রাজশাহীতে ‘লাল তীর’ সালফেটে নষ্ট কোটি টাকার পান

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৪, ২০২০; সময়: ১১:১১ অপরাহ্ণ |
রাজশাহীতে ‘লাল তীর’ সালফেটে নষ্ট কোটি টাকার পান

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহীর পবা উপজেলার বড়গাছী কালুপাড়া ও মোহনপুর উপজেলার কৃষ্ণপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে পান বরজে পাউডার সালফেট প্রয়োগ করে কয়েকশ’ চাষির গাছসহ পান বিনষ্ট হয়েছে। এতে প্রায় কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। গাছে পচন ও পান ঝরে যাওয়ায় ভূক্তভোগি কৃষকেরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। স্থানীয় উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তাসহ উপজেলা কৃষিবিভাগের কেউ এগিয়ে আসেনি বলে চাষিরা অভিযোগ করেছে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, জেলায় ছয়টি উপজেলায় প্রায় ১ হাজার ৮শ’ ২১ হেক্টর ( ১৩ হাজার ৬শ’ ৬০ বিঘা) জমিতে পানের বরজ রয়েছে। দাম ভাল থাকায় পান বরজের পরিধি প্রতি বছরই বাড়ছে। এবছর পান উৎপাদনের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার ৯শ’ ৫৪ মে.টন। বর্তমান বাজার মূল্যে যার গড়দাম প্রায় ১১০ কোটি টাকা।

জেলায় প্রায় ২৫ হাজার সাড়ে ৫শ’ পানের ক্ষেত বা বরজ আছে। আর এই আবাদের সাথে প্রত্যেক্ষ জড়িয়ে আছে প্রায় এক লাখ পান চাষির জীবন-জীবিকা। জেলার পবা, মোহনপুর, বাগমারা, দুর্গাপুর, পুঠিয়া এবং চারঘাটে পান চাষ হয়ে থাকে। অন্যান্য কৃষি আবাদের তুলনায় বর্তমানে পান চাষে বেশি লাভবান হচ্ছেন চাষিরা। কম জমিতে বেশী লাভের আশায় অপরের জমি লীজ নিয়ে পানের আবাদ করে থাকেন অনেকে।

পবা উপজেলার বড়গাছী কালুপাড়া গ্রামের প্রায় কৃষকই লীজ চাষি (আগে যাদের বর্গাচাষি বলা হতো)। তারা জমি লীজ নিয়ে পান চাষ করে থাকেন। আবাদ ভালই ছিল। কিন্তু জমিতে সুরমা ফার্টিলাইজার ইন্ডাস্ট্রিজের ‘লাল তীর’ ও ‘থ্রি জি’ গ্রোজিংক সালফেট (মনোহাইড্রেট) প্রয়োগ করে পথে বসেছে প্রায় অর্ধশত চাষি। তবে স্থানীয় উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা মোকবুল হোসেন মুকুলকে এ ব্যাপারে জানালেও তিনি চাষিদের সাথে যোগাযোগ রাখেননি বলে অভিযোগ উঠেছে।

ভুক্তভোগি কৃষক শিপলুর রহমান, সোহাগ আলী, শফিকুল ইসলাম, সামশুল হক, আরবুল ইসলাম, মনসুর রহমান, ইস্রাফিল হোসেন, মামুন, পিন্টু, কাচু মন্ডল, বাক্কার সরদার, আনার হোসেন, মোস্তাকিন ও মোজাম্মেল হক বলেন, মোহনপুর উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামসহ পবা উপজেলার প্রায় ৭৫ জন চাষির ‘লাল তীর’ ও ‘থ্রি জি’ গ্রোজিংক সালফেট প্রয়োগে পান বরজ মরে গেছে। বরজের প্রায় পানই পচে নষ্ট হয়ে গেছে।

তারা সবায় মোহনপুর উপজেলার ধোপাঘাটা বাজারের ডিলার মশিউর রহমানের দোকান থেকে সুরমা ফার্টিলাইজার ইন্ডাস্ট্রিজের ‘লাল তীর’ ও ‘থ্রি জি’ গ্রোজিংক সালফেট (মনোহাইড্রেট) কিনে পান বরজে ব্যবহার করেছিল। মশিউর রহমানের কথা মত ওই সালফেট গাছের গোড়া মাটিতে দেয়া হয়। এরপরে থেকেই গাছের আগা মরতে শুরু করে। এরপর পাতা, তারপর পুরো পড়ই মরে গেছে।

সামশুল হক বলেন, বর মরে যাওয়ায় তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এ লোকসান কাটিয়ে ওঠা দুঃসাধ্য হবে তাদের জন্য। সাধারণত বছরের এই শীতের মৌসুমে লাভের আশায় থাকি কিন্তু এই সালফেট দেওয়ায় পান ও পানের লতা ঝরে গেছে। পান চাষের সাথে জড়িত পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস এই পান চাষ।

চাষিদের অনেকেই বলেন, ক্ষেতের বেশিরভাগ পান গাছের শেঁকড় পচে গাছ শুকিয়ে মরে গেছে। কোটি টাকা ক্ষতির মুখে দিশেহারা হয়ে পড়েছে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা। এ ঘটনার জন্য তারা অভিযুক্ত কোম্পানী, কীটনাশক ডিলার ও কৃষি বিভাগকে দায়ী করেছেন। ভূক্তভোগিরা সংশ্লিষ্ট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।

সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের গাফিলতির অভিযোগ তুলে এলাকার সচেতন মহল বলেছেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই কৃষি বিভাগ কীটনাশক ও কৃষি উপকরণ (বহুজাতিক কোম্পানীর সার, জৈবসার, সালফেট ইত্যাদি) ম্যানেজের মাধ্যমে অনুমোদন দেয়ার জন্য এবং ডিলারদের দেখভাল না করার জন্য কৃষকদের খেশারত দিতে হয়। এছাড়াও যদি কৃষি বিভাগ থেকে চাষিদের সঠিকভাবে পরামর্শ দেয়া হতো তাহলে এতো বড় ক্ষতি হতো না। এ ব্যাপারে কৃষি বিভাগের আরো দায়িত্বশীল হবার প্রয়োজন।

মোহনপুর উপজেলার কৃষ্ণপুর এলাকার উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা কামরুজ্জামান ও পবা উপজেলার কালুপাড়া এলাকার উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা মোকবুল হোসেন বলেন, তারা বিষয়টি উপজেলা কৃষি অফিসে জানিয়েছেন।

অভিযুক্ত মশিউর রহমান বলেন, ‘আমি ছাত্র। ডিলাররাতো এভাবেই সালফেটসহ বিভিন্ন কীটনাশক বিক্রি করেন। আমি অনেকটা বুঝে উঠার আগেই সুরমা ফার্টিলাইজার ইন্ডাস্ট্রিজের ‘লাল তীর’ ও ‘থ্রি জি’ গ্রোজিংক সালফেট (মনোহাইড্রেট) চাষিদের সাথে সাথে আমাকেও দেওলিয়া করেছে। বর্তমানে কোম্পানীর লোকজন আমার সাথেও সম্পর্ক রাখছে না। তবে আমি আমার সাধ্যমত চাষিদের খেশারত দিয়েছি’।

গোপন সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নিয়ে এবং চাষিদের সাথে মীমাংসা করে নিতে মোহনপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ডিলার মশিউর রহমানকে পরামর্শ দেন। তার কথামত মশিউর রহমান অনেক চাষিকে খেশারত দিয়েছেন।

এ ব্যাপারে পবা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন সুলতানা ফোন রিসিভ না করলেও মোহনপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রহিমা বেগম বলেন, বর মরেছে সত্য তবে কোন কৃষক অভিযোগ করেননি। কৃষি বিভাগ নিজেদের উদ্যোগে ওই সুরমা ফার্টিলাইজার ইন্ডাস্ট্রিজের ‘লাল তীর’ ও ‘থ্রি জি’ গ্রোজিংক সালফেট (মনোহাইড্রেট) জব্দ করে ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে