মাতৃভূমিকে বাঁচাতে জলদস্যুদের দলে যোগ দেন নারী শাসক
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : বিভিন্ন শতাব্দীতে ক্ষমতার লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়েছে বিশ্ব। প্রতিশোধের আগুনে মানুষ জ্বলেছে, জ্বালিয়েছে। ইতিহাসে শাসকদের এমন প্রতিশোধের অজস্র ঘটনা গল্পের আকারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এর কিছু যেমন সত্যি, তেমনি কিছু কিছু ঘটনা আবার কল্পনার রং মিশে ডালপালা মেলেছে।
ইতিহাসে রক্ত, যুদ্ধ সাধারণ ঘটনা। সেই সঙ্গে সমুদ্র পথে জলদস্যুদের কবলে পরে সর্বস্বো হারানোও নতুন কিছু নয়। জলদস্যুরা ইতিহাসের অনেক পাতাই জলদস্যুরা রঞ্চিত করে রেখেছে। ব্ল্যাক বেয়ার্ড থেকে শুরু করে দেবী চৌধুরানী। গল্প-উপন্যাসের বদৌলতে জলদস্যুদের নিয়ে আমাদের অনেক কিছুই জানা। সমুদ্র পথের বণিক এবং যাত্রীদের জন্য ছিল এক আতংকের নাম।
তবে মধ্যযুগের একজন নারীর জলদস্যুতা ইতিহাসকে আরো বেশি চমকে দিয়েছে। সেই সঙ্গে নারী শাসকের মাতৃভূমির দখলদারদের প্রতি প্রতিশোধ স্পৃহার ঘটনা ছিল বিরল। দক্ষিণ ইউরোপের দেশ স্পেন ইসলাম ধর্ম প্রচলনের কিছুদিনের মধ্যেই ইসলামিক শাসকদের দখলে চলে আসে। সেখানে দীর্ঘদিন মুসলিম শাসকদের আধিপত্য বজায় ছিল। তবে পঞ্চদশ শতক থেকে সেই আধিপত্যে ফাটল ধরে। আশেপাশের বিভিন্ন ক্রিশ্চান রাজ্যগুলো দলবদ্ধভাবে ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে স্পেনে ইসলামিক শাসনের অবসান ঘটায়।
১৪৯২ সালে স্পেনের খ্রিস্টান অধ্যুষিত প্রদেশ অ্যারাগণের রাজা ফার্দিনান্দ ও কাস্টিলের রানি ইসাবেলার বাহিনী যৌথ আক্রমণ চালিয়ে সেদেশেরই আরেকটি প্রদেশ গ্রানাদার ইসলামিক শাসকদের পরাজিত করে। দীর্ঘদিন পর দক্ষিণ ইউরোপের এই দেশটির ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে খ্রীস্টান শাসকদের হাতে চলে যাওয়ার ফলে সেখানকার মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা বিপদে পড়ে যান। তাদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি অনেককে গায়ের জোরে দেশ থেকে বের করে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। যারা এরপরও স্পেনে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল তাদের পদে পদে লাঞ্ছনা করা হয়।
মাতৃভূমির দখলদারদের শায়েস্তা করে তাদের বাণিজ্য ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছিলেন এক মুসলিম নারী জলদস্যু। আলি ইবনে রশিদ ছিলেন গ্রানাদার একজন ক্ষমতাশালী মুসলমান গোষ্ঠীপতি। তার স্ত্রী ছিলেন একজন ধর্মান্তরিত মুসলমান, লাল্লা জোহরা ফার্নান্ডেজ। তার একমাত্র মেয়ে ১৪৮৫ সালে গ্রানাদায় জন্মগ্রহণ করেন, তার নাম ছিল লাল্লা আয়েশা বিনতে আলি ইবনে রশিদ। ইতিহাসে তিনি পরিচিত সাইয়িদা আল-হুররা নামে।
খ্রিস্টান শাসকরা গ্রানাদা ক্ষমতা দখল করে নেয়ার পর ১৪৯২ সালে আলি ইবনে নিজের পরিবার ও গোষ্ঠীর অন্যান্য মানুষদের নিয়ে বারবোসা ভাইদের সাহায্যে ভূমধ্য সাগর পেরিয়ে মরক্কোয় গিয়ে পৌঁছান। আফ্রিকার এই দেশটির তাঞ্জিয়ার অঞ্চলের শেফাশাউনে ঘাঁটি গাড়েন তারা। এর আগে আলি ইবনে রশিদের নৌ-ঘাঁটি ছিল শেফাশাউন।
নতুন জায়গায় থিতু হওয়ার পর আলি ইবনে নিজের মেয়ের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন বিখ্যাত ধর্মীয় পণ্ডিত ও স্থপতি আব্দুল্লাহ আল-গাজনওয়ানি’কে। এই শিক্ষক আলি ইবনের মেয়েকে ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি গণিত, ভাষা, ভূগোল সহ নানা বিষয় শেখাতেন। ১৫১৫ থেকে ১৫৪২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মরক্কোর উত্তর উপকূলবর্তী শহর তিতওয়ানের রানি ছিলেন। একই সময়ে তিনি নারী জলদস্যু হিসেবেও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ছিলেন সমধিক পরিচিত। সাইয়িদা আল-হুররাকে পশ্চিম আফ্রিকা অঞ্চলে আধুনিক ইসলামি যুগের সবচে গুরুত্বপূর্ণ নারীচরিত্র হিসেবে অভিহিত করা হয়।
১৫০১ সালে সাইয়িদার বয়স যখন ১৬ বছর তখন তার বিয়ে হয় স্থানীয় তিতওয়ান প্রদেশের প্রশাসক আবুল হাসান আল-মান্দারির সঙ্গে। আল-মান্দারি তার চেয়ে বয়সে ৩০ বছরের বড় হলেও তিনি ছিলেন তার বাবার বন্ধু। তবে আল-মান্দারি সাইয়িদাকে যথেষ্ট সম্মান করতেন। সাইয়িদার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কারণে বিয়ের কিছুদিন পর তিনি তাকে তিতওয়ানের প্রধান রাণি ঘোষণা করেন। আবুল হাসানেরও জন্মস্থান ছিল স্পেনের গ্রনাদায়। তিনিও তার পরিবার নিয়ে মরক্কোয় চলে আসতে বাধ্য হন। বিয়ের পর আলি ইবনে রশিদের মেয়ের নাম হয় সঈদা-আল-হুররা। স্ত্রীর বিভিন্ন গুণ দেখে আবুল হাসান আল-মান্দারি তাকে তিতওয়ানের রানি হিসেবে ঘোষণা করেন। কোনো কোনো সূত্র জানায়, আবুল হাসান আল-মান্দারি নয়, সাইয়িদার বিয়ে হয়েছিল আল-মান্দারির ছেলের সঙ্গে। যদিও এ ব্যাপারে তেমন কোনো জোড়ালো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
১৫১৫ সালে তিতওয়ানের শাসক আবুল হাসান আল-মান্দারি মারা গেলে সেখানকার শাসনভার গ্রহণ করেন সাইয়িদা। তিনি আজীবন বুকের মধ্যে মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার যন্ত্রণা বহন করে নিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। তবে এতদিন তার কোনো প্রতিকার করতে পারেননি। তিতওয়ানের শাসক হওয়ার পর ঠিক করেন যারা তার মাতৃভূমি দখল করে নিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল তাদের কড়া শাস্তি দেবেন। মনে মনে ছক কোষতে থাকেন রানি।
তিতওয়ান শাসক হওয়ার পর তাকে ডাকা হতো ‘সঈদা আল-হুররা’ বা সার্বভৌম স্বাধীন রানি নামে। সেই সময় মুসলমান শাসিত রাজ্যগুলোতে নারী শাসক খুব একটা দেখা যেত না। সে দিক থেকে সাইয়িদা উজ্জল ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি স্পেনের খ্রিস্টান শাসকদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে একটি বিষয় বুঝতে পেরেছিলেন তিতওয়ান থেকে হামলা চালিয়ে স্পেন দখল করা যাবে না। তখন ঠিক করেন অর্থনৈতিকভাবে দক্ষিণ ইউরোপের এই দেশটির শাসকদের পঙ্গু করে দিতে হবে।
এই ভাবনা থেকেই বিখ্যাত নৌ-কমান্ডারদের নিয়ে তিতওয়ানের নৌবাহিনী গড়ে তোলেন। এই নৌবাহিনী তৈরি করার পর তিনি ভূমধ্যসাগরের দুর্ধর্ষ জলদস্যু বারবোসা ভাতৃদয়ের সঙ্গে জোট বেঁধে ভূমধ্যসাগরের জলরাশির বুকে ইউরোপীয়দের জন্য আতঙ্কে পরিণত হন। তারা স্পেন ও পর্তুগালের যে সমস্ত বাণিজ্য জাহাজ ভারত সহ এশিয়ার দেশগুলোতে যেত, সেগুলো লুটপাট করার পাশাপাশি পানিতে ডুবিয়ে দিতে শুরু করে। এক সময় পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছায় যে, স্পেন ও পর্তুগাল যাবতীয় বাণিজ্য বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। স্বাভাবিকভাবেই এই দুই দেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে লুটপাটের এই অর্থ নিজে কখনো ভোগ করেননি সাইয়িদা। বরং তা দিয়ে তিতওয়ানের উন্নতি ঘটিয়েছেন।
অনেক ইতিহাসবিদ বিশ্বাস করেন, সাইয়িদা আল-হুররা মূলত একজন নারীশাসকই ছিলেন। যেমনটা স্পেন ও পর্তুগালের ইতিহাসে দেখতে পাওয়া যায়। ক্যাস্টিলের রানি ইসাবেলা যেমন ছিলেন। তবে অধিকাংশের মতে, তিনি তিতওয়ানের সফল রানি হওয়ার পাশাপাশি ছিলেন পশ্চিম ভূমধ্যসাগরের একজন সফল জলদস্যু। সাইয়িদার জীবন ছিল অভিযান আর উত্তেজনায় ভরপুর। একই সঙ্গে তিনি কূনৈতিকভাবেও ছিলেন দারুণ সফল। তিনি তার ভাই ইবরাহিমকে ফেজ-এর সুলতানের দরবারে মন্ত্রী হিসেবে অধিষ্ঠিত করেন। ফলে, মরক্কোতে রশিদ পরিবারের সম্মান আরও বর্ধিত হয়। তার কূটনৈতিক ও নৌ অভিযানের ফলে দ্বিধাবিভক্ত মরক্কো স্পেন ও পর্তুগালের বিপক্ষে শক্তিশালী নৌশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
১৫৪০ সালে মরক্কোর সুলতান আহমদ আল-ওয়াত্তাসি রাজনৈতিক কারণে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান সঈদাকে। পরের বছর ১৫৪১ সালে তাদের দুজনের বিবাহ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। তবে ১৫৪২ সালে নিজের জামাতার ষড়যন্ত্রে তিতওয়ানের অধিকার হারাতে হয় সঈদাকে। তাকে নির্বাসিত করা হয় শেফশাউনে। প্রায় ২০ বছর নির্বাসিত জীবন ভোগ করার পর ১৫৬১ সালে যান এই সাহসী নারী শাসক।