১১ বছর বয়সেই এ রাণীর বিয়ে হয় তার জন্মদাতার সঙ্গে
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : মিশরীয় ফারাও রাণীদের মধ্যে ক্লিওপেট্রা ছিলেন সব থেকে আলোচিত। তিনি তার সৌন্দর্য এবং বুদ্ধিমত্তার জন্য আজো ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন।এছাড়াও রানি হাতশেপসুত, যিনি পুরুষের বেশে মিশর শাসন করেছেন।
মিশরের রাজা বা ফারাওদের কথা বললে তৎক্ষণাৎ আমাদের চোখে নীল আর সোনালি মুকুট পরে সিংহাসনে বসে থাকা একজন পুরুষের অবয়বই ভেসে ওঠে। যদিও মিশরের শাসকরা সাধারণত পুরুষ ছিলেন। তারপরও ফারাও শব্দটা বিরলভাবে নারী শাসকদের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হত।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, মিশরের তিন হাজার বছরের ইতিহাসে ১৭০ জন ফারাওয়ের মাঝে সাত জন ছিলেন নারী। যদিও এই সংখ্যা নিয়ে ইতিহাসবিদদের সন্দেহ রয়েছে, কারণ অনেক নারী শাসকের নামই ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। এদের মধ্যে রানি আনাক-সু-নামুন অন্যতম।
বেশ রহস্যময় ছিল তার জীবন। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৪৮ সালে আনাক-সু-নামুনের জন্ম। বাবা ফারাও আখেনাতেন ও মা নেফারতিতির ঘরে জন্ম তার। আনাক-সু-নামুন একাধারে তুতেনখামেনের মাতামহী, মা, বোন ও স্ত্রী ছিলেন। মিশরের রাজারা নিজেদের ঈশ্বরের অংশ বলতেন। সিংহাসনে দেবতার অধিকার কায়েম রাখতে, খুব কাছের আত্মীয়কে বিয়ে করতেন তারা। নিজেদেরকে দেবতা বলে মনে করায় তারা বংশের বাইরে কাউকে বিবাহ করত না। ফলে ভাই-বোনেদের মধ্যেই বিবাহ সম্পন্ন হত।
এ কারণে রাজকন্যা আনাক-সু-নামুনের প্রথম স্বামী ছিলেন তারই জন্মদাতা পিতা আখেনাতে। মাত্র ১২ বছর বয়সেই মা হন আনাক-সু-নামুন। কিছুদিন পরই মারা যান আখেনাতেন। এরপরের ফারাও স্মেনখারের সঙ্গে বিবাহ হয় তার। স্বামী সুখ যেন বিধাতা লেখেননি আনাক-সু-নামুনের কপালে। বিয়ের কিছুদিনের মাথায় স্মেনখারের মৃত্যু হয়। স্মেনখারের মৃত্যুর পর রাজা হন নয় বছরের তুতেনখামেন।
তিনি ছিলেন রাজকন্যা আনাক-সু-নামুনের সৎ-ভাই। পরম্পরা মেনে বালক তুতেনখামেনের সঙ্গে বিয়ে হয় ১৬ বছরের আনাক-সু-নামুনের। তখনকার সময় হয়তো মানুষের জানা ছিল না, রক্তের সম্পর্কের মধ্যে বিয়ে হলে তার প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর। সন্তানের শরীরে নানা রকম শারীরিক অসুবিধা দেখা দেয়। রাজা তুতেনখামেনও ছিলেন শারীরিক প্রতিবন্ধী। তার এক পা খোঁড়া ছিল।
এ কারণেই হয়তো আনাক-সু-নামুন দুইবার মৃত কন্যা সন্তান জন্ম দেন। শিশুদের মমি মিলেছে তুতেনখামেনের বিখ্যাত মমির পাশেই। তারা বেঁচে থাকলে হয়তো রানি আনাক-সু-নামুনের জায়গাটি গ্রহণ করত। রানি আনাক-সু-নামুনের জন্য অপেক্ষা করছিল আরো সব অপ্রীতিকর ঘটনা। প্রায় ১০ বছর সুখেই কেটেছে তুতেনখামেনের সঙ্গে তার বিবাহিত জীবন।
তুতেনখামেন সেসময় মিশরের রাজা হলেও তার বয়স ছিল কম। ফলে বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য তাকে বিভিন্ন মন্ত্রী ও উপদেষ্টার সাহায্য নিতে হতো। আনাক-সু-নামুনও তার স্বামীকে রাজ্য পরিচালনায় বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতেন। তারা দুজনে মিলে তাদের বাবা মিশরের সমাজ ব্যবস্থার যে ক্ষতি করেছিলেন তা ঠিক করার চেষ্টা করেন।
তবে তুতেনখামেন তার শারীরিক ত্রুটির জন্য খুব একটা আরামে রাজত্ব করতে পারেননি। এক পা তার খোঁড়া থাকায় সবসময় একটি লাঠি নিয়ে হাঁটতে হতো। ইতিহাসবিদদের মতে, তার বাবা-মায়ের অজাচারী সম্পর্কের ফলেই তিনি এই পঙ্গুত্ব লাভ করেন। তবে তুতেনখামুন ও আনাক-সু-নামুন দম্পতির মধ্যে বোঝাপড়া ভালো ছিল বলেই জানা যায়। তাদের প্রেমময় সম্পর্কের অনেক ছবি মিশরে দেখতে পাওয়া যায়।
বেশি দিন এই সুখ স্থায়ী হয়নি আনাক-সু-নামুনের। হঠাৎ করেই মাত্র ১৯ বছর বয়সে রাজা তুতেনখামেন মারা যান। শুরু হয় নতুন সমস্যা। তুতানখামেন ও আনাক-সু-নামুনের দাদা আইয়ের যে মন্দির ছিল, সেখানকার পুরোহিত আনাক-সু কে জোর করে বিয়ে করতে চায়। তার হাত থেকে বাঁচার জন্য আনাক-সু-নামুন পত্র পাঠায় হিট্টাইট রাজাকে। আকুতি ভরা চিঠি লিখেছিলেন রানি।
চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, আমি বিধবা, পুত্রহীনা। আপনার ছেলেদের কাউকে আমার সঙ্গে বিয়ে দেবেন? কোনো প্রজাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে চাই না। রানির চিঠি পেয়ে হিট্টাইট রাজা তার ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন। তবে রানির কাছে পৌঁছাতে পারেনি সে। পথেই তাকে খুন করান আই। এমনকি তুতেনখামেনের হত্যার নেপথ্যেও নাকি তিনি ছিলেন।
রাজত্বের দাবি জোরালো করতে, আই জবরদস্তি বিয়ে করলেন আনাক-সু-নামুনকে। এরপরই ইতিহাস থেকে হারিয়ে গিয়েছেন রানি অথবা মুছে দেয়া হয়েছিল তার অস্তিত্ব। ঐতিহাসিকরা এখনো তার রহস্যজনক মৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করতে পারেননি। আর কেনই বা তিনি অদৃশ্য হয়েছিলেন তা বের করার চেষ্টা করছেন অনেক ঐতিহাসিক। আখেনাতেন এবং নেফারতিতি উভয়ই বিতর্কিত ব্যক্তি ছিলেন। তারা পুরনো ধারা ভঙ্গ করে একটি ধর্মীয় বিপ্লব ঘটিয়েছিল, যেখানে তারা কেবলমাত্র এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন।
আর একটু বিশদভাবে বললে বিষয়টি ছিল এমন যে, তাদের জন্মের সময় মিশরে এক ধর্মীয় বিপ্লবের চলছিল। সেসময় আখেনাতেন মিশরের প্রাচীন দেবতাদের ত্যাগ করে একক দেবতা আতেন এর উপাসনা শুরু করেন। ফলে এতদিন ধরে পূজা করে আসা দেবতারা-এর অনুসারীরা আখেনাতেনের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে এবং এক বড়সড় বিপ্লবের শুরু হয়। কারণ এর মধ্য দিয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং ধনী পুরোহিত শ্রেণীর কাছ থেকে অর্থ এবং ক্ষমতা দুই ই নিয়ে নেয়া হয়। স্বার্থে আঘাত লাগাতে রাজ্যে বিশৃঙ্খলা, অসন্তুষ্টি এবং প্রতিবাদ শুরু হয়। তাদের মৃত্যুতে আনাক-সু-নামুনের আর কোনো বিকল্প থাকলো না।
তিনি প্রয়াত ফেরাউন তুতেনখামুনের উপদেষ্টা ফেরাউন আইয়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধ্য হলেন। যদিও সেসময় আনাক-সু-নামুন তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। তবে তাতে কোনো লাভ হয় নাই। বিয়ে তাকে করতেই হয় আইকে। তাদের বিয়ের প্রমাণও মিলেছে।
প্রত্নতাত্ত্বিকেরা একটি আংটি খুঁজে পেয়েছিলেন যা থেকে দেখা যায়, তিনি আইয়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। এরপর আশ্চর্যজনকভাবেই হঠাৎ নিখোঁজ হন আনাক-সু-নামুন। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, ফেরাউন আইয়ের সমাধির দেয়ালে প্রত্নতাত্ত্বিকরা আইয়ের স্ত্রী এবং রানি নেফারতিতির নার্স তেঁয়ের নাম পেয়েছিলেন। তবে আনাক-সু-নামুনের নাম ছিল না।
রানি আনাক-সু-নামুনের নাম তেমন কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। ধারণা করা হয়, ইতিহাস থেকে তাকে যেন ইচ্ছাকৃতভাবে মুছে দেয়া হয়েছে। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে জানুয়ারি মাসে আনাক-সু-নামুনের সমাধি খুঁজে বের করার জন্য একটি অভিযান চালানো হয়। এ সময় প্রত্নতত্ত্ববিদরা মিশরের ভ্যালি অব দ্য মাংকিজ নামক স্থানে খনন চালান। এখানেই এর আগে ফেরাউন আইয়ের সমাধি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। আইয়ের সঙ্গে যদি আনাক-সু-নামুনের বিয়ে হয়ে থাকে তবে নিয়ম অনুসারে এখানেই তার সমাধি থাকার কথা।
এই স্থানটি মিশরের ভ্যালি অব দ্য কিংস নামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমাধি স্থানের খুব কাছেই অবস্থিত। ভ্যালি অব দ্য কিংস নামক স্থানটিতে এর আগে তুতেনখামেনসহ মিশরের নানা গুরুত্বপূর্ণ ফেরাউনের সমাধি খুঁজে পাওয়া যায়। এই অভিযানে গবেষকরা অনেকগুলো অনাবিষ্কৃত রাজসমাধির খোঁজ পেয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, হয়তো এরই কোনো একটিতে চিরনিদ্রায় শুয়ে রয়েছেন মিশরের ইতিহাসের অন্যতম রহস্যময়ী রানি আনাক-সু-নামুন।
ফারাও হলো গ্রিক-রোমান কর্তৃক বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত প্রাচীন মিশরীয় রাজবংশের রাজাদের প্রচলিত উপাধি। ফারাও আদি মিশরীয় সভ্যতা। মিশরে নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল খ্রীস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে। নীল নদকে কেন্দ্র করে মিশরের এ সভ্যতা গড়ে উঠেছিল বলে মনে করেন ইতিহাসবিদরা। গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস মিশরকে বলেছেন নীল নদের দান।
৫০০০-৩২০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়ের মিশরকে প্রাক-রাজবংশীয় যুগ বলা হয়। ৩২০০ খ্রীষ্টপুর্বাব্দে মেনেস নামের এক রাজা সমগ্র মিশরকে একত্রিত করে একটি নগর রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। দক্ষিণ মিশরের মেস্ফিস হয় এর রাজধানী। এভাবেই সূচনা হয় মিশরের রাজবংশের।
ফারাওয়ের মৃত্যুর পরও জীবন আছে বলে বিশ্বাস করত। তারা বিশ্বাস করত যে তাদের মরণের পর তাদের আত্মা দেবতা হরুসের সঙ্গে মিলে যাবে। তাই তাদের মৃত্যুর পর পিরামিড বানিয়ে তার নিচে সমাধিকক্ষে এদের দৈনন্দিন জীবনের ভোগ-বাসনার সমস্ত সরঞ্জাম রক্ষিত করত। মৃতদেহকে পচন থেকে বাঁচাবার জন্য তারা দেহকে মমি বানিয়ে রাখত এবং স্বর্ণালঙ্কারে মুড়ে সমাধিকক্ষের শবাধারে রাখা হত।