উদয়ে তার ভোরের সুষমা

প্রকাশিত: ২০-০৬-২০২৪, সময়: ১২:০৫ |

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : কর্ণফুলীর তীরে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে সূর্যোদয় দেখতে ভোরের অপেক্ষা পূর্ণ হল এই পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এক ফুলের উদয় দেখে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যার নাম দিয়েছিলেন- উদয়পদ্ম। বাংলায় আরেক নাম হিমচাঁপা। ইংরেজিতে ম্যাগনোলিয়া; Magnolia grandiflora এর বৈজ্ঞানিক নাম ।

খানিকটা দেরিতে ওঠায় সূর্যোদয় দেখার সুযোগ মেলেনি। রাতের বৃষ্টির পর সকাল ছিল অনেকটা মেঘে ঢাকা।

কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের বনফুল রেস্টহাউজের দোতলার বারান্দায় দাঁড়ালে দেখা যায়, খরস্রোতা কর্ণফুলী চলে গেছে বনের কোল ঘেষে। নানা রকম পাখির ডাক আর প্রজাপতির ওড়াওড়ি দেখতে দেখতে সকাল হয়।

কাছেই একটা উঁচু কাঁঠাল গাছে তিনটি কাঠবিড়ালীর দৌড়ঝাঁপ চোখে পড়ল। দুটি কাঁঠাল ঘিরেই তাদের তৎপরতা। একমনে কাঁঠাল খেয়ে চলেছে তারা।

সকাল সাড়ে ৬টার দিকে হঠাৎ চোখে পড়ে একটি গাছে সাদা ডিম আকৃতির একটি ফুল। প্রথম দেখায় মনে হল, এ বুঝি দুলিচাঁপা বা দেশি ম্যাগনোলিয়া। কিন্তু এ গাছের পাতা দেখতে অনেকটা কাঁঠাল পাতার মত।

তখনো চারপাশে প্রকৃতির নানা আয়োজন ছাড়া কেবলই নীরবতা। বন বিভাগের কর্মী মো. রিপন রেস্ট হাউজের মূলফটকে তালা দিয়ে নিজের ঘরে ঘুমিয়ে।

ঘণ্টাখানেক অপেক্ষায় থাকার পর দোতলার বারান্দা থেকে চোখে পড়ে, ধীরে ধীরে ফুটতে শুরু করেছে ফুলটি। ডালের ঠিক অগ্রভাগে একাকী আকাশের দিকে মুখ করে পাপড়ি মেলতে শুরু করেছে।

রিপনকে জাগিয়ে মূলফটক খুলে দেখা গেল, পদ্মের মত ফুটে অপরূপ শোভার- উদয়পদ্ম।

নদীর দিক থেকে আসা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে ম্যাগনোলিয়ার মনমাতানো সুঘ্রাণ। সেই গন্ধে উড়ে এসেছে এক প্রজাপতি। ভ্রমরের আনাগোনাও চোখে পড়ল।

আটটি পাপড়ি ছড়িয়ে আছে। মাঝের অনেকগুলো পুংকেশর আর ডিম্বাশয় ঘিরে আছে আরও চারটি পাপড়ি। তাই এই ব্যুহ ভেদ করে সহজে পরাগের কাছে ভিড়তে পারে না পোকামাকড়।

সূর্যের আলো যখন ঠিকরে পড়ে ম্যাগনোলিয়ার ডালে, তখন ঝলমল করতে থাকে ফুল। আর সেই মুহূর্তে উপলব্ধি হয়, উদিত সূর্যের সঙ্গে কী মিল পেয়েছিলেন রবি ঠাকুর, কেন নাম দিয়েছিলেন উদয়পদ্ম।

শুধু নাম দিয়েই ক্ষান্ত হননি, রবীন্দ্রনাথের নানা রচনায় ঠাঁই পেয়েছিল ম্যাগনোলিয়া। যেমন মহুয়া কাব্যগ্রন্থের ‘মুক্তি’ কবিতায় লিখেছেন- “মনের ‘পরে খেলায় বায়ুবেগে/কত-যে মায়া-রঙের ছায়া/খেয়ালে-পাওয়া মেঘে/বুলায় বুকে ম্যাগ্নোলিয়া/কৌতূহলী মুঠি/অতি বিপুল ব্যাকুলতায়/নিখিলে জেগে উঠি।”

আবার শৈশব সংগীত-এ ‘ফুলবালা’ কবিতায় নানা ফুলের বর্ণনার মাঝে লিখেছেন, “ঘার উঁচু করি হোথা গরবিনী/ফুটেছে ম্যাগনোলিয়া—/কাননের যেন চখের সামনে/রূপরাশি খুলি দিয়া!/সাধাসাধি করে কত শত ফুল/চারি দিকে হেথা হোথা/মুচকিয়া হাসে গরবের হাসি/ফিরিয়া না কয় কথা!”

দক্ষিণ আমেরিকার এই ‘গরবিনী’ কী করে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে এল? বছর দেড়েক ধরে বনফুল রেস্টহাউজে থাকা মো. রিপন এর কোনো হদিস দিতে পারলেন না। জানালেন, প্রায় আট ফুট উচ্চতার গাছটি শুরু থেকে এমনই দেখছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের (রাঙামাটি) বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. জাহিদুর রহমান মিয়ার দ্বারস্থ হতে হল। তিনি জানালেন, ২০০০ সালে এই রেস্টহাউজটি নির্মাণ করা হয়। সম্ভবত তখনই গাছটি রোপন করা হয়েছিল।

“কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের কর্ণফুলি রেঞ্জের অধীনে কাপ্তাই মুখবিট ফরেস্ট রেস্টহাউসের সামনে আরেকটি উদয়পদ্মের গাছ দেখেছি।

“উদয়পদ্ম বা হিমচাঁপা খুব ধীরে বর্ধনশীল একটি গাছ। আর এর বিবর্তন প্রক্রিয়া থেকে ধারণা করা হয় এটি একটি আদিম উদ্ভিদ।”

ওয়াশিংটনভিত্তিক বৃক্ষ ও বাগান বিষয়ক অনলাইন কেয়াহেইস এস্টেট (Caerhays estate) এর তথ্য অনুযায়ী, “বিবর্তনের ইতিহাস অনুসারে সবচেয়ে প্রাচীন উদ্ভিদগুলোর একটি ম্যাগনোলিয়া। জীবাশ্ম নমুনা থেকে দেখা যায়, প্রায় একশ মিলিয়ন বছর আগে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ায় এ উদ্ভিদ ছিল।

যদিও এখন ম্যাগনোলিয়া মূলত দক্ষিণ আমেরিকা ও দক্ষিণ চীনের উদ্ভিদ। ম্যাগনোলিয়ার প্রায় ৮৯টি প্রজাতি আছে, যার অর্ধেক ক্রান্তীয় অঞ্চলের।

বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. জাহিদুর রহমান মিয়া বলেন, এই গাছগুলোর সর্বোচ্চ উচ্চতা হয় ১৮ থেকে ৩০ মিটার। এটি যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের জাতীয় ফুল। উদয় পদ্ম গ্রীষ্ম ও উপগ্রীষ্মমণ্ডলীয় এশিয়া, মেক্সিকো, পশ্চিম ভারতীয় দীপপুঞ্জ এবং মালয়েশিয়াতেও পাওয়া যায়।

উদয়পদ্ম বা হিমচাঁপা Magnoliaceae পরিবারের অধীন মাঝারি আকারের একটি সপুষ্পক বৃক্ষ। ফুলের রঙ, সুগন্ধি এবং ধীরে বৃদ্ধির কারণে এই গাছটি নগরের ল্যান্ডস্কেপিং সজ্জার জন্য খুবই উপযোগী।

বিপ্রদাশ বড়ুয়া প্রকৃতি সমগ্র-১ গ্রন্থে লিখেছেন, বলধা গার্ডেনের সাইকিতে ঢোকার পর সোজা উত্তর দিকের রাস্তার দুপাশে উদয়পদ্মের সারি আছে।

“ফুল থেকে কাঁঠালের আঁটির মতো মুঠো সমান বীজ হয়। বসন্ত শেষে ও গরম কালে ফুল ফোটে। কখনও কখনও বর্ষায় পাওয়া যায়।… রমনা, সোহরাওয়ার্দী এবং ঢাকা শহরে ইতস্তত এটা দেখা যায়।”

জাহিদুর রহমান মিয়া জানান, বাংলাদেশে ২০১২ সালের বণ্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-৪ অনুযায়ী এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।

প্রথমদিন ফুল ফুটতে দেখলেও এর পরাগকেশর দেখার সুযোগ মেলেনি। সেদিন বিকেল হতে হতেই পাপড়ির নতুন বিন্যাস চোখে পড়ল। তখন দুই ধাপে চারটি করে পাপড়ির সজ্জা।

মাঝের অংশকে ঘিরে যে প্যাগোডার মত চারটি পাপড়ি ছিল, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো চারটি পাপড়ি সেই অংশকে ঘিরে নিল। ছড়িয়ে থাকা শুধু চারটি পাপাড়িও বিস্তার অনেকটা গুটিয়ে এনেছে।

পরের দিন ভোরে আবারও পাপড়ি মেলেছিল উদয়পদ্ম। তবে সেদিন পাপড়ি ছিল অনেকটাই ছড়ানো। মাঝের পুংকেশর ও ডিম্বাশয়কে ঘিরে থাকা চারটি পাপড়িও আগের দিনের চেয়ে খানিকটা শিথিল।

তৃতীয় দিন একে একে খসে পরে মাখন রঙা পাপড়ি। বিপুলা পৃথিবীতে বনের প্রান্তে নীরবে সুষমা ছড়িয়ে উদয়পদ্ম মিলিয়ে যায়।

উপরে