স্মৃতি বিজারিত নাটোর রাজবাড়ি

প্রকাশিত: ০৯-০৭-২০২৩, সময়: ১৩:০৩ |

ইন্দ্রাণী সান্যাল : কাচারি ঘরের বাইরেটা দেখলে মনে হবে ভেতরে দেখার কিছু নেই। তবু এগিয়ে গেলাম অন্ধকারের দিকে। এই ঘরে বাইরে থেকে আলো আসার কোন পথ নেই।

শুধুই অন্ধকারের গহ্বরে সেঁধিয়ে যাওয়া। মোবাইলের আলোয় চোখে পড়লো নাকের ডগায় এক লোহার খাঁচা। অন্ধকারের এই গুহায় মোটা লোহার গারদে আটকে রাখা হতো অপরাধীদের। বা যারা হয়তো খাজনা দিতে পারেনি আগের বছর।

রাজা আর রাজপরিবারের ইতিহাসের অন্তরালে কালো এক অধ্যায়ের স্বাক্ষীই দেয় এই জেলখানা। উঁচু দেয়ালে ঘেরা ঘরটি মোবাইলের আলোতে দেখতে থাকি। দৈর্ঘ্যে খাঁচাটি ১৬ ফুট হবে, প্রস্থে ১২ ফুট, আর লম্বায় ১০ ফুটের মতো।

বর্তমানের এই সময় থেকে রাজার যুগের জেলখানা যে কষ্টদায়ক ছিল তা এই খাঁচাই প্রমাণ করে। যেখানে নেই আলো-বাতাস প্রবেশের পথও।

স্যাঁতস্যাঁতে লাল দেয়ালের প্রাচীন স্থাপত্যে যেন শত বছর আগের প্রাণগুলো দৌড়ে বেড়ায়। পাহারাদার, চাপরাশি, সৈন্যদের কোলাহলে জমজমাট রাজবাড়ি। পুকুরের ধারের বাগানগুলোতে ব্যস্ত মালি। মন্দিরের ঢং ঢং শব্দে পূজা চলছে।

এসবই শত শতাব্দীর ইতিহাস এক দাপটশালী রাজবংশের বিচরণ ছিল এ প্রান্তরে। সেখানে এখনো ঘাট বাঁধানো পুকুর, আস্তাবল, চৌকিদারদের বাসভবন, শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেতে পরিখা, মন্দিরের ঘণ্টার ধ্বনি সবই রয়েছে। তবে জীর্ণ-শীর্ণ। আর দাপুটে রাজত্ব ঠাঁই নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়।

নাটোর শহর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত স্থাপত্যশৈলী ও ইতিহাসখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র নাটোর রাজবাড়ি। ১০ টাকার টিকেট কেটে ঢুকলেই লম্বা রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে হবে ইতিহাসের প্রান্তরে। প্রথমেই হাতের ডানে পড়ে জল টুংগি পুকুর।

এখন চারদিকে সীমানা দেয়া এ পুকুরে রয়েছে একটি ঘাট।এরপর হাতের বামে অপূর্ব স্থাপত্য শৈলীর নির্দশন তারকেশ্বর শিব মন্দির।

এখানে শিব আর কৃষ্ণের মূর্তি ছাড়াও রয়েছে তিন মাথা ও পাঁচ মাথা বিশিষ্ট কাল নাগিনী প্রতীমা। এই মন্দিরে বিশেষভাবে নাগিনের দাপট দেখা যায়। মন্দির থেকে বেরুলেই রাজবাড়ির একটি ভবন। বড় ফটক দরজা। কাঠের জানালাগুলো ভেঙ্গে গেছে অনেক জায়গায়।

দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। সবচেয়ে দীর্ঘ স্থাপনা বলতে শ্যাম সুন্দর মন্দির। কেন্দ্রীয় ভবনের সামনের মাঠের পূর্ব পার্শ্বে এই মন্দিরের পাশেই গার্ডদের রুম ছিল। শত শত পাইক পেয়াদায় গম গম করতো এই চত্বর এবং আশপাশ।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, অষ্টাদশ শতকের শুরুতে নাটোর রাজবংশের উৎপত্তি হয়। ১৭০৬ সালে পরগনা বানগাছির জমিদার গণেশ রায় ও ভবানী চরণ চৌধুরী রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হয়ে চাকরিচ্যুত হন।

পরে দেওয়ান রঘুনন্দন জমিদারটি তার ভাই রামজীবনের নামে এ স্থানটি বন্দোবস্ত নেন। রাজা রামজীবন নাটোর রাজবংশের প্রথম রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন ১৭০৬, মতান্তরে ১৭১০ সালে। এভাবে নাটোর রাজবংশের পত্তন হয়।

১৭৩০ সালে রামজীবন মারা যান। ১৭৩০ সালে রানী ভবানীর সঙ্গে রাজা রামজীবনের দত্তক পুত্র রামকান্তের বিয়ে হয়। রাজা রামজীবনের মৃত্যুর পর রামকান্ত নাটোরের রাজা হন।

১৭৪৮ সালে রাজা রামকান্তের মৃত্যুর পরে নবাব আলীবর্দী খাঁ রানী ভবানীর ওপর জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন।বিশাল জমিদারির রাজধানী নিজ জন্মভূমিতে স্থাপনের জন্যে রঘুনন্দন, রাম জীবন ও পণ্ডিতবর্গ তৎকালীন ভাতঝাড়ার বিলকে নির্বাচন করেন।

ভাতঝাড়ার বিল ছিল পুঠিয়া রাজা দর্পনারায়ণের সম্পত্তি। এজন্য রঘুনন্দন ও রামজীবন রাজা দর্পনারায়ণের নিকটে বিলটি রায়তী স্বত্বে পত্তনীর আবেদন করেন। নতুন রাজাকে রাজা দর্পনারায়ণ জমিটি ব্রহ্মোত্তোর দান করেন।

রামজীবন বিলে দীঘি, পুকুর ও চৌকি খনন করে সমতল করেন এবং রাজবাড়ি স্থাপন করেন। এলাকাটির নামকরণ করেন নাট্যপুর। ১৭০৬-১৭১০ সালে নাটোর রাজবাড়ি নির্মিত হয়েছিল। রঘুনন্দন বড় নগরে(মুর্শিদাবাদে) থাকতেন।

মাঠের প্রান্তের ভবনের দরবার ঘরে যাওয়া যায়। তিনতলা উচুঁ দরবার ঘরের দেয়াল আর ছাদে রাজবাড়ির ঐর্শ্বর্য আর গৌরবময় ইতিহাসের স্বাক্ষ্য দেয়।

কাঠের ভারী ভিম দিয়ে বানানো হয়েছে ছাদ। আর ভবনের সামনে উচুঁ স্তম্ভ যেনো এখনো দাপটে দাঁড়িয়ে আছে।

রানী ভবানীর স্মৃতিবিজড়িত মূল ভবনটিই ‘রানী ভবানীর রাজবাড়ী’ অর্থাৎ ঐতিহ্যবাহী নাটোর রাজবাড়ি। গোটা রাজবাড়িতে ছোট-বড় ৮টি ভবন, ২টি গভীর পুকুর ও ৫টি ছোট পুকুর আছে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রবেশমুখে রয়েছে বিশাল একটি পুকুর, সেই পুকুরের শানবাঁধানো ঘাট দেখে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য।

জলটুঙ্গি, তারকেশ্বর, গোপীনাথ, আনন্দ, ও মহাল নামে রাজবাড়ীর ছোট পুকুরগুলির নাম। রাজবাড়ি ঘিরে আছে দুই স্তরের বেড়চৌকি। জানা যায় এই বেড়চৌকি রাজবাড়িতে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করত।

রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে আটটি মন্দির রয়েছে, যার প্রাণ এক বিশাল শিবমন্দির। এখানে এখনো রীতি মেনে নিয়মিত পূজা হয়। দৃষ্টিনন্দন মন্দিরের সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে।

মন্দিরকে ঘিরে আছে একটি শিবমূর্তি, ফণা তোলা সাপের মূর্তি, একজন বাউলের মূর্তিসহ নানা রকম শৈল্পিক কাজ। মন্দিরটির দেয়ালজুড়ে টেরাকোটার শিল্পকর্ম।

হানি কুইন নামে একটা রেস্টহাউস, ১টি বৈঠকখানা, মালখানা, রানী ভবানীর উন্মুক্ত মঞ্চ ও ১টি মৃত্যুকূপ রয়েছে। পুরো রাজবাড়ি ঘিরে রয়েছে হরেক রকমারি বিশাল সব গাছ। সাথে নানা জাতের ফুলগাছ। পাশেই নবনির্মিত কমিউনিটি সেন্টার।

কমিউনিটি সেন্টার ধরে সামনে গেলে তারকেশ্বর মন্দির। আরেকটু সামনে এগিয়ে ডান দিকে বিশাল মাঠ। এই অংশের নাম ছোট তরফ। এর ঠিক উল্টো দিকে বড় তরফ। যমজ প্রায় বড় তরফের সামনে রয়েছে বিশাল পরিখা ও পুকুর।

সামান্য দূরেই রানী মহলটিতে রানী ভবানী বাস করতেন। এখন রানীমহল আছে নামমাত্র। শুধু সাইনবোর্ডে লেখা দেখে চেনা যায়। এখানে একটি অতিথিশালা আছে, নাম মাত্র। তবু ভগ্নপ্রায় অতিথিশালা দেখে সে সময়কার নাটোর রাজার অতিথিসেবার কিছুটা নমুনা পাওয়া যায়।

শতবছরের স্থাপনাগুলো এখন অনেকটাই মাটিতে গেঁথে গেছে। তাই দরজা জানালাগুলো এখন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। লাল শ্যাওলা ধরা ইঁটে ইঁটে গেঁথে আছে রানী ভবানীর কৃত্তি। তবে এরপরের কিছু স্থাপনাতে এখনো বাস করছে মানুষ।

১৮০২ সালে রানী ভবানীর মৃত্যুর পর তার দত্তকপুত্র রামকৃষ্ণ রাজ্যভার গ্রহণ করেন। রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর রাজবাড়ী বড় তরফ ও ছোট তরফ এ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়।

মহারানী ভবানীর পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে জগদীন্দ্রনাথ ছিলেন স্বনামধন্য রাজা। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র যোগীন্দ্রনাথ বড় তরফের রাজা হন।

কিন্তু তিনি কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। যোগীন্দ্রনাথের দুই পুত্র একে একে রাজ্যভার নিলেও তাদের নিজেদের সন্তান না থাকায় রাজবংশের পরিসমাপ্তি ঘটে।

 

উপরে