ইসির মামলায় যে সাজা হতে পারে প্রার্থীদের

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৮, ২০২৩; সময়: ১১:০০ পূর্বাহ্ণ |
ইসির মামলায় যে সাজা হতে পারে প্রার্থীদের

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের আচরণবিধি মানাতে কার্যত গলদঘর্ম অবস্থা নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। প্রায় প্রতিদিনই আচরণবিধি লঙ্ঘন ও নির্বাচনী অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রার্থীদের ইসি থেকে শোকজ করা হচ্ছে। সশরীরে তলব করা হচ্ছে প্রার্থীদের। দেওয়া হচ্ছে জরিমানার আদেশ।

গতকাল বুধবারও নৌকার দুই প্রার্থী কুমিল্লা-৬ আসনের আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারকে ১ লাখ এবং বরগুনা-১ আসনের প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে ইসি। অপরাধ গুরুতর ও বিচার্য বিষয় হলে করা হচ্ছে মামলাও। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম-১৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান এমপি মোস্তাফিজুর রহমান এবং ঝিনাইদহ-১ আসনের নৌকার প্রার্থী ও বর্তমান এমপি আব্দুল হাইয়ের বিরুদ্ধে ইসি মামলা করেছে। ফৌজদারি কার্যবিধি (সিআরপিসি) অনুযায়ী মামলা দুটির বিচার হবে প্রচলিত আদালতে।

ইসি ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, এসব নির্বাচনী অপরাধ এবং সাজার বিষয়টি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)-১৯৭২ এবং সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা ২০০৮-এর বিধান অনুযায়ী বিচার হবে। আরপিও ও আচরণ বিধিমালায় অপরাধের ধরন এবং সাজার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা ২০০৮ লঙ্ঘনের দায়ে সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া আরপিওতে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ডের বিধান উল্লেখ রয়েছে। অপরাধের মাত্রা ও ধরনের ওপর সাজার ভিন্নতা রয়েছে।

জানতে চাওয়া হলে নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী এবং সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ড. শাহজাহান সাজু বলেন, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা ২০০৮ ও আরপিও অনুযায়ী নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন ও অপরাধের বিচার হয়। আচরণবিধি অনুযায়ী বিচার হয় নির্বাচন পূর্ব ছোটখাটো অপরাধের জন্য। আর আরপিওতে যেসব অপরাধের কথা উল্লেখ রয়েছে, সেগুলো একবারেই নির্বাচনকেন্দ্রিক এবং তাতে সাজার পরিমাণও বেশি।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরই মধ্যে যে দুটি মামলা হয়েছে তা রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা ২০০৮ লঙ্ঘনের অভিযোগে হয়েছে। এসব অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রার্থীর সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে। জানা গেছে, গত ২৪ ডিসেম্বর আব্দুল হাই ও তার দুই সমর্থক শৈলকুপা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিম ও সারুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান মামুনে বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাচন অফিসার মো. তায়জুল ইসলাম বাদী হয়ে দুটি মামলা করেন।

আব্দুল হাইয়ের বিরুদ্ধে করা মামলার অভিযোগে বলা হয়, গত ১০ ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় আসামির অনুসারীরা দেশি অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে শৈলকুপা উপজেলাধীন ১৪ নম্বর দুধসর ইউনিয়নের ভাটাই বাজার সংলগ্ন মহাসড়কে মহড়া দেয় এবং জনগণের মনে ভীতি সঞ্চার করে সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা ২০১৮-এর বিধি ৮(ক), ১১(ক) ও ১২ বিধি লঙ্ঘন করে ওই বিধিমালার ১৮ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেন।

অন্য দুই আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামি মো. আব্দুল হাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঝিনাইদহ-১-এর নৌকা প্রতীকের প্রার্থী। গত ১২ ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় শৈলকুপা থানাধীন ৬ নম্বর সারুটিয়া ইউনিয়নের কাতলাগাড়ী বাজারে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে আসামি আব্দুল হাকিম ও আসামি মাহমুদুল হাসান মামুন তাদের অনুসারীদের নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন হুমকি-ধমকি এবং উসকানিমূলক বক্তব্য দেন।

আসামিরা সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা ২০০৮-এর বিধি ৮(ক), ১১(ক) ও ১২ বিধি লঙ্ঘন করে ওই বিধিমালার ১৮ বিধির শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

এরপর গত ২৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম-১৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান এমপি মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করে ইসি। সাংবাদিককে মারধর ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় এমপি মোস্তাফিজের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা ২০০৮-এর বিধি ৮(খ) ধারায় মামলা করা হয়। গত ৩০ নভেম্বর বিশাল শোডাউন করে মনোনয়নপত্র দাখিলের চিত্র গ্রহণের সময় সাংবাদিকদের মারধর ও ক্যামেরা ভাঙচুরের অভিযোগ আনা হয় এতে।

অভিযোগ বিশ্লেষণে দেখা যায়, মামলা দুটি দায়ের হয়েছে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা ২০০৮-এর বিধি ৮(ক), ৮(খ), ১১(ক) ও ১২ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে। বিধি ৮-এ যানবাহন ব্যবহার সংক্রান্ত বাধা-নিষেধ উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কিংবা উহার মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা তাহাদের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি- (ক) কোনো ট্রাক, বাস, মোটরসাইকেল, নৌযান, ট্রেন কিংবা অন্য কোনো যান্ত্রিক যানবাহন সহকারে মিছিল কিংবা মশাল মিছিল বাহির করিতে পারিবে না কিংবা কোনোরূপ শোডাউন করিতে পারিবে না: (খ) মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় কোনো ধরনের মিছিল কিংবা শোডাউন করিতে পারিবে না।’

বিধি ১১-তে বলা হয়েছে, ‘কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কিংবা উহার মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা তাহাদের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি (ক) নির্বাচনী প্রচারকালে ব্যক্তিগত চরিত্র হনন করিয়া বক্তব্য প্রদান বা কোনো ধরনের তিক্ত বা উসকানিমূলক কিংবা লিঙ্গ, সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে। এমন কোনো বক্তব্য প্রদান করিতে পারিবেন না।’

বিধি ১৮-তে বলা হয়েছে, ‘(১) কোনো প্রার্থী বা তাহার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি নির্বাচন-পূর্ব সময়ে এই বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করিলে অনধিক ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন। (২) কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নির্বাচন-পূর্ব সময়ে এই বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করিলে অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবে’।

এ ছাড়া আরপিও ৭৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো প্রার্থী কোনো বিশেষ ধর্ম, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী, বর্ণ, উপদল বা উপজাতির অন্তর্ভুক্ত হইবার কারণে তাহাকে ভোট প্রদানের জন্য বা তাহাকে ভোট প্রদান করা হইতে বিরত থাকিবার জন্য কোনো ব্যক্তিকে আহ্বান করেন বা প্ররোচিত করেন; জ্ঞাতসারে, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে সমর্থন বা তাহার বিরোধিতা করিবার লক্ষ্যে, নিজেকে এবং নিজ পরিবারের সদস্য ব্যতীত, কোনো ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে বা কেন্দ্র হইতে আনা-নেওয়ার উদ্দেশ্যে কোনো স্থলযান বা নৌযান ভাড়া দেন, ভাড়া করেন, ঋণ নেন, নিয়োগ করেন বা ব্যবহার করেন বা ভোট প্রদানের জন্য ভোটকেন্দ্রে হাজির বা অপেক্ষায় আছেন এইরূপ কোনো ব্যক্তিকে ভোট প্রদান ব্যতিরেকে ভোটকেন্দ্র ত্যাগ করাইবার চেষ্টা করেন; তাহা হইলে তিনি দুর্নীতির অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইবেন এবং তিনি অনধিক সাত বৎসর এবং অন্যূন দুই বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড, এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হইবেন।’

৭৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘একই নির্বাচনে একাধিক ভোটকেন্দ্রে ভোট প্রদান করেন বা ভোট প্রদানের জন্য ব্যালট পেপার চাহেন: ভোট চলাকালে কোনো ভোটকেন্দ্র হইতে ব্যালট পেপার সরাইয়া ফেলেন; বা জ্ঞাতসারে পূর্বোক্ত কোনো কার্য করিবার জন্য কোনো ব্যক্তিকে প্ররোচিত করেন বা তাহার সাহায্য চাহেন; তাহা হইলে তিনি বেআইনি কার্যের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইবেন এবং তিনি অনধিক সাত বৎসর এবং অন্যূন দুই বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড, এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হইবেন।’ এভাবে ৮৬ ধারা পর্যন্ত নির্বাচনী অপরাধের ধরন ও শাস্তির বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে