নৌকা নিয়েও কেন ভরাডুবি ইনুর?
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলের শরিকের প্রার্থীদের ছেড়ে দেয়া ছয়টি আসনের একটি কুষ্টিয়া-২ (মিরপুরও ভেড়ামারা)। এ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়েই লড়াই করেছেন জাসদ কেন্দ্রীয় সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তারপরও ভরাডুবি ঘটেছে তার।
ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী কামারুল আরেফিনের কাছে হেরে গেলেন তিনবারের সংসদ সদস্য ইনু। রোববার (৭ জানুয়ারি) নির্বাচনে ১৬১টি ভোটকেন্দ্রে ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী কামারুল আরেফিন পেয়েছেন এক লাখ ১৫ হাজার ৭৯৯ ভোট। নৌকা প্রতীক নিয়ে হাসানুল হক ইনু পেয়েছেন ৯২ হাজার ৪৪৫ ভোট। প্রায় ২৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন কামারুল আরেফিন। এই আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৫১ হাজার ৯৩৬ জন।
জানা গেছে, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত জাসদ থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হলেও ২০০৮ সালে এসে মহাজোট থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। এরপর ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ও ২০১৮ সালে বিএনপি-জামায়াতকে কোণঠাসা করে জয়ী হন বড় ব্যবধানে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে ইনু ২ লাখ ৮০ হাজার ৬৩৬ ভোট পান। তবে এবার এসে তার ভোটের সংখ্যা মাত্র ৯২ হাজার। তবে ইনুর নৌকাডুবির জন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাসদের দ্বন্দ্বকেই দায়ী করেছেন সাধারণ ভোটাররা। যার ফলে এবার নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীকে পেয়ে ইনুর জন্য আর ভাড়া খাটতে রাজি হননি তারা।
ভোটারদের অভিমত, শরীক দল হওয়ার সত্ত্বেও সস্পর্কের এই টানাপোড়নে হারতে হয়েছে ইনুকে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নানা কারণে দ্বন্দ্ব প্রকট হয় ইনুসহ জাসদের। যার ফলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরোধিতার মুখে পড়েন। ইনুকে চ্যালেঞ্জ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পদত্যাগ করা উপজেলা চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছরখানেক আগে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা সিদ্দিকুর রহমানকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার পর দুই দলের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়। এরপরে সেই আগুনে নতুন করে ঘি ঢালেন পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যার ঘটনা। ফের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে রাজনীতির মাঠে।
২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সকালে মাঠে কাজ করা অবস্থায় ভেড়ামারা উপজেলার চাঁদগ্রাম ইউনিয়নের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক আবদুল আলিম ওরফে স্বপন, তার ভাই চাঁদগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান যুবজোটের নেতা আবদুল হাফিজ ওরফে তপনসহ জাসদের নেতাকর্মীদের নামে হত্যা মামলা করেন সিদ্দিকুরের পরিবারের লোকজন। একদল অন্য দলের নেতাদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে মিছিল সমাবেশ করেন।
এরপর চলতি বছরের আগস্ট মাসে জাসদের সহযোগী সংগঠন জাতীয় যুবজোটের নেতাকর্মীদের হামলায় নিহত হন ভেড়ামারা পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক সঞ্জয় কুমার প্রামাণিক। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এই হত্যাকাণ্ডের পর জাসদ ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ঐক্যে ফাটল ধরে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতির মাঠ নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসন থেকে পরপর তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থকদের ভোটে তিনি নির্বাচিত হলেও তাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখেন না। উল্টো দলটির নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম করেন। এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তার ভোট করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন।
মিরপুরের বহালবাড়িয়া ইউনিয়নের সাইদুর রহমান নামে এক সাধারণ ভোটার বলেন, দুই উপজেলার মধ্যে মিরপুর উপজেলায় ভোটার সংখ্যা বেশি। নিজেদের উপজেলার মানুষ প্রার্থী হওয়ায় আমরা সেই ব্যাপারটিকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছি। এখানে মার্কা আমাদের কাছে মুখ্য ছিল না।
মিরপুর উপজেলা শহরের বাসিন্দা শামসুল হক বলেন, দুই উপজেলায় বিভক্ত ভোটার বিবেচনা করলে বিএনপিকে বাদ দিলে থাকে আওয়ামী লীগ ও জাসদ। সেক্ষেত্রে মহাজোটের অংশ হিসেবে ইনুর নৌকাকে সমর্থন দিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু সেই জোটের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বক্তব্য দিয়ে সমালোচনাই পড়েন ইনু। যার ফলাফল ভোটের মাঠ পর্যন্ত গড়িয়েছে।
কুষ্টিয়া-২ আসনের নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য ও মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামারুল আরেফিন বলেন, শুধু নির্বাচনের আগে ইনু সাহেব আওয়ামী লীগের স্মরণাপন্ন হন। তারপর ক্ষমতায় গেলে তিনি আওয়ামী লীগকে প্রতিপক্ষ ভাবেন। তখন উল্টো আমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাকে বয়কট করেছেন। যার ফলাফল তিনি হাতে-নাতে পেয়ে গেছেন।