সাগর নয় রামসাগর

প্রকাশিত: ১১-০৭-২০২৩, সময়: ১২:১৪ |

ইন্দ্রাণী সান্যাল : সাগরের কথা উঠলে চোখ বন্ধ করে শোনা যায় তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শোঁ শোঁ আওয়াজ। কিন্তু উত্তরের কক্সবাজার খ্যাত দিনাজপুরের রামসাগরে তা নেই।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা শত শত দর্শনার্থী তবু ভিড় করছেন রামসাগরের পাড়ে। রামসাগর তো সাগর নয়। বিশাল এক দিঘি। যা মানবসৃষ্ট। যার স্বচ্ছ নীল জল যুগ যুগ ধরে দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে চলেছে।

দিনাজপুর শহর থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে আউলিয়াপুর ইউনিয়নের তাজপুর গ্রামে এই রামসাগর। দিঘির পাড়ে আম, জাম, কাঁঠাল, সেগুন, আমলকী, হরীতকী, দেবদারু, জারুল, কাঞ্চন, নাগেশ্বর, কাঁঠালিচাঁপা, বটসহ প্রায় ১৫২ রকমের গাছ দাঁড়িয়ে আছে। রয়েছে হরেক রকমের ফুল গাছ।

১৭২২-১৭৬০ পর্যন্ত দিনাজপুরের রাজা ছিলেন রাজা প্রাণনাথ। পলাশীর যুদ্ধের কিছুকাল আগে তিনি এই দিঘি খনন করিয়েছিলেন। তবে নামকরণ নিয়ে এই দিঘির সুনির্দিষ্ট কোনো লিখিত প্রমাণ নেই। যা আছে, তা লোকমুখে প্রচলিত বিভিন্ন কাহিনি।

রাজা প্রাণনাথের শাসনামলে একবার দেশজুড়ে দীর্ঘ সময় অনাবৃষ্টি আর খরা দেখা দেয়। খাদ্য ও পানির অভাবে ভোগে মানুষ। রাজা সিদ্ধান্ত নেন একটি দিঘি খনন করবেন।

মাত্র ১৫ দিনের মাথায় হাজার হাজার শ্রমিক দিন–রাত পরিশ্রম করে বিশালাকার এই দিঘি খনন করলেন। কিন্তু দিঘিতে জলের দেখা পাওয়া গেল না।

পরদিন রাজা স্বপ্নে আদিষ্ট হলেন, তাঁর একমাত্র ছেলে রামনাথকে সেই দিঘির মাঝখানে বলি দিলেই দিঘিতে পানি উঠবে। রাজা ছেলেকে জানালেন স্বপ্নের কথা।

প্রজাদের কষ্টের কথা চিন্তা করে পিতার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন রাম। দিঘির মাঝখানে নির্মাণ করা হলো মন্দির। বলি হওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন রাজপুত্র। দিঘির সিঁড়ি বেয়ে নামতেই দিঘিতে জল ওঠা শুরু হলো।

একসময় জলে টইটম্বুর হলো দিঘি। রাজপুত্র তলিয়ে গেলেন দিঘির অতলে। জলে ভেসে রইল রাজমুকুট। সেই থেকে দিঘির নাম হলো রামসাগর দিঘি।

শীতকালে অনেক পরিযায়ী পাখি আসে দিঘির পাড়ে। পর্যটকদের জন্য রামসাগর দিঘির পশ্চিম পাশে রয়েছে একটি সুন্দর দোতলা ডাকবাংলো।ডাকবাংলোর পাশেই রয়েছে একটি মিনি চিড়িয়াখানা। যার প্রবেশদ্বারটি বনলতায় বেষ্টিত।

যা চিড়িয়াখানার সৌন্দর্য্যে এনে দিয়েছে এক প্রাকৃতিক মুগ্ধতা। চিড়িয়াখানায় রয়েছে- হরিণ, বানর, অজগর, পাখিসহ বিভিন্ন প্রাণী। আপনাকে দেখে দৌড়ে আসবে হরিণের পাল।

চিড়িয়াখানা থেকে বের হয়ে হাতের বাঁ পাশে রামসাগর শিশুপার্ক। দিঘিটি নির্মাণের সময় পশ্চিম দিকের মাঝখানে প্রায় ৬ হাজার বর্গফুট আয়তনের বেলে পাথরের একটি সিঁড়ি নির্মাণ করা হয়েছিলো। যার কিছু অংশ এখনো অবশিষ্ট আছে। প্রতিবছর মাঘ মাসের পঞ্চমী তিথিতে এখানে বসে বারুণি মেলা।

হিন্দুধর্মাবলম্বীরা দিঘিতে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া রাজপুত্রের স্মরণে প্রতিবছর এই দিনে স্নান করতে এখানে আসেন।

১৯৬০ সালে এই দিঘিকে বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে আনা হয়। ১৯৯৫ সালে রামসাগরকে আধুনিক পর্যটনকেন্দ্র এবং ২০০১ সালে রামসাগরকে ঘিরে গড়ে ওঠা বনকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে রামসাগর ঐতিহাসিক পর্যটনকেন্দ্রের মধ্যে অন্যতম।

উপরে