প্রগতিশীল সাংবাদিকতার অগ্রপথিক আবুল মনসুর
গোলাম সারওয়ার : চার পরিচয়ে পরিচিত আবুল মনসুর আহমদ।একাধারে সাংবাদিক,সাহিত্যিক,রাজনীতিক এবং আইনজীবী। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। গত বছর তাঁর সাংবাদিকতার শত বছর পূর্ণ হয়েছে।তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন ১৯২৩ সালে।এই শতবর্ষ পূরণ উপলক্ষে ‘আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদ’ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর স্মরণে আলোচনা সভা করে আসছে।
এরই ধারাবাহিকতায় আজ ২৪ জানুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা “শতবর্ষে আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার প্রাসঙ্গিকতা” শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।বিষয়টি জানতে পেরে আমি সন্মানিত বক্তাদের বিশেষ করে তাঁর সুযোগ্য সন্তান ইংরেজি “ডেইলি স্টার”-এর সম্পাদক এবং প্রকাশকের স্বকন্ঠে তাঁর কিংবদন্তি পিতার কথা শোনার জন্য আগ্রহভরে অপেক্ষা করে আছি।
আবুল মনসুর আহমদ আমার একজন প্রিয় লেখক।কৈশর থেকেই আমি একটু ভারি ভারি বই পড়তে পছন্দ করতাম।স্কুলজীবনে অর্থাৎ দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় আমার বাংলার শিক্ষক ওয়াসিফ স্যারের অনুপ্রেরণায় আমি প্রথমে আবুল মনসুর আহমদের কালজয়ী ব্যঙ্গ গল্পগ্রন্থ “আয়না” পড়ি।সেই বয়সেই আমি বুঝতে পেরেছি,গল্পগুলো হাস্যরসের উপাদান থাকলেও সমাজের এক শ্রেণির ভন্ড মানুষ কীভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে,বিশ্বাসকে পুঁজি করে সরল মানুষদের প্রতারিত করছে!যা এখনো সমাজে বিদ্যমান।
পরবর্তীতে কলেজ জীবনে ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’এবং তৎপরবর্তীকালে ফুড কনফারেন্স, আবে হায়াত, আত্মকথা এগুলো পড়েছি আকর্ষণ থেকে। রাজশাহী থেকে প্রকাশিত সরকারি পত্রিকা ‘দৈনিক বার্তায়’ আমি চাকরি করার সময় (১৯৮৫-৮৬ সালের দিকে) বর্ষিয়ান সম্পাদক ছিলেন মোসলেম আলী বিশ্বাস।তাঁর ভাড়া বাড়ি ছিল আমার বাড়ির পাশে।পরিবার থাকতো ঢাকায়।তিনি প্রায় সময় বাড়িতে একাকী থাকতেন।আমি তাঁর বাড়িতে মাঝেমধ্যে যেতাম।তাঁর মুখে শুনেছি সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদের কথা।
কলকাতায় কোন এক পত্রিকায় (নাম মনে নেই) একসাথে তাঁরা সাংবাদিকতা করতেন। তিনি প্রায়ই সাংবাদিক মনসুরের সাহসের এবং নীতি-আদর্শের কথা বলতেন।আমার মনের মধ্যে স্কুল জীবন থেকেই আবুল মনসুরের প্রতি আকর্ষণের একটা জায়গা তৈরি হয়েছিল। সেই আকর্ষণ থেকেই আজকে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। আমি অতি সংক্ষিপ্তভাবে শুধুমাত্র তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের দিক নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো।
আবুল মনসুর আহমেদ রচিত “আত্মকথায়” তাঁর সাংবাদিক জীবনের হাতেখড়ির বিষয়টি উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন,ছেলেবেলায় তাঁর সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছা ছিলনা।সাহিত্যিক হওয়ার ইচ্ছাটা ছিল প্রবল।খবরের কাগজ কেমন করে বের হয়,কীভাবে প্রকাশ করে এসব নিয়ে জানার তেমন আগ্রহ ছিলনা।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,”স্কুলজীবনে ময়মনসিংহ শহর হইতে প্রকাশিত একমাত্র সাপ্তাহিক “চারু-মিহি” ছাপা হইতে দেখিয়াছি।বিস্মিত হইয়াছি।কিন্তু আকৃষ্ট হই নাই।সাংবাদিক হওয়ার সাধ জন্মানোর জন্য ঐটুকু অভিজ্ঞতা যথেষ্ট নয়”।কিন্তু পরবর্তীতে তিনি যে সাংবাদিকতার উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন শতবর্ষ পরে আজো তা দীপ্যমান এবং প্রাসঙ্গিক।
শিক্ষাজীবন শেষ করার পর তিনি চাকরি খুঁজতে থাকেন। সেই সময় কলকাতা ছিল চাকরির বাজার।রোজগারের উদ্দেশ্যে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে ১৯২২ সালে পাড়ি জমালেন কলকাতায়। তখন কলকাতা ছিল খবরের কাগজের কেন্দ্রস্থল।চাকরি ও সাহিত্যসেবা এই দুই ধরনের কাজ একত্রে খবরের কাগজেই পাওয়া সম্ভব,এই মনে করে তিনি সাংবাদিকতা পেশাকেই অগ্রাধিকার দিয়ে এগুতে থাকেন।
কলকাতায় তিনি পেলেন বাল্যবন্ধু আবুল কালাম শামসুদ্দিনকে।তিনি তখন সাপ্তাহিক ‘মুসলিম জগত’ পত্রিকার সম্পাদক।তিনি তাকে চা-নাস্তা, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।এই বদান্যতায় তাঁর পত্রিকায় সহযোগিতা করাকে তিনি কর্তব্য বলে মনে করলেন।
এই কর্তব্যই শেষ পর্যন্ত তাঁকে সুযোগ করে দিল। তিনি মুসলিম জগতে ছোট ছোট সম্পাদকীয়, মন্তব্য এবং বড় বড় প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন।এই লেখালেখির কারণে ধীরে ধীরে তিনি সাংবাদিক সমাজে পরিচিত হয়ে উঠেন।এরই মধ্যে একটি দীর্ঘ দার্শনিক রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখে তিনি মুসলিম সাংবাদিকদের নজরে পড়েন।কতকটা এই কারণে,কতকটা শামসুদ্দিন সাহেবের চেষ্টায় ত্রিশ টাকা বেতনে তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের পথচলা শুরু হলো মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সাপ্তাহিক “ছোলতান” পত্রিকায়।পদ ছিল সহ-সম্পাদক।সালটি ছিল ১৯২৩।
পরে তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে কর্তৃপক্ষ দশ টাকা বৃদ্ধি করে চল্লিশ টাকা বেতন করে।মওলানা সাহেবের স্নেহ ও আস্থাভাজন হয়ে সেখানে তিনি দেড় বছর বেশ সুখেই ছিলেন বলে ‘আত্মকথায়’ উল্লেখ করেন।সেখান থেকে চলে আসার পর ১৯২৪ সালে তিনি মওলানা আকরম খাঁ’র সাপ্তাহিক “মোহাম্মদীতে” পঞ্চাশ টাকা বেতনে চাকরি পান। এইখানে তিনি প্রচুর খাটা খাটনি করতেন বলে ‘আত্মকথায়’ উল্লেখ করেন। প্রতি সপ্তাহে দু’টি করে মাসে আটটা সম্পাদকীয় লিখতে হতো।দুইজন সিনিয়র থাকতেও প্রায় সমস্ত কাজ তাঁকে দেখতে হতো।এতে তিনি খুশিই ছিলেন।
এই পত্রিকায় তিনি রক্তচক্ষু, বজ্রমুষ্ঠি,সিংহনিনাদ ইত্যাদি ধরনের বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী উদ্দীপক হেডিং দিয়ে একাধারে ওজস্বিতা ও যুক্তিপূর্ণ বহু সম্পাদকীয় লিখে সাংবাদিকমহলে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। মওলানা আকরম খাঁরও প্রশংসা অর্জন করেন।এখানে তিনি নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ পান।
এই সাপ্তাহিকীতে সম্পাদকীয় ছাড়াও তাঁকে সংবাদ ব্যবস্থাপনা ও সম্পাদনা,হেডিং লেখা,সংবাদের ট্রিটমেন্ট, মফস্বল বিভাগের সমস্যা,প্রুফ রিডিং, গেটআপ-মেকাপ ইত্যাদি করতে হতো।এমনকী কম্পোজিটর,প্রেসের মেশিনম্যান তাদের তত্ত্বাবধানও করতে হতো তাঁকে।এখানে দেড় বছর খুব সুখে ও উৎসাহে থাকার পর ১৯২৬ সালে হঠাৎ করে সেখান থেকে তাকে চাকরি ছাড়তে হয়।
কেন চাকরি গেল,কী অপরাধ ছিল সেই মুহূর্তে কিছুই তিনি জানতে পারেননি।অবশ্য পরে বুঝতে পারেন।১৯২৫ সালের শেষের দিকে মওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী ‘সত্যাগ্রহী’ নামে একটি সাপ্তাহিক বের করেন।’মোহাম্মদীতে’ থাকা অবস্থায় তিনি ঘন ঘন সেখানে যাতায়াত করতেন। মাঝেমধ্যে লেখাটেখা দিয়েও সহযোগিতা করতেন।বিষয়টি আকরাম সাহেব টের পান। এতে তিনি অসন্তুষ্ট হন।সে সময় কোন মুসলমান বাংলা কাগজ বের করলে মওলানা সাহেব নাখোশ হতেন। অবশ্য এর কিছু যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল বলেও তিনি ‘আত্মকথায়’ উল্লেখ করেন।শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা থাকা সত্বেও সেখান থেকে চাকরি ছেড়ে আসতে হয়।
“মোহাম্মদী” থেকে চাকরি ছাড়ার পর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯২৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।কিছুকাল পর কলকাতায় ফিরে গিয়ে তিনি ‘দি মুসলমান’-এ সাব এডিটর হিসেবে যোগদান করেন।সম্পাদক ছিলেন মৌলবী মুজিবর রহমান।তিনি আগে থেকেই তাকে (মনসুর) জানতেন।মৌলবী সাহেবের প্রতি তিনি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ ছিলেন।কারণ,মোহাম্মদী থেকে চাকরি চলে যাওয়ার পর তাঁর বিবাহের জন্য এক মাসের অগ্রিম বেতন দিয়ে তাঁকে বিবাহের পর এসে সেখানে যোগদান করতে বলেন।
এখানে সম্পাদক সাহেব সাব এডিটরের সাধারণ কাজ ছাড়াও তাঁকে দিয়ে এডিটরিয়েল নোট লিখাতেন এবং শুদ্ধ করে দিতেন।এইভাবে দিনে দিনে তিনি সম্পাদক সাহেবের বিশ্বাস এবং আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন।মৌলবী সাহেব সকল সাংবাদিককে পত্রিকায় লেখালেখিতে শিষ্টাচার ও ভদ্রতার বিষয়ে অনেক উপদেশ দিতেন।পরবর্তীতে মৌলবী সাহেবের সেইসব উপদেশগুলো পথের দিশারিরূপে কাজ করেছে বলে ‘আত্মকথায়’ উল্লেখ করেন।তিনি আরো উল্লেখ করেন,অতি সুখে শান্তিতে,মানে মর্যাদায় একাদিক্রমে চার বছর দি মুসলমানে তিনি কাজ করেছেন।
এর পর পরই ‘দি মুসলমানের’ মালিক মৌলবী মুজিবর রহমান আবুল মনসুরকে লক্ষ্য করেই আরেকটি বাংলা সাপ্তাহিক বের করলেন। নাম দিলেন “খাদেম”। এখানে মৌলবী সাহেব তাঁকে সম্পাদনা এবং পরিচালনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিলেন।বেতন পেতেন পঁচাশি টাকা।কিন্তু এই পঁচাশি টাকায় সংসার চালানো তার জন্য কষ্টকর হয়ে উঠে। তাই তিনি বেশি রোযগারের আশায় সাংবাদিকতা ছেড়ে দেশে গিয়ে ওকালতি করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
এ বিষয়ে তিনি আত্মকথায় উল্লেখ করেন,” ঐ পঁয়ষট্টি টাকা যথেষ্ট নয় মনে করিয়া আমি ময়মনসিংহে উকালতি করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করি।ইতিমধ্যে একটি ছেলে হইয়াছে। বাড়ির অবস্থাও অধিকতর খারাপ হইয়াছে। বাপজী আরো দেনাগ্রস্ত হইয়াছেন। কাজেই বেশি টাকা রোজগারের আশায় সাংবাদিকজীবন ছাড়িলাম”। এইভাবে ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে তার সাংবাদিক জীবনের প্রথম পর্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটলো।
এরপর দশ বছর কেটে যায় দেশে। সাংবাদিকতার টানে ফের তিনি চলে যান কলকাতায়। ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে নিখিল বঙ্গ কৃষক-প্রজা সমিতির উদ্যোগে কৃষক প্রজা আন্দোলনের মুখপত্ররূপে প্রকাশ হয় ‘দৈনিক কৃষক’। তিনি সেখানে সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ পান।মাসিক দুই শ’ টাকা বেতন এবং পঞ্চাশ টাকা টেবিল এলাউন্স। অল্পদিনের মধ্যেই কাগজটি পাঠকপ্রিয়তা পেল। এই পত্রিকার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু।এক বছর চলার পর নানা অব্যবস্থাপনায় পত্রিকাটিতে আর্থিক সঙ্কট দেখা দিল। এই সংকট তাকেও ভাবিয়ে তুললো। যা করতে তিনি অভ্যস্ত না,সেই কাজ তিনি করা শুরু করলেন। অন্যান্য পরিচালকদের সাথে তিনিও নেমে পড়লেন আর্থিক সঙ্কট দূরীভূত করার কাজে।কিন্তু কাজটি কঠিন বলে তাঁর মনে হলো।
এ প্রসঙ্গে ‘আত্মকথায়’ তিনি বলেন, “সম্পাদকরা লেখক,ভাবুক।শিল্পী। টাকা-পয়সা ঝামেলার মত বৈষয়িক ও ব্যবসায়িক ব্যাপার তাদের চোখে নিতান্ত অশিল্পী দোকানদারি ব্যাপার। নিম্নশ্রেণীর বিষয়।এতদিন ছিল এই আমার ধারণা।এখন বুঝিলাম অশিল্পী অসুন্দর হইলেও এই ব্যবসায়ি দিকটাই আসল”। এর মধ্যে নানা অঘটন ঘটলো।পরিচালক বদল হলো।নীতিগত বিরোধ চরমে উঠলো।নীতির প্রতি তিনি ছিলেন আপোষহীন। এই অবস্থায় তিনি পদত্যাগ করলেন। তিনি সেখানে তিন বছর সম্পাদকতা করেছেন।
এরপর ১৯৪১ সালের অক্টোবরে শেরে বাংলা ফজলুল হকের ‘নবযুগ’ নবপর্যায়ে বের হয়।নবযুগ বের হবার মাসাধিককাল আগে থেকেই হক সাহেব পত্রিকা প্রকাশ করার উদ্দেশ্যর কথা তাঁকে বলেন এবং সহযোগিতা দাবি করেন। তাঁর কলমের উপর হক সাহেবের আস্থা ছিল। তিনি সেখানে অক্টোবর মাসে যোগদান করেন।হক সাহেব চেয়েছেন তিনি যেন সম্পাদক হন।তবে সম্পাদক হিসাবে কাগজে তার নাম থাকুক,এটা তিনি চাননি। অবশ্য সম্পাদনার দায়িত্ব তিনি নিয়েছিলেন।তিনি তাঁর বন্ধু কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাম সম্পাদক হিসাবে প্রস্তাব করেন।
‘আত্মকথায়’ তিনি বলেন যে,তিনি জানতেন পত্রিকাটি বেশিদিন স্থায়ী হবেনা। কারণ,তার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি দেখেছেন, রাজনৈতিক নেতাদের কাগজ কখনো স্থায়ী হয়না। সাড়ে তিনশ’ টাকা বেতনে পত্রিকা সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে নজরুল ইসলাম সম্মত হলেন। সে সময় তার আর্থিক অবস্থা খারাপ চলছিলো। বেশ ধুমধামের সাথে পত্রিকা চলতে থাকলো। এ সময় তিনি হক সাহেবের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়লেন। অন্তত ‘নবযুগ’-এর জন্যও হক সাহেবের প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন রাজনীতিকে সফল করার তাগিদ থেকে তিনি সম্পাদকীয় লিখতে লাগলেন বলে ‘আত্মকথায়’ উল্লেখ করেন।ইতোমধ্যে নজরুল ইসলামের ব্যক্তিগত নানাবিধ সমস্যা দেখা দিল।
এমন অবস্থা হলো,শেষ পর্যন্ত তিনি অফিসে আসাও বন্ধ করে দিলেন।পত্রিকারও আর্থিক দূরাবস্থা দেখা দিল।এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য হক সাহেব মি: হেমেন্দ্রনাথ দত্ত নামে একজনকে মালিকানায় নিয়ে আসলেন।এই দত্ত সাহেবের সাথে তাঁর পূর্ব পরিচয় ছিল।তখন থেকেই তার সাথে বনিবনা হতোনা।হীন মানসিকতার কারণে তার সাথে আদর্শগত বিরোধ চরম পর্যায়ে চলে গেল।এরই মধ্যে মনসুর সাহেব কঠিন আমাশয়ে আক্রান্ত হলেন।
ডাক্তারের পরামর্শে তিনি হক সাহেবের নিকট থেকে এক মাসের ছুটি নিয়ে সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। ছুটির পনের দিন যেতে না যেতেই এক টেলিগ্রাম বার্তায় জানলেন, নবযুগে তার চাকরি নেই। এ বিষয়ে ‘আত্মকথায়’ তিনি উল্লেখ করেন,”ছুটিতে যাওয়ার পর হইতেই মি: দত্ত হিন্দু মন্ত্রীদিগকে দিয়া আমাকে সরাইবার জন্য হক সাহেবের উপর চাপ দেওয়া শুরু করেন।হক সাহেব শেষ পর্যন্ত রাজি হন”।এখান থেকেই তাঁর সাংবাদিক জীবনের তৃতীয় পর্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।
সাংবাদিক জীবনের চতুর্থ এবং শেষ পর্যায়ে তিনি সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন ‘দৈনিক ইত্তেহাদ-এ’।বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আবুল মনসুরকে সম্পাদক করে একটি বাংলা দৈনিক বের করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মনসুর সাহেব সেই সময় কলকাতার আলীপুরে ওকালতি করতেন। শহীদ সাহেব সবকিছু বিবেচনা করে তাঁর মতামত নিয়ে এক হাজার টাকা বেতন-ভাতা নির্ধারণ করেন।
সময়টা ছিল ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাস।তিনি সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর পঁচিশ বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার সবটুকু প্রয়োগ করে আন্তরিকতার সাথে কাজে নেমে পড়েন। দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠে ইত্তেহাদ। এই সময়ে তাঁর সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ সাতটি বাণী তাঁর ‘আত্মকথায়’ বলে গেছেন, যা সাংবাদিকতা জগতে চিরজাগরুক হয়ে থাকবে।
(১) সাংবাদিকতা নিছক সংবাদ সরবরাহ নয়, সংবাদের সুষ্ঠু ব্যাখ্যাও বটে।
(২) সাংবাদিকতার সাথে রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাজনীতিতে পার্টিগত শ্রেণীগত মতভেদ অপরিহার্য। কিন্তু এই মতভেদ সত্ত্বেও সাধু সাংবাদিকতা সম্ভব।
(৩) বিরুদ্ধ পক্ষকে অভদ্র কটুক্তি না করিয়াও তার তীব্র সমালোচনা করা যাইতে পারে ভদ্রভাষায়। বস্তুত সমালোচনার ভাষা যত বেশি ভদ্র হইবে, সমালোচনা তত তীক্ষ্ণ ও ফলবতী হইবে।
(৪) প্রত্যেক মতবাদের সুষ্ঠু, উদার, বৈজ্ঞানিক ও নিরপেক্ষ আলোচনার দ্বারা নিজের মতের পক্ষে এবং বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে জনমত তৈয়ার করা অধিকতর সহজসাধ্য।
(৫) মরহুম মৌলবী মুজিবর রহমান বলিতেন : সংবাদপত্রের কেবলমাত্র সম্পাদকীয় কলমটাই সম্পাদকের; বাকি সবটুকুই পাবলিকের। চিঠিপত্র কলমটা টাউন হল, সম্পাদকের বৈঠকখানা নয়। অতএব সংবাদ প্রকাশে নিরপেক্ষতা চাই। স্বয়ং সম্পাদকের নিন্দা-পূর্ণ পত্রও চিঠিপত্র কলমে ছাপিতে হইবে।
(৬) সাংবাদিকতা সাহিত্য, আর্ট, সায়েন্স, ইন্ডাস্ট্রি ও কমার্সের সমবায়। এর একটার অভাব হইলে সাংবাদিকতা ত্রুটিপূর্ণ এবং পরিণামে নিষ্ফল হইবে।
(৭) বিখ্যাত সাহিত্যিক থেচারে বলিয়াছেন : ছাপার মেশিনের মত সংবাদপত্র নিজেও একটা ইঞ্জিন। সকল যন্ত্রপাতির ঐক্য ও সংহতি অন্যান্য ইঞ্জিনের মত প্রেস ইঞ্জিনেরও অত্যাবশ্যক বটে, কিন্তু তার উপরেও প্রেস ইঞ্জিনে দরকার ইনটেলেকচুয়াল ইউনিটি।
‘আত্মকথায়’ তিনি আরো উল্লেখ করেন,এই সাতটি দফা ছিল বলিতে গেলে আমার জন্য সাংবাদিকতার ক, খ। কিন্তু আমার এইটুকু জ্ঞান লাভ করিতে-করিতে সাংবাদিকতা ঘোড়-দৌড়ে অনেক আগাইয়া গিয়াছিল। আমি পঁচিশ বছর আগে যখন সাংবাদিকতা শুরু করি, তখন সাংবাদিকতা ছিল একটা মিশন। প্রাইভেট স্কুল, হাসপাতাল চালাইবার মত একটা ব্যাপার। আর ১৯৪৭ সালে সাংবাদিকতা হইয়া উঠিয়াছিল একটি পূর্ণমাত্রার ইন্ডাস্ট্রি।
এই সম্প্রসারণের ফলে সংবাদপত্র আর সম্পাদকের মন্তব্যসহ খবরের কাগজ মাত্র ছিল না। সাহিত্য শাখা, মহিলা শাখা, শিশু শাখা, সিনেমা শাখা, নগর পরিক্রমা ও খেলাধুলা ইত্যাদি বিভিন্ন ফিচার দিয়া আজকাল দৈনিক খবরের কাগজকে রীতিমত আকর্ষণীয় পঠিতব্য সাহিত্য করিয়া তোলা হইয়াছে। এই সমস্ত বিভাগ মোটামুটি অটনোমাস। সকল বিভাগের পৃথক-পৃথক সম্পাদক আছেন।
কাজেই দৈনিক সংবাদপত্রের আর এখন একজন মাত্র সম্পাদক নাই, বহু-সংখ্যক সম্পাদক হইয়াছেন। ফলে কাগজের সম্পাদককে এখন আর শুধু সম্পাদক বলা চলে না। প্রধান সম্পাদক, এডিটর-ইন-চিফ অথবা চিফ এডিটার বলা হইয়া থাকে। এর ফলে আধুনিক দৈনিক খবরের কাগজের সম্পাদক কম-বেশি কনস্টিটিউশন্যাল মনার্কের মতই ফিগার-হেড মাত্র। সকর্মক দায়িত্ব তার সম্পাদকীয় লেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দৈনিক খবরের কাগজের বিষয়-বস্তুর এই পরিব্যাপ্তি আমাদের দেশে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হইতেই শুরু হয়।
তিনি হতাশা এবং দুঃখ প্রকাশ করে আরো বলেন,”আমি যে যুগে সাংবাদিকতা করিয়াছি, তখন মুসলমানের পক্ষে সাংবাদিকতা করা খুব দুরূহ ব্যাপার ছিল। বিশেষত বাংলার মুসলমানের সামনে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতই সাংবাদিকতার ক্ষেত্রও অতি ক্ষুদ্র ছিল। সংবাদপত্র যতই ইন্ডাস্ট্রিতে রূপান্তরিত হইতে লাগিল, মুসলমানের পক্ষে উহা ততই কঠিন হইতে থাকিল। খুব স্বাভাবিক কারণেই মুসলমান যুবকদের হিন্দু সংবাদপত্রে কাজ পাওয়া একরূপ অসম্ভব ছিল। নিজস্ব দৈনিক কাগজ বাহির করার মত টাকাও মুসলমানের ছিল না।
প্রধানত অর্থাভাবেই বহুকাল বহু মুসলিম নেতাদের এদিককার চেষ্টা ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে। আমার আমলেই মওলানা মো. আকরম খাঁ সাহেবের দৈনিক সেবক ও দৈনিক মোহাম্মদী ও মওলানা ইসলামাবাদী সাহেবের দৈনিক ছোলতান, স্যার এ কে গযনবীর দৈনিক তরক্কী, মৌ. এ কে ফজলুল হক সাহেবের দুই পর্যায়ের নবযুগ, অধ্যাপক হুমায়ুন কবিরের দৈনিক কৃষক প্রভৃতি বাংলা দৈনিক, স্যার আবদুর রহিমের মুসলিম স্ট্যান্ডার্ড মৌ. মুজিবর রহমান সাহেবের দৈনিক দি মুসলমান ও কমরেড প্রভৃতি ইংরাজি দৈনিক বাহির হইয়া বন্ধ হইয়াছে। এর ফলে একদিকে যেমন মুসলিম বাংলায় দৈনিক সংবাদপত্রের অভাব ছিল, ঠিক তেমনি সাংবাদিকেরও অভাব ছিল।
আগেই বলিয়াছি, হিন্দু সংবাদপত্রে মুসলিম শিক্ষার্থীদের চান্স ছিল না। এটা আমি এত তীব্রভাবে অনুভব করিতাম যে, যখনই সম্ভব ও সাধ্য হইয়াছে, তখনই ইহার প্রতিকার করিবার চেষ্টা করিয়াছি। বাছিয়া-বাছিয়া মুসলমান নিয়াছি। অধিকতর যোগ্য হিন্দু বাদ দিয়া অপেক্ষাকৃত অযোগ্য মুসলমানকে চাকুরি দিয়াছি। এতে হিন্দুর প্রতি আমার কোনও বিদ্বেষ ছিল না।
শুধুমাত্র মুসলমান যুবকদের সাংবাদিকতায় উদ্বুদ্ধ করিবার জন্যই এ কাজ করিয়াছি।তা ছাড়া আমার সম্পাদিত কৃষক ও নবযুগ উভয়টাই ছিল বিঘোষিত নীতি ও মতবাদের দিক দিয়াও অসাম্প্ৰয়িক দৈনিক কাগজ। তবু ঐ দুটি কাগজের সম্পাদকীয় বিভাগে লোক নিয়োগ করিবার সময় আমি মুসলমান প্রার্থীকে প্রাধান্য দিয়াছি।
ইহাতে আমার অনেক হিন্দু সাংবাদিক বন্ধু ও হিতৈষী আমার এই কাজে অসন্তোষ প্রকাশ করিয়াছেন। আমি সরলভাবে তাঁদের কাছে আমার উদ্দেশ্য বর্ণনা করিয়াছি। অনেক দূরদর্শী হিন্দু বন্ধু আমার কথা বুঝিয়াছেন। এইভাবে আমি যখনই ক্ষমতা ও সুযোগ পাইয়াছি, তখনই মুসলিম যুবদিগকে সাংবাদিকতায় উদ্বুদ্ধ করিবার চেষ্টা করিয়াছি।
যখন ইত্তেহাদ এর স্টাফ নিয়োগের ক্ষমতা আমার হাতে আসিল, তখন ইহাকে আমি মুসলিম সাংবাদিক গোষ্ঠী গড়িয়া তুলিবার অপূর্ব সুযোগ মনে করিলাম। সে সুযোগের সাধ্যমত সদ্ব্যবহার করিলাম। সাংবাদিকতা-শিক্ষার্থী উচ্চ-শিক্ষিত যুবকরা দলে-দলে আসিয়া ভিড় করিল। কতকালের বুভুক্ষা লইয়া যেন তারা অপেক্ষা করিতেছিল। মুসলিম শিক্ষিত যুবকরা সাংবাদিকতা লাইনে আসিতে চায় না বলিয়া কোনও-কোনও কাগজের কর্তারা যে অভিযোগ করিতেছিলেন, মুসলিম যুবকদের বিরুদ্ধে ঐ অভিযোগ যে মিথ্যা এলাম,এটা স্পষ্ট প্রমাণিত হইয়া গেল।
আমি শুধু সম্পাদকীয় বিভাগে যে পঁচিশ ছাব্বিশ জন লোক নিয়োগ করিলাম তার মধ্যে কুড়িজনই ছিলেন গ্র্যাজুয়েট, তাঁদের দশ-বারজন ছিলেন এমএ। সরকারি চাকুরির প্রতি মুসলমান যুবকদের টান বেশি, এই অভিযোগের উত্তরে বলিতে চাই যে, উপযুক্ত পঁচিশ-ছাব্বিশজনের মধ্যে চৌদ্দ-পনেরজনই ছিলেন সরকারি কর্মচারী। তারা সাংবাদিকতায় হাত পাকান সাপেক্ষে সরকারি চাকুরি করিয়া যাইতেছিলেন মাত্র। আমি ইত্তেহাদ-এ তাদের চাকুরি কনফার্ম করামাত্র অধিকাংশই সরকারি চাকুরিতে ইস্তাফা দিতে প্রস্তুত হইয়াই আসিয়াছিলেন।
এই ব্যাপারে তাঁরা এতই দৃঢ় ছিলেন যে, মুসলমান সরকারি কর্মচারীরা ইত্তেহাদ-এর সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করিতেছেন বলিয়া কলিকাতার বিভিন্ন সংবাদপত্রে যখন আন্দোলন শুরু হয় এবং দৈনিক বসুমতী যখন তাদের নাম-ঠিকানা পর্যন্ত প্রকাশ করিয়া দেন, তখনও উহাদের অধিকাংশেই অবিচলিত থাকেন।
শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ অন্যান্য শিল্প-মালিকদের মত সংবাদপত্রের কর্তারাও ষোল আনা গ্রহণ করিতেন। কাজেই সংবাদপত্রের স্টাফের বেতন ছিল অত্যন্ত কম। বেতনের অল্পতার জন্যই শিক্ষিত যুবকরা সহজে সাংবাদিকতার দিকে আকৃষ্ট হইত না।
হিন্দু যুবকরা যে মুসলমান যুবকদের চেয়ে বেশি সংখ্যায় ঐ অল্প বেতনে চাকুরি করিতেছে, তা তারা ঐ অল্প বেতনে সন্তুষ্ট বলিয়া নয়, শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা হিন্দু সমাজে বেশি বলিয়া। কাজেই আমি ইত্তেহাদ এর স্টাফের এমন বেতনের সুপারিশ করিলাম, যা তাদের প্রয়োজনের মিনিমাম।এইভাবে অনেক অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের সমন্বয়ে ইত্তেহাদ পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে গেল।
অবশেষে ইত্তেহাদের আকাশে কালো মেঘ দেখা গেল।ইত্তেহাদ-এর অপমৃত্যুর বিষয়ে বলতে গিয়ে আবুল মনসুর তাঁর ‘আত্মকথায়’ এভাবে বলেন,দেশভাগের পর আমরা মুসলিম সংবাদপত্রেরা সকলেই কাল-বিলম্ব না করিয়া ঢাকায় আসিবার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগিলাম। কিন্তু পূর্ব বাংলার মন্ত্রিসভার নিকট আমরা ইত্তেহাদ ওয়ালার কোনও অভ্যর্থনা বা সহানুভূতি পাইলাম না। সহানুভূতি বা অভ্যর্থনা আমরা আশাও করি নাই। কারণ ইত্তেহাদ সোহরাওয়ার্দী সমর্থক কাগজ হিসাবে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভায় বিরোধীদলের সংবাদপত্র ছিল। কাজেই আমরা তাদের কোন বিশেষ অনুগ্রহ চাই নাই। শুধু সরকারের মামুলি দায়িত্ব পালনই আশা করিয়াছিলাম। কিন্তু পূর্ব বাংলার মন্ত্রিসভা আমাদের জবাব দিলেন ইত্তেহাদ-এর পূর্ব বাংলা প্রবেশ নিষিদ্ধ করিয়া।
প্রথমবারের নিষেধাজ্ঞা অবশ্য মাত্র পনের দিন স্থায়ী হইয়াছিল। কিন্তু এটাই সবেমাত্ৰ-আত্মপ্রতিষ্ঠ ইত্তেহাদ-এর আর্থিক মেরুদণ্ডে বিশাল আঁকি লাগাইয়াছিল। কারণ, ইত্তেহাদ-এর বিপুল সার্কুলেশন, সুতরাং এই বাবত আয়ের, চৌদ্দ আনাই ছিল পূর্ব বাংলার। এই আঘাত সামলাইয়া উঠিতে-না উঠিতেই আরো দুই-দুইবার ইত্তেহাদ-এর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হইল। এই দুইবারই দীর্ঘদিনের জন্য এবং শেষবারের অনির্দিষ্টকালের জন্য ইত্তেহাদ-এর পূর্ব বাংলা প্রবেশ নিষিদ্ধ হইয়াছিল।
এই মুদ্দতে ইত্তেহাদ-এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর নবাবযাদা সৈয়দ হাসান আলী নিজে একাধিকবার ঢাকা আসিয়া ইত্তেহাদ-এর জন্য বাড়ি ভাড়া করিয়া ও তাতে প্রয়োজনীয় মেরামত করিয়া প্রচুর অর্থব্যয়ও করিয়াছিলেন। কিন্তু পূর্ব বাংলা সরকার তাঁর কাজে পদে-পদে বাধা সৃষ্টি করিয়া বিশেষত বিজলি সংস্থাপনের অসহযোগিতা করিয়া নবাবযাদার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করিয়া দেন।এইভাবে ১৯৫০ সালের গোড়ার দিকে ইত্তেহাদ-এর অপমৃত্যু ঘটে। কিন্তু এটাও সত্য যে, দেশভাগ হওয়ার পরে ভারতের ভূখণ্ড হইতে পাকিস্তানি খবরের কাগজ বাহির হওয়ার কোনও যুক্তিও ছিল না।
তাঁর সাংবাদিক জীবনের অবসান প্রসঙ্গে ‘আত্মকথায়’ বলেন,”ইত্তেহাদ-এর মৃত্যুর পর আমারও সাংবাদিক জীবনের অবসান ঘটে। ১৯৫০ সাল হইতে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত চব্বিশ বছর ইংরাজি-বাংলা কাগজের কলামিস্ট হইয়া থাকাতেই আমার সাংবাদিকতা সীমাবদ্ধ ছিল। এটা ঘটে অবস্থাগতিকেই! পরিবার রক্ষার জন্য উকালতি ও পাকিস্তান রক্ষার জন্য রাজনীতি ধরিতে হইল।
পেশায় ব্যস্ত উকিল ও রাজনীতিতে মেম্বর-মন্ত্রী হইলাম। জেল-যুলুমও খাঁটিতে হইল। এত ব্যস্ততায় সাহিত্য-সাধনা বিশেষ ব্যাহত হইল না সত্য, কিন্তু সাংবাদিকতায় কলামিস্টের বেশি কিছু হওয়া গেল না।
ঢাকার সম্পাদক-সাংবাদিকদের অধিকাংশই আমার কলিকাতার সাংবাদিক-জীবনের বয়ঃকনিষ্ঠ স্নেহাস্পদ সহকর্মী। হাজার ব্যস্ততার অজুহাতেও তাঁদের উপরোধ এড়ান গেল না। কলামিস্ট হইতে হইল”।
সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদের স্বমহিমায় ভাস্বর সাংবাদিকতা জীবনের পর্যালোচনা করে এককথায় বলা যায়, শতবর্ষ পর আজো সাংবাদিকতার মাপকাঠিতে তাঁর কর্মযজ্ঞ চিরঅব্যয়, চিরঅক্ষয়।
পরিচিতি: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক,সাবেক সভাপতি,রাজশাহী প্রেসক্লাব।