয়ান ইলেভেন সরকারের বিভিন্ন আদেশ নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করে বিভিন্ন মামলা পরিচালনা করেছিলেন। তিনি যখন অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তখনো তিনি কোনো পক্ষপাতিত্ব করেননি। তখনকার সময়ে অনেককেই স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টে ডিটেনশন দিয়ে কারাগারে আবদ্ধ করে রাখা হতো। এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে হেভিয়াস কর্পাস রিট দায়ের হতো।
সেসব ফাইল দেখে যদি তিনি বুঝতে পারতেন যে ডিটেনশন বৈধ হয়নি, রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা হওয়া স্বত্তেও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কার্যতালিকার ওইসব মামলাগুলোর বিষয়ে আদালতকে অপেক্ষায় না রেখে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আটকাদেশ বৈধ হয়নি উল্লেখ করে তাদের ছেড়ে দেয়ার কথা বলতেন। অন্যান্য রিট পিটিশনের ক্ষেত্রেও তিনি যদি দেখতেন যে সরকারি আদেশ বেআইনি সেখানেও তিনি আদালতে কোনোরূপ ভনিতা না করে তা স্বীকার করে নিতেন। এরকম স্বচ্ছতা অন্য কোনো অ্যাটর্নি জেনারেল দেখাতে পারেননি। অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক তার যে প্রাপ্য বেতন ছিল, তাও গ্রহণ করেননি। বিনে পয়সায়ও তিনি অনেকের মামলা পরিচালনা করতেন।
তার কলেজ লাইফ ও ছাত্রজীবনে রাজনীতি সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতেন- “আমার কলেজ লাইফ হচ্ছে ইসলামিয়া কলেজ। বঙ্গবন্ধুও পড়েছেন ইসলামিয়া কলেজে। থাকতাম বেকার হোস্টেলে। ওখানেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন। আমি যে রুমটাতে ছিলাম, তার পাশের দুটো রুমেই বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম হয়েছে। আমি গিয়েছিলাম উদ্বোধন করতে। ২৬ ও ২৭ নম্বর রুম এখন বঙ্গবন্ধু জাদুঘর। আমি পাশের ২৪ নম্বর রুমে থাকতাম। আমার ভাইয়েরাও ওখানে থেকেছে, আমিও ওখানে থেকেছি। তারপর ইউনিভার্সিটি-জীবনে কারমাইকেল হোস্টেলে থেকেছি।
ওখানেও শেখ সাহেব কিছুদিন ছিলেন। ..ইউনিভার্সিটিতে আমি রাজনীতি করতাম, সোশ্যাল সেক্রেটারি ছিলাম। নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করে জিতেছিলাম। তখন মুসলমান ছাত্র তো আমরা মাত্র চার-পাঁচজন। তার পরও আমি অনেক ভোটে জিতে গেলাম। এর পরেরবার সবাই মিলে আমাকে হারাবে বলে ঠিক করল। আমার কাজ ছিল ছাত্রদের বই, ক্যান্টিন, ট্যুরের ব্যবস্থা করা। তখন রাস্তার পলিটিকসে জড়িত হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। আর যুব কংগ্রেস করতাম।
কংগ্রেস বলতে ন্যাশনাল পলিটিকস না। আমি তখন ওয়েস্ট বেঙ্গল যুব কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তখন আমার নেত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন সেন্ট্রাল যুব কংগ্রেসের সভাপতি আর আমি ছিলাম ওয়েস্ট বেঙ্গলে। সুতরাং ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমার বহুবার দেখা হয়েছে, বহুবার মিটিং হয়েছে, কাজ করার সুযোগ হয়েছে। একটা খুব বড় মিটিং করেছিলাম সল্টলেকে, ইন্দিরা গান্ধী, নেহরু, বিধান রায় ছিলেন। সে আরেক ইতিহাস। কলকাতায় পড়ার সময় আমার বন্ধু ছিলেন ভারতের [সাবেক এবং প্রয়াত] রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।”
জীবনে অনেক টাকা উপার্জন করেছেন ব্যারিস্টার রফিক উল হক। আবার সেই অর্থ অনেক জনহিতকর ও মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেছেন। তার কিছু দাতব্য প্রতিষ্ঠান আছে। দাতব্য প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা অত্যন্ত বিরল। সমাজ ও মানবতার সেবায় তার হাত ছিল সবসময়ই উদারহস্ত। যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সমাজ-মানবতার সেবায়।
১৯৯৫ সালে রফিক-উল হক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সুবর্ণ ক্লিনিক; পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও ডা. ফরিদা হকের স্মরণীয় নামে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে উন্নীত ও রূপান্তরিত হয়। ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে জমি এবং জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ট্রাস্ট ফান্ড প্রাপ্তিতে সরাসরি ভূমিকা ছিল তার। জাতীয় অধ্যাপক ইব্রাহিমের অত্যন্ত স্নেহধন্য ছিলেন ব্যারিস্টার রফিক উল হক ও তার স্ত্রী ডা. ফরিদা হক। সে সুবাদে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির অন্যতম পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছিলেন তারা।
সমিতির বারডেম, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক এবং এনএইচএন প্রতিষ্ঠানে তিনি বেশ কয়েকটি ইউনিট, স্থাপনা, আইসিইউ, সিসিইউ, মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব ও বহু বেডের হাসপাতাল ইত্যাদি গড়ে দিয়েছেন। তিনি ডায়াবেটিক সমিতির সহসভাপতি ছিলেন এক যুগেরও বেশি, ছিলেন বারডেম বোর্ড অব ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান। তিনি ছিলেন আদ দ্বীন ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্টের চেয়ারম্যান। আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ ২৫টিরও বেশি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অর্থায়ন সূত্রে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন।
তিনি আহছানিয়া মিশন ক্যানসার জেনারেল হাসপাতাল ও আহছানিয়া মিশন-মালয়েশিয়া যৌথ এন বি এফ আই প্রতিষ্ঠান হজ্জ ফাইন্যান্স কোমপানি লিমিটেডের উদ্যোক্তা প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ডায়াবেটিক সমিতির কাউন্সিলে, আহছানিয়া মিশন এর কাউন্সিল ও হজ্জ কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে এবং আদ দ্বীন ট্রাস্টে তার সাথে সরাসরি কাজ করেছি আমি। স্বাস্থ্য খাতের প্রতি তার এমন আন্তরিক আগ্রহ কেন জানতে চাইলে তিনি বলতেন, ‘আমার বাবা ডাক্তার, চাচা ডাক্তার, ভাই ডাক্তার, স্ত্রী ডাক্তার, তাদের ভিড়ে আমি এবং পরবর্তীকালে আমার একমাত্র ছেলে আমরা শুধু আইন ব্যবসায়। আমার চাচার চোখের বড় চিকিৎসালয় ছিল আমার আব্বা সেটা দেখাশুনা করতেন। আমিও দেখাশোনা করি। সেই থেকে স্বাস্থ্য খাতের প্রতি আমার দুর্বলতা।’
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: সরকারের সাবেক সচিব; এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান