রঙ্গভরা ভোটের মাঠ
খান মুহাম্মদ রুমেল : দেশজুড়ে ভোটের হাওয়া। রাস্তায়, ফুটপাথে, দোকানে, শপিংমলে, চায়ের আড্ডায়, ফসলের মাঠে, অফিসে দফতরে, আদালত কাচারিতে, রিকশার টুংটাংয়ে, বাসের পাশের যাত্রীর আলাপে-বোঝা যায় দেশে চলছে ভোটের প্রচারণা। ১৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে ভোটের সূর্য।
নরম আলো নিয়ে যাত্রা শুরু করা একটি কাঁচা ভোর সময়ের পথ পাড়ি দিয়ে যেমন হয়ে ওঠে দিনের তাতানো সূর্য, তফসিল ঘোষণার পর ভোটে অংশ নেওয়া দলীয় প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও তেমন উত্তাপ নিয়ে এখন প্রচারণার মধ্যগগনে।
দিন আর বেশি বাকি নেই- যত পারা যায় বেশি বেশি মানুষের কাছে যাওয়া, ভোটারের কাছে যাওয়া। প্রাণপণে প্রার্থীরা দিন রাত এক করে ছুটছেন। শহর নগর গ্রামগঞ্জ সব জায়গায় একই চিত্র। এসব দেখে মনে পড়ে লালনের সেই বিখ্যাত গান-মানুষ ভজলে সোনার মানুষ পাবি। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের মন মানুষ ভজার কাল।
এই উৎসব উচ্ছ্বাসের মাঝেও চোখে পড়ে কিছু বিচিত্র চিত্র। এগুলো তুলে ধরছে আমাদের গণমাধ্যম। সব দেখে মনে হয় গণমাধ্যমগুলো ক্ষেত্র বিশেষে ভারি ভারি খবর প্রচারের চেয়ে দর্শক কিংবা পাঠক কী চায়, সেই খবরের দিকেই মনোযোগ দিচ্ছে বেশি।
একটু ব্যাখ্যা করা বোধহয় প্রয়োজন। এই যেমন এবারের নির্বাচনে পোড়খাওয়া অনেক মাঠের রাজনীতিবিদের পাশাপাশি লড়ছেন সমাজে নানা কারণে আলোচিত ব্যক্তিরা। এই তালিকায় আছেন নায়ক, গায়ক, খেলোয়াড়, ইউটিউবার থেকে শুরু করে হরেক কিসিমের মানুষ।
তাদের কেউ কেউ দলীয় সমর্থন নিয়ে আবার কেউ স্বতন্ত্র হিসেবে লড়ছেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। প্রতিদিন টিভি পর্দায় চোখ রাখলে দীর্ঘ উপস্থিতি দেখা যায় তাদের। পত্রিকার পাতায় কিংবা অনলাইনের স্ক্রিনে চোখ রাখলেও দেখা মেলে তাদের নিয়ে বড় বড় এবং রং বাহারি ফিচার।
তানোর- গোদাগাড়ি উপজেলা নিয়ে গঠিত রাজশাহী-১ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন ঢাকাই সিনেমার নায়িকা মাহিয়া মাহি। চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন। টিকিট না মেলায় হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। সেই প্রার্থিতাও বাতিল হয়েছিল যাচাই বাছাইয়ে। পরে নির্বাচন কমিশনে আপিল করে ফেরত পান প্রার্থিতা। তার নির্বাচনী প্রতীক ট্রাক। প্রতীক বরাদ্দ পেয়েই প্লাস্টিকের কমলা, হলুদ রংয়ের একটি প্লাস্টিকের ট্রাক হাতে নিয়ে ঘুরছেন তিনি। তার পেছনে পঙ্গপালের মতো ঘুরছে আমাদের গণমাধ্যম।
এবারের নির্বাচনে পোড়খাওয়া অনেক মাঠের রাজনীতিবিদের পাশাপাশি লড়ছেন সমাজে নানা কারণে আলোচিত ব্যক্তিরা। এই তালিকায় আছেন নায়ক, গায়ক, খেলোয়াড়, ইউটিউবার থেকে শুরু করে হরেক কিসিমের মানুষ।
এই নির্বাচনের আরেক আলোচিত চরিত্র প্যারোডি গায়ক নকুল কুমার বিশ্বাস। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের মনোনয়নে লড়ছেন তিনি। মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন দুটি আসন থেকে কালকিনি-ডাসার ও সদর উপজেলার একাংশ নিয়ে গঠিত মাদারীপুর-৩ আসন থেকে এবং বানারীপাড়া উজিরপুর নিয়ে গঠিত বরিশাল-২ থেকে।
শেষ পর্যন্ত বরিশাল থেকেই নির্বাচন করছেন তিনি। প্রায়ই টেলিভিশনের খবরে দেখা যায় নির্বাচনী প্রতীক গামছা গলায় দিয়ে গান গেয়ে গেয়ে ভোট প্রার্থনা করছেন।
পাবনা-২ আসন থেকে নির্বাচন করছেন গায়িকা ডলি সায়ন্তনী। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বিএনএম’র প্রার্থী তিনি। নির্বাচনের মাঠে এবারও আছেন ইউটিউবার হিরো আলম। আগে স্বতন্ত্র নির্বাচন করলেও এবার বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছেন তিনি। যদিও ফেসবুকে ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রার্থিতা প্রত্যাহারের। এরপর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের কারণ ব্যাখ্যা করার সংবাদ সম্মেলন ডেকে তিনি বললেন-আছেন নির্বাচনের মাঠে। ইদানীং প্রায়ই নির্বাচনী প্রতীক ডাব হাতে প্রচারণায় দেখা যায় তাকে।
নির্বাচনের মাঠে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা কারণে আলোচিত ব্যারিস্টার সুমনও। চুনারুঘাট-মাধবপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত হবিগঞ্জ-৪ আসনে প্রার্থিতা করছেন তিনি।
এছাড়া ঢাকা ১০ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদ, মাগুরা-১ এ ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, নড়াইল-২ থেকে মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা এবারও নৌকার প্রার্থী। বরাবরের মতো এবারও নীলফামারী-২ এ আওয়ামী লীগের আস্থা সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের ওপর।
মানিকগঞ্জ-২ এ সঙ্গীতশিল্পী মমতাজ বেগম আছেন নৌকা নিয়ে। সাবেক ফুটবলার সালাম মুর্শেদী নৌকা প্রতীক নিয়ে এবারও লড়ছেন খুলনা-৪ থেকে।
সব ছাপিয়ে কেন জানি গণমাধ্যমের নজর এবার বেশি মাহিয়া মাহি, হিরো আলম, ডলি সায়ন্তনী, ব্যারিস্টার সুমন, নকুল কুমার বিশ্বাস এবং মমতাজ বেগমের ওপর। হয়তো তাদের কাটতি বেশি! ইদানীং আমাদের গণমাধ্যম আবার কাটতির দিকে বেশি নজর দেয় কি না!
আচ্ছা থাক। অন্য আলোচনায় যাই। গেল কয়েকটি নির্বাচনের মতো এবারও একটা সময় দেশের আপামর মানুষ এবং গণমাধ্যমের তীক্ষ্ণ চোখ ছিল জাতীয় পার্টির ওপর। কারণ প্রতি নির্বাচনেই তারা কোনো না কোনো নাটকীয়তা উপহার দেয় দেশের মানুষকে।
না, এবারও বঞ্চিত করেনি জাতীয় পার্টি। শুরুতে নির্বাচনে আসা না আসার নাটকে মাঠ গরম করে রাখে তারা। যেদিন বনানীর কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করলো তারা, সেইদিন দলের মহসাচিব বললেন মনোনয়ন ফরম বিক্রি করলেও আমাদের নির্বাচনে যাওয়া এখনো নিশ্চিত নয়।
এবারের নির্বাচনের আরেক আলোচিত চরিত্র ঝালকাঠি-২ এ আওয়ামী লীগের প্রার্থী সদ্য বিএনপি ত্যাগী ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর। জেলে গেলেন বিএনপি নেতা হিসেবে। বের হওয়ার পর হয়ে গেলেন নৌকার প্রার্থী…
এই তো, গণমাধ্যম পেয়ে গেল কাটতির খোরাক। ব্যস, প্রতিদিনই অসংখ্য গণমাধ্যমের ভিড় জাতীয় পার্টির অফিস ঘিরে, সকাল সন্ধ্যা। শেষমেশ অনুমিতভাবেই নির্বাচনে এলো তারা। এবং অনেক দেন দরবারের পর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের একেবারে শেষদিন ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ২৬টি আসনে ছাড় পেল দলটি।
যদিও তাদের চাওয়া ছিল আরও বেশি এবং ছাড় দেওয়া আসনে নৌকার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রত্যাহারের দাবি ছিল তাদের। কিন্তু কাজ হয়নি। নৌকা না পেয়ে দলের যারা স্বতন্ত্র প্রার্থিতা করছেন তাদের ব্যাপারে কোনো দায় নেয়নি আওয়ামী লীগ। যৌক্তিকভাবেই নেয়নি। কারণ নৌকার বিপরীতেও দলের যেসব নেতা প্রার্থী হয়েছেন তাদের প্রতিও আওয়ামী লীগের এবার উদার মনোভাব। সুতরাং লাঙলের বিপরীতে দলীয় স্বতন্ত্রদের বসিয়ে দেওয়ার কোনো কারণ নেই।
অনেকেই হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন- দলীয় স্বতন্ত্র আবার কী? এক্ষেত্রে বলি, এটা তো ভাই কাগজে-কলমের কথা। দলীয় স্বতন্ত্র মানে কী, সেইটা আপনিও বোঝেন আমিও বুঝি। সুতরাং তা নিয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তারচেয়ে বরং আমরা দেখি ১৬ আসনে ছাড় পাওয়ার পর জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা পোস্টার ছাপিয়েছেন ‘জাতীয় পার্টি মনোনীত আওয়ামী লীগ সমর্থিত’ লিখে। জাতীয় পার্টির এক নেতার পোস্টারে আবার আওয়ামী লীগ সভাপতির ছবিও চোখে পড়লো!
এবারের নির্বাচনের আরেক আলোচিত চরিত্র ঝালকাঠি-২ এ আওয়ামী লীগের প্রার্থী সদ্য বিএনপি ত্যাগী ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর। জেলে গেলেন বিএনপি নেতা হিসেবে। বের হওয়ার পর হয়ে গেলেন নৌকার প্রার্থী। এক জনসভায় আবার বলে বসলেন -‘আমি আওয়ামী লীগই করতাম, আমু ভাই আমাকে বিএনপিতে পাঠিয়েছিলেন।’
তার এই বক্তব্য শুনে এক রসিকজন বলে বসলেন-তাহলে বিএনপি থেকে আবার আওয়ামী লীগে পাঠালো কে? আমার জানামতে এই প্রশ্নের উত্তর ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর এখনো দেননি!
যাই হোক, সব মিলিয়ে জমে উঠেছে নির্বাচনী প্রচার। রঙ্গ আনন্দের মধ্য দিয়েই জনগণ বেছে নিক তাদের আগামীর নেতা। মানুষ যাকে ভোট নিয়ে সংসদে পাঠাবে তাকেই কুর্নিশ। জয় হোক মানুষের। জয় হোক গণতন্ত্রের।
খান মুহাম্মদ রুমেল ।। গণমাধ্যমকর্মী