ছয় মাসে কাশ্মেরী আপেল কুল বরই গাছে ব্যাপক ফলন
নিজস্ব প্রতিবেদক, বদলগাছী : নওগাঁর পত্নীতলায় ছয় মাসের মাথায় কাশ্মেরী আপেল কুল বরই গাছে ব্যাপক ফলন দেখে বিস্মিত হয়েছেন এলাকার মানুষ। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে লেখাপড়া বেশি দূর এগোয়নি বাবুল আখতারের। হতাশায় দিন কাটছিল তাঁর। অভাবের কারণে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে দিন মজুর হিসেবে মানুষের বাড়ীতে কাজ শুরু করেন তিনি। এক সময় ভাগ্য বদলের আসায় বিদেশ পাড়ি জমান বাবুল আখতার। সাত বছর পর দেশে ফিরে বেশ কিছু জমি লিজ (ইজারা) নিয়ে গড়ে তোলেন মিশ্র ফলের বাগান। ৩৫ বছর বয়সী এই যুবক এখন একজন প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা।
জনাযায়, বাবুল আখতার নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার দিবর ইউনিয়নের উত্তরামপুর গ্রামের আব্দুস সামাদের ছেলে। এক সময় অন্যের জমিতে দিন মজুর হিসেবে কাজ করা বাবুল আখতার নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার শিয়ারা ইউনিয়নের কুমরইল নামক গ্রাম এলাকায় ৫০ বিঘা জমিতে গড়ে তোলেছেন মিশ্র ফলের বাগান। মালিক হয়েছেন বাড়ি, গাড়ী ও সাত বিঘা জমির। তাঁর বাগানে রয়েছে থাইল্যান্ডের থাই বারমাসী (কাটিমন) আম, কাশ্মেরী আপেল কুল, মাল্টা ও থাই পেয়ারার গাছ। তিনি এখন এলাকায় একজন আদর্শ কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। বাগান করার জন্য তাঁর কাছে পরামর্শ নিতে আসছেন প্রতিদিন অনেক মানুষ।
সফলতার গল্প জানতে চাইলে বাবুল আখতার বলেন, এক দিন বাড়ি-ভিটা ছাড়া তাঁদের কিছুই ছিল না। ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন সংসারে অভাব লেগেই আছে। সাত-আট বছর বয়স থেকেই লেখাপড়া করার পাশাপাশি বাবার সঙ্গে দিন মজুর হিসেবে কাজ শুরু করেন। কখনো কৃষি শ্রমিক ও মাটি কাটার কাজ, আবার কখনো নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। দিন মজুরের কাজ করার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ফল খুব একটা ভালো হয়নি তাঁর। লেখাপড়ার এ ফল নিয়ে খুব বেশি দূর যে এগোনো যাবে না বলে নিজের এমন ধারণা তৈরি হয় তরুণ বাবুল আখতারের। তাই লেখাপড়ার আনুষ্ঠানিক পাট চুকিয়ে সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে পুরো দমে দিন মজুরের কাজ করায় মনোনিবেশ শুরু করেন তিনি। কিন্তু তাতেও সংসারের অভাব দূর না হওয়ায় এক আত্মীয়ের পরামর্শে বাবুল আখতার ২০০৯ সালে পাড়ি জমান মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরাকে। সেখানে ফুড সার্ভিস ক্যাটারিংয়ের কাজ পান তিনি।
ইরাক থেকে ২০১৬ ইং সালে দেশে ফিরেন বাবুল আখাতার গ্রামে ফিরে শুরু করেন ধানের আড়ৎ এর ব্যবসা সেই ব্যবসাতেও লস খান তিনি। পরে ২০১৭ ইং সালে তাঁর জমানো দুই লাখ টাকা দিয়ে শিয়ারা ইউনিয়নের কুমরইল নামক গ্রাম এলাকায় ১২ বছরের জন্য ২০ বিঘা জমি প্রতি বছর ২ লক্ষ টাকায় লিজ নিয়ে তাতে আম বাগান গড়ে তোলেন তিনি। ২০১৮ ইং সালে সেই আম বাগানটি পাঁচ বছরের জন্য ৫০ লাখ টাকা দিয়ে সাব লিজ দেন অন্য এক আম চাষির কাছে। সেই টাকা থেকে গত বছর চার লাখ টাকা দিয়ে আরও প্রায় ৩০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে তাতে গড়ে তোলেন মিশ্র ফলের বাগান। বাবুল আখতারের মিশ্র ফল বাগানে গত বছর জুন মাসে কোনো জমিতে কাশ্মেরী বরইয়ের সঙ্গে থাইল্যান্ডের থাই বারমাসী (কাটিমন) আম গাছ, আবার কোনো জমিতে থাই পেয়ারার সঙ্গে মাল্টা ও কমলা গাছ লাগান। আম, মাল্টা ও কমলা গাছে ফল উৎপাদন শুরু না হলেও লাগানোর মাত্র ছয় মাসেই মাথাই কাশ্মেরী বরই গাছে উৎপাদন শুরু হয়েছে। ১০ বিঘা জমিতে আম ও বরই গাছের মিশ্র বাগানে প্রথম বছরেই বরই থেকে পাঁচ লাখ টাকা আয় করবেন বলে আশা বাবুল আখতারের।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, আম বাগান, মাল্টা, কমলা ও থাই পেয়ারার চাষ এই এলাকায় পরিচিত হলেও বাবুল আখতারের এই কাশ্মেরী আপেল কুল নামক এই বরই বাগানটি বেশ সাড়া ফেলেছে এলাকার মানুষের কাছে। কাশ্মেরী আপেল কুল (বরই) গাছ লাগানোর মাত্র ছয় মাসের মাথায় বরই গাছে ফলন দেখে বিস্মিত হয়েছেন মানুষ। অন্য জাতের বরই বাজারে প্রতি কেজি ৫০-৬০ টাকা দরে বিক্রি হলেও বাবুল আখতারের লাল-সুবজ রংয়ের টসটসে কাশ্মেরী আপেল কুল বরই বাগান থেকে পাইকারী বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭০-৮০ টাকায়।
বাবুল আখতার জানান, এক লাখ টাকা খরচ করে বরই বাগান করে উৎপাদন শুরুর প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যেই দেড় লাখ টাকার বরই বিক্রি করেছেন। আরও অন্তত চার সপ্তাহ বাগান থেকে বরই সংগ্রহ করা যাবে। এই সময়ের মধ্যে আরও পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকার বরই বিক্রি হবে বলে আশা করছেন তিনি।
বরই চাষের পাশাপাশি নতুন করে লিজ নেওয়া ২০ বিঘা জমিতে আমের পাশাপাশি মাল্টা, কমলা ও থাই পেয়ারার মিশ্র ফল বাগান গড়ে তুলেছেন। এই সব গাছে উৎপাদন শুরু হতে আরও প্রায় দেড় বছর সময় লাগবে।
বাবুল আখতার আরোও বলেন, তিনি একদিন ইউটিউবে একটি ভিডিও দেখেন। ওই ভিডিওটিতে চুয়াডাঙ্গার একটি বরই চাষির কাশ্মেরী আপেল কুল বাগান করে সফলতার গল্প দেখানো হয়। ভিডিওটি দেখে তিনি বরই চাষে উদ্বুদ্ধ হন। পরে তিনি চুয়াডাঙ্গার একটি নার্সারি থেকে কাশ্মেরী আপেল কুলের চারা সংগ্রহ করেন। গত বছরের জুন মাসে ১০ বিঘা জমিতে দুই হাজার কাশ্মেরী আপেল কুলের চারা লাগান তিনি। লাগানোর পাঁচ মাস পরেই এই বরই গাছে ফুল আসে। গত দুই সপ্তাহ আগ থেকে ফল সংগ্রহ শুরু করেছেন তিনি।
শ্রমিকদের সাথে নিয়ে বাবুল আখতার ও তাঁর ছোট ভাই আব্দুর রহিম বাগান পরিচর্যার কাজ করেন। উৎপাদন শুরুর পর থেকে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা বাগান থেকেই এই বরই সংগ্রহ করে নিয়ে যান।
শুরু থেকেই বাবুলকে নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে আসছেন শিয়ারা ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আকবর হোসেন। তিনি বলেন, বাবুল মিশ্র ফল বাগান গড়ে তুলে খুবই যুগোপযোগী একটি উদ্যোগ নিয়েছে। সাধারণ একটি আম বাগান করতে গেলে চারা লাগানোর পর উৎপাদন করতে কমপক্ষে দুই বছর সময় লাগে। এই সময়ের মধ্যে আম গাছের ফাঁকে ফাঁকে কুল, পেঁপে, মিষ্টি কুমড়া বা অন্য কোনো সবজি চাষ করা সম্ভব। মাঝখানে এই সময়টাতে লাভবান হতে পারেন চাষিরা।
আকবর হোসেন আরো বলেন, ‘বাবুলের বরই বাগানে ফল ধরার কিছু দিন পর ফলগুলো ব্যাপকহারে ঝরে পড়তে শুরু করে। তখন বাবুল আখতার আমার পরামর্শ চাইলে আমি তাঁকে বোরন ও এক ধরণের ছত্রাকনাশক ছিটানোর পরামর্শ দেই। এরপর এখন পর্যন্ত আর কোনো সমস্যা হয়নি।’
উপজেলা কৃষি অফিসার শ্রী প্রকাশ চন্দ্র সরকার বলেন, ‘বাবুল একজন সফল কৃষকের পাশাপাশি একজন সফল উদ্যোক্তাও। দেশের অন্য এলাকাগুলোতে মিশ্র ফল বাগানের ধারণা নতুন না হলেও এই এলাকায় মিশ্র ফল বাগান করে তিনি দৃষ্টান্ত গড়ে তুলেছেন। তার পাশাপাশি অন্য কৃষকেরাও আমের পাশাপাশি বরই, পেয়ারা, মাল্টা চাষে উদ্যোগী হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, পত্নীতলার শিয়াড়া ও দিবর ইউনিয়নের অধিকাংশ জমি এক ফসলী হওয়ায় ওই সব এলাকায় ব্যাপক হারে ফলের বাগান গড়ে উঠছে। আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে ওই সব কৃষকদের বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।