পুঠিয়ায় পেঁয়াজ ৪২ কেজিতে মণ হওয়ায় হতাশ কৃষক

প্রকাশিত: মার্চ ১১, ২০২৪; সময়: ৭:১৬ অপরাহ্ণ |
খবর > কৃষি
পুঠিয়ায় পেঁয়াজ ৪২ কেজিতে মণ হওয়ায় হতাশ কৃষক

মোহাম্মদ আলী, পুঠিয়া : রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার চাষিরা পেঁয়াজ চাষে মহাব্যস্ত। গত মৌসুমের শেষ দিকে ভালো দাম পাওয়ায় চাষিরা এবারে চারা থেকে লাগানো পেঁয়াজ চাষে ঝুঁকেছেন। যদিও সার, কীটনাশক ও মজুরীর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। তারপরও লাগানো পেঁয়াজের পরিচর্যা করে ভালে ফলন পাওয়ার আশায় শুরু হয়েছে কৃষকের মাঝে ব্যাপক প্রতিযোগিতা। পেঁয়াজ গাছ কালো সুন্দর ও মোটা করার জন্য অতিরিক্ত কীটনাশক স্প্রে করে পাল্লাদিয়ে পরিচর্যায় ব্যস্ত চাষিরা।

গতবারের তুলনায় এবার উপজেলায় ১১৯ হেক্টর জমিতে চারা থেকে লাগানো পেঁয়াজের চাষ কম হয়েছে। চাষিরা বলছেন, পেঁয়াজ আমদানি না হলে তারা এবারও লাভের মুখ দেখবেন। তবে এই উপজেলায় আবাদ কম হলেও অন্য জেলায় চাষ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন বেশি হবে। এতে ইন্ডিয়া থেকে পেঁয়াজ আমদানি করলে দাম কমে যাওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন চাষিরা। এতে করে কৃষকের ১ বিঘা পেঁয়াজ উৎপাদন করতে যে টাকা খরচ হয়েছে আর এই সময় যদি পেঁয়াজ আমদানি করা হয় তাহলে কৃষক ক্ষতির মুখে পড়বেন।

গত মৌসুমের শেষ দিকে লাগলো পেঁয়াজে এবং এবার কন্দ, মূলকাটা বা ঢ্যামনা পেঁয়াজ চাষ করে লাভবান হওয়ায় চাষিরা চারা থেকে লাগানো পেঁয়াজ বেশি করেছেন। যারা গতবার পেঁয়াজ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন; তারাও এবার লাভের আশায় পেঁয়াজ আবাদ করেছেন। কৃষি শ্রমিকরা সূর্যোদয়ের আগেই মাঠে হাজির হচ্ছেন। সাত-সকালেই শ্রমিকদের পদচারণায় মুখর গ্রামের সড়ক কিংবা মেঠোপথ। সারাদিন কাজ শেষে বাড়ি ফেরেন সন্ধ্যার আগে। কৃষি শ্রমিকরা ভালো মজুরিও পাচ্ছেন।

পুঠিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, উপজেলায় এবছর ৪ হাজার ৫৩৫ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৭ হাজার ০৯৫ মেট্রিক টন। গত বছর ৪ হাজার ৬৫৪ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭৪ হাজার ৪৬৪ মেট্রিক টন।

উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল্লাহ, সোহেল রানা এবং শাহেদা খাতুন জানান, পেঁয়াজ চাষিরা দুটি পদ্ধতিতে পেঁয়াজের আবাদ করেন। একটি কন্দ (মূলকাটা বা ঢ্যামনা ) ও অন্যটি বীজ বপন করে চারা উৎপাদন করে চারা লাগানো পদ্ধতি। মূলকাটা বা ঢ্যামনা পদ্ধতিতে পেঁয়াজের আবাদ শুরু হয় অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ও চারা লাগানো পদ্ধতিতে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে। ঢ্যামনা পদ্ধতিতে আবাদ করা নতুন পেঁয়াজ ডিসেম্বর/ জানুয়ারী মাসে হাটে উঠতে শুরু করে। আর আলের লাগানো পদ্ধতিতে চাষ করা পেঁয়াজ হাটে ওঠে মার্চের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে এপ্রিল মাস পর্যন্ত।

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের বিলের মাঠে গিয়ে দেখা যায় এলাহি কান্ড। এলাকার শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষ পেঁয়াজের মাঠে। বাড়ির নারীরাও কাজে সহায়তা করছেন। পেঁয়াজ চাষিরা জানান, এ সময় কৃষি শ্রমিকের দাম বেড়ে গেছে। সূর্য ওঠার আগেই মাঠে হাজির হওয়া শ্রমিকরা জানান, তারা প্রতিদিন পেঁয়াজ লাগানোর সময় ৭০০ টাকা মজুরি পেয়েছেন এবং অন্য সময় ৫০০ টাকা মজুরি পায়।

দেশের এবং জেলার অন্যতম বড় পেঁয়াজের হাট পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর হাটে শনিবার ও ঝলমলিয়া সোমবার হাটে গিয়ে দেখা যায়, প্রতি মণ ঢ্যামনা ও একটু দাম ভালো পাওয়ার আশায় বোনা কম পুক্ত পেঁয়াজ তুলা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার পাচঁশত টাকা দরে। চাষিরা জানান, আগামী ১৫/২০ দিনের মধ্যে নতুন আলের বা হালী পেঁয়াজ হাটে উঠতে শুরু করবে। সরকার আমাদনি শুরু করলে দাম কমার আশঙ্কা আছে। আমদানি করলে চাষিরা ক্ষতির মুখে পড়বেন আর লাভবান হবেন মধ্যসত্ত্বভোগীরা অন্য দিকে বর্তমানে বোনা পেঁয়াজের দাম বেশি থাকায় বেশি লাভের আশায় অপরিপক্ক পেঁয়াজ তুলে বাজারে বিক্রি করছে কৃষকরা।

পুঠিয়া উপজেলার ছান্দাবাড়ী গ্রামের চাষি আব্দুল মতিন, চামটা এসকে বাদল গ্রামের পেঁয়াজ চাষি মানিক জানান, চারার দাম, জমি চাষ, সেচ, সার, নিড়ানি, শ্রমিক ও উত্তোলনসহ সকল খরচ মিলিয়ে বিঘাপ্রতি প্রায় ৪৫/৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। পাশাপাশি যারা অন্যের জমি লিজ নিয়ে আবাদ করেন; তাদের বিঘা প্রতি আরও ৯-১১ হাজার টাকা লিজমানি জমি মালিককে দিতে হয়। এজন্য তাদের খরচ হয় আরও বেশি। এছাড়া অনেক ছোট-বড় চাষি চড়া সুদে বিভিন্ন এনজিও থেকে কিস্তিতে ঋণ নিয়েও পেঁয়াজ চাষ করেন।

পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর খুটিপাড়া এলাকার চাষি মুক্তার আলী জানান, পেয়াঁজ ভালো হলে এক বিঘায় পেঁয়াজের গড় ফলন হয় ৭৫-৯০ মণ। এবার চাষ কিছুটা কম হয়েছে। এবার সবার ফলনও ভালো হবে তাই উৎপাদনও বাড়বে। এতে মৌসুমে দাম কমে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন তারা।

ধলাট গ্রামের চাষি মতিন জানান, তারা অন্যের জমি বাৎসরিক লিজ নিয়ে পেঁয়াজ চাষ করেন। পেঁয়াজ চাষ করে কোনো বছর লাভ আবার কোনো বছর ক্ষতি হয়। ক্ষতি হলে বছরে অন্য দুটি ফসল চাষ করে সে ক্ষতি পোষানোর চেষ্টা করেন তারা। আবার ৪২ কেজিতে মণ। একদিকে যেমন ন্যাযমূল্য থেকে বঞ্চিত অন্য দিকে আবার ওজনে ২ কেজি বেশি নিচ্ছে আড়ৎদাররা আবার ওষুধের যে দাম এতে খরচ হচ্ছে বেশি। সব কিছু মিলে চাষীরা লোকসানে থাকে।

উপজেলার কিছু জ্ঞানী মানুষ জানান, চাষিদের লাভবান করতে হলে মৌসুমের সময় ভালো দাম নিশ্চিত করা দরকার। এবং কৃষকদের কথা চিন্ত করে সেই সময় পেঁয়াজ আমদানি না করা। আবার ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য সরকারের দায়িত্বশীল বিভাগগুলোর সুষম বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা দরকার। এবং সবচেয়ে বানেশ্বরসহ রাজশাহী জেলার হাট বাজারের বড় সমস্যা হচ্ছে ৪২ কেজিতে মণ। একদিকে যেমন দাম কম অন্য দিকে আবার ওজনে ২ কেজি বেশি। তারপরেও নানা ধরনের সমস্যা করে এই সব হাটের আড়ৎদাররা। তাই কৃষককে লাভবান ও নায্য মূল্য পায়য়ে দেবার জন্য জেলা প্রসাশক ও উপজেলা প্রসাশনকে দায়িত্বশীল হতে হবে।

পুঠিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার স্মৃতি রানী সরকার জানান, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে উৎপাদনও বাড়ছে। উন্নত জাতও উদ্ভাবিত হয়েছে। গত মৌসুমে ভালো দাম পাওয়ায় চাষিরা এবার উজ্জীবিত। রবি মৌসুমের পেঁয়াজের পরিচর্যা প্রায় শেষের দিকেই। এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে আছে এবং শেষ পর্যন্ত যদি ভালো থাকে তাহলে কৃষকরা ভালো ফলন পেতে পারে। এ ছাড়াও আগামী খরিপ মৌসুমে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বীজ কৃষক পর্যায়ে সরকারি ভাবে সহযোগিতা করা হলে তারা বীজতলা তৈরি করে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করতে পারবে।

পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার একেএম নুর হোসেন নির্ঝরকে পুঠিয়া উপজেলায় পেঁয়াজ, রসুনসহ বিভিন্ন ফসল ৪২ কেজিতে মণ বিক্রি হচ্ছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই প্রথম জানলাম ৪২ কেজিতে, যারা ভুক্তভোগি তাদেরকে দিয়ে আমার কাছে একটা লিখিত অভিযোগ পাঠান। অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমি এক সপ্তাহ তদন্ত করে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে