ভালো নেই ব্যাংক খাত
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : এই মুহূর্তে ভালো নেই ব্যাংক খাত। সীমাহীন অনিয়ম, দুর্নীতি এবং লুটপাটের কারণে গ্রিনের (ভালো) চেয়ে লাল (অতি দুর্বল) ও হলুদ (দুর্বল) বাতি জ্বলা ব্যাংকের সংখ্যাই বেশি। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি গোপন প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর হইচই পড়ে যায়। এরপর এ নিয়ে শুরু হয় লুকোচুরি এবং পালটাপালটি অভিযোগ।
এমনকি, গত সপ্তাহের শেষের ২ দিন গণমাধ্যমকর্মীদের বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। নানা জেরার মুখোমুখি হতে হয় সাংবাদিকদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি, এটা পুরো খাতের চিত্র নয়। প্রতিবেদনটি গবেষণার জন্য করা হয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, সম্প্রতি গণমাধ্যমে ব্যাংকগুলোর লাল, হলুদ ও সবুজ তালিকাভুক্তির যে প্রতিবেদন ছাপা হয় তা ব্যাংকের স্বাস্থ্য দেখার কোনো সঠিক পদ্ধতি নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগ নানা সময়ে ব্যাংকের তালিকা করে থাকে। এই তালিকাটা ধারণাভিত্তিক। যেখানে কোন পরিস্থিতি হলে কী হবে, তা বিবেচনায় নেওয়া হয়। এটা গবেষণার কাজে ব্যবহার হয়। ব্যাংকের স্বাস্থ্য দেখার একমাত্র উপাদান নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন, যা ‘ক্যামেলস’ পদ্ধতির মাধ্যমে দেখা হয়।
প্রায় অভিন্ন মন্তব্য ব্যাংক পরিচালকদের পক্ষ থেকেও আসে। ব্যাংক পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, এটা ভুল প্রতিবেদন। এর কোনো বাস্তবতা নেই।
ব্যাংক থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে যাচ্ছেন পরিচালকরা সে কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে, ব্যাংক দুর্বল হচ্ছে। এর দায় কি এড়াতে পারবেন? এমন প্রশ্নে বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, এটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। এটা দেখবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমরা টাকা-পয়সা নিইনি। কোনো প্রমাণ আছে? ব্যাংক খাতে কোনো অনাস্থা নেই। যদি তাই হতো তবে ১০টি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যেত।
তিনি বলেন, ৯টি ব্যাংক রেড জোনে, ২৯টি ব্যাংক ইউলো জোনে এবং ১৬টি ব্যাংক গ্রিন জোনে যাওয়ার প্রতিবেদনটি সঠিক নয়। এটা একটা অবাস্তব প্রতিবেদন। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, সীমান্ত ব্যাংকের মতো একটি ছোট্ট ব্যাংক গ্রিন জোনে আর ব্র্যাক ব্যাংক ইয়েলো জোনে-এটা হতে পারে? এত ব্যাংক একসঙ্গে ইয়েলো জোনে-এটা কখনওই সম্ভব নয়। প্রতিবাদ জানিয়েছি। গভর্নর দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আর হাজার হাজার পরিচালকের মধ্যে দু-একজন খারাপ থাকতেই পারেন। এজন্য সব পরিচালককে দোষ দেওয়া যাবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলেন, এক্সিম ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ‘আমি নজরুল ইসলাম মজুমদার’ টাকা নিয়েছি, এটা কেউ প্রমাণ করতে পারলে করেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, প্রতিবেদন গবেষণার জন্য নাকি অন্য কিছুর জন্য সেটা আলাদা বিষয়। মূল কথা হলো-ব্যাংক যেটার যে মান সেটাই তো দেওয়া হয়েছে। এখানে অস্বীকার করার কিছু নেই। দেশের ব্যাংক খাত কেমন আছে এটা সবাই কম-বেশি জানেন। যারা অস্বীকার করছেন, তারাও জানেন ব্যাংক খাত ভালো নেই।
তিনি একটি উপমা দিয়ে বলেন, কয়েকদিন আগে একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান অর্থমন্ত্রীকে বলছেন, স্যার আপনারা বলেন ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ৮-৯ শতাংশ। প্রকৃত খেলাপি ঋণ কত তা তো আমরাই জানি কিন্তু প্রকাশ করতে পারি না। ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আরও বলেন, একটা দেশের ব্যাংক খাত এত খেলাপি ঋণ নিয়ে কীভাবে চলে এটা বুঝে আসে না। খেলাপি ঋণের এসব টাকা ডলারে কনভার্ট হয়ে ইউরোপ-আমেরিকা চলে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতকে ভালো এবং সুস্থ বলার সুযোগ খুব কম। এখন দোষারোপ এবং লুকোচুরি না করে উত্তরণের পথ খুঁজে নিতে হবে। এর জন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুবই জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংক হেলথ ইনডেস্ক অ্যান্ড হিট ম্যাপ’ শীর্ষক এক গোপন প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যাংকের অবস্থাই দুর্বল এবং অতি দুর্বল। এর মধ্যে ১২টির অবস্থা খুবই নাজুক, যার ৯টি ইতোমধ্যে রেড জোনে চলে গেছে। অপর ৩টি রেড জোনের খুব কাছাকাছি থাকলেও তাদের অবস্থান ইয়েলো জোনে। এর বাইরে আরও ২৬টি ইয়েলো জোনে অবস্থান করছে। অন্যদিকে মাত্র ১৬টি ব্যাংক গ্রিন জোনে স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে ৮টিই বিদেশি ব্যাংক। অর্থাৎ গ্রিন জোনে দেশীয় ব্যাংকের সংখ্যা মাত্র ৮টি। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিচারে রেড জোনের ব্যাংকগুলো সবচেয়ে খারাপ (পুওর) এবং ইয়েলো জোনের ব্যাংকগুলো দুর্বল (উইক)। আর গ্রিন জোনের ব্যাংকগুলো ভালোমানের (গুড)। অর্থাৎ দেশে এখন সবলের চেয়ে দুর্বল ব্যাংকের সংখ্যাই বেশি।
এতে দুর্বল ব্যাংকগুলোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। ২০২৩ সালের জুনভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়। দেশে সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার আলোচনা যখন জোরালো, ঠিক তখনই সামনে এলো এমন ভয়াবহ তথ্য। এরই মধ্যে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা ব্যাংক একীভূত হওয়ার বিষয়ে প্রথমবারের মতো একমত হয়েছে উভয় প্রতিষ্ঠান। আরও কমপক্ষে ৬-৭টি ব্যাংক একীভূত হওয়ার আলোচনায় রয়েছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বেসিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং বিডিবিএল। এছাড়া কয়েকটি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানও মার্জারের আলোচনায় রয়েছে। এসব ব্যাংক এবং নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিগত বছরগুলোতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। ফলে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৯০-৯৫ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে। এসব ব্যাংকের কয়েকজন এমডির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কথা বলতে রাজি হননি।
এদিকে একীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে ছোট ব্যাংকের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বড় ব্যাংক কেউ নিতে চাইছে না। এ নিয়ে পর্দার আড়ালে এক ধরনের টানাপোড়েন চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, স্বেচ্ছায় না নিলে শেষ পর্যন্ত জোর প্রয়োগে একীভূত করে দিতে হবে।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ তদারকি করেও দুর্বল ব্যাংকগুলোর অবস্থার উন্নতি করা যাচ্ছে না। সংকট উত্তরণে সর্বশেষ চলতি মাসের মাঝামাঝি বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংক মালিকদের বৈঠকে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়, যা আগামী বছর থেকে কার্যকর করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এর আগে ২০২২ সালের ১২ জুলাই আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যোগ দিয়েই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে পৃথকভাবে তদারকির উদ্যোগ নেন।
ওই বছরের ৩ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানিয়েছিলেন, ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ১০টি দুর্বল ব্যাংককে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে পর্যবেক্ষণের নির্দেশনা দেন তিনি। কিন্তু গত দেড় বছরে এ ১০টি ব্যাংকের অবস্থার উন্নতি হয়নি। এসব ব্যাংকের অধিকাংশের অবস্থানই রেড জোনে। নিয়মনীতি পরিপালনে ঘাটতি, ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি, পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্বহীনতা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের শক্ত অবস্থান না নেওয়ার কারণে দেশে দুর্বল ব্যাংকের সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে দেশে তফশিলি ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। তবে আলোচ্য প্রতিবেদনে ৫৪টি ব্যাংকের তথ্য নেওয়া হয়। ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত এই ৫৪টি ব্যাংকের ছয়টি ষাণ্মাষিক তথ্য বিবেচনায় নেওয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, আলোচ্য ছয়টি ষাণ্মাসিকে এই ৫৪ ব্যাংকের মধ্যে ৩৮টির অবস্থার অবনতি হয়েছে। আর ১৬টির অবস্থার উন্নতি হয়েছে। বাকি ৭টির মধ্যে তিনটির আর্থিক অবস্থাও সংকটাপন্ন বলে প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৫ সালের জুন থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্টাবিলিটি বিভাগ নিয়মিত ব্যাংকগুলোর এই স্বাস্থ্য সূচক ও হিটম্যাপ প্রতিবেদন তৈরি করে আসছে। এই প্রতিবেদন তৈরিতে ক্যামেলস রেটিং ও ব্যাসেল-৩ আওতায় প্রস্তাবিত লিভারেজ অনুপাত বিবেচনায় নেওয়া হয়। ক্যামেলস রেটিং হচ্ছে ব্যাংকের সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিমাপের মানদণ্ড।
ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততা, সম্পদের মান, ব্যবস্থাপনা, উপার্জন ক্ষমতা, তারল্য প্রবাহ ও বাজার ঝুঁকির প্রতি সংবেদনশীলতা-এই ৬ সূচকের অবস্থার ভিত্তিতে এই রেটিং নির্ধারিত হয়। অন্যদিকে ব্যাংকের টায়ার-১ মূলধন ও মোট সম্পদের অনুপাতকে লিভারেজ অনুপাত বলা হয়। আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানকল্পে ব্যাংকগুলোকে বিদ্যমান লিভারেজ অনুপাত ৩ শতাংশের সঙ্গে ২০২৩ সাল থেকে বার্ষিক শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হারে ২০২৬ সালে মধ্যে এক শতাংশে উন্নীত করার নির্দেশনা রয়েছে।