এবারে আলু চাষে কৃষকের বাড়তি খরচ চারশো কোটি টাকা
নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহী জেলায় আলুচাষের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে শুধু বীজেই উৎপাদন খরচ বাড়ছে প্রায় ১৪১ কোটি টাকা। এছাড়াও জমি লীজে বাড়বে প্রায় ২৬০ কোটি ৪০ লাখ টাকা। সার, কীটনাশক ও শ্রমিক খরচ ছাড়াই বীজ ও জমির লীজেই চাষিদের বাড়তি গুনতে হবে প্রায় ৪০১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ নিয়েই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন রাজশাহীর কৃষকরা। এতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, চলতি বছর রাজশাহী জেলায় আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ হাজার হেক্টর (দুই লাখ ৬০ হাজার ৪০০ বিঘা) জমি। সেই হিসেবে বীজ আলুর চাহিদা ৯৪ হাজার টন (নয় কোটি ৪০ লাখ কেজি)। যার প্রতিকেজি বীজে বেড়েছে প্রায় ১৫ টাকা এবং প্রতি বিঘা জমিতে বেড়েছে প্রায় ১০-১৫ হাজার টাকা। গতবছরের চেয়ে এবারে প্রতি বিঘা জমিতে আলুচাষে বাড়তি গুনতে হচ্ছে ২৫-৩৫ হাজার টাকা। সবমিলিয়ে এবারে আলু চাষে খরচ হচ্ছে ৭০-৭৫ হাজার টাকা। আর প্রতি বিঘা জমিতে আলু উৎপাদন হবে প্রায় ৫৫-৬০ বস্তা (প্রতি বস্তা আলুর ওজন ৫৫ কেজি)।
রাজশাহী জেলার প্রধান অর্থকরি ফসল আলু। জেলার বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে আলুর বীজ রোপণ। তবে আলু বীজের দাম বাড়ায় সৃষ্টি হয়েছে নানা সংকট। গতবারের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে আলু বীজ। এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও আলু বীজের দাম বাড়িয়েছে। গত বছরের চেয়ে এবারে প্রতিকেজি আলুবীজে ১০-১২ টাকা বাড়িয়েছে। এতে চাষিদের মধ্যে একটা হতাশা দেখা দিয়েছে।
এবারে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে প্রায় গতবারের চেয়ে প্রায় চারশো’ কোটি টাকা বেশী গুনতে হবে চাষিদের। আলুবীজ ও জমি লীজের পাশাপাশি একই সঙ্গে বেড়েছে সার ও কীটনাশকসহ শ্রমিকের খরচও। ফলে এ বছর প্রতি বিঘা জমিতে আলু উৎপাদনে কৃষকদের ব্যয় বাড়বে ২৫ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা। আলুর আবাদের খরচ বাড়ায় বিপাকে আলু চাষিরা। এতে আলুর দাম বৃদ্ধির সঙ্গে লোকসানের আশঙ্কায় প্রান্তিক কৃষকরা। বীজের দাম বাড়ায় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)-কে দুষছেন প্রান্তিক চাষিরা।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি ) এবারে প্রতিকেজি আলু বীজের দাম করেছে এ-গ্রেড ৬১ এবং বি-গ্রেড ৬০ টাকা। গতবছর ছিল এ-গ্রেড ৫০ এবং বি-গ্রেড ৪৮ টাকা। পুরো দেশে ৩০টি হিমাগারে মাত্র ৪০ হাজার টন আলু বীজ সংরক্ষন করে থাকে এই সরকারি প্রতিষ্ঠানটি। যদিও এই প্রতিষ্ঠানের বীজে দেশে আলু উৎপাদনের এক শতাংশই পূরণ হয় না। তবে আলু বীজের দামের ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব ব্যাপক। বেসরকারি বীজ কোম্পানীগুলো বিএডিসি দামকে টার্গেট করে বীজের দাম নির্ধারণ করে থাকে।
জানা গেছে, এরই মধ্যে বেসরকারি বীজ কোম্পানীগুলোও তাদের ডিলারদের কাছে বাড়তি দামের জানান দিয়েছেন। গত বছর হীরা কোম্পানীর প্রতি কেজি আলু বীজের দাম ছিল এ-গ্রেড ৬৩ এবং বি-গ্রেড ৬৬ টাকা। এবারে জানান দিয়েছে ৭০-৮০ টাকার মধ্যে দাম থাকবে। এ আর মানিক সিড্স’র এ-গ্রেড ৭৭ টাকা। এবারে অন্ত:ত কেজিতে ১০-১২ টাকা বৃদ্ধি পাবে। উৎপাদন ভাল হওয়ায় রাজশাহী জেলাজুড়েই ব্র্যাকের আলু বীজের চাহিদা অনেকটাই বেশী। প্রতিবছরই অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় এ বীজের দাম। যদিও গতবছর প্রতিকেজি বীজের দাম এ-গ্রেড ৬৬ এবং বি-গ্রেড ৬৩ টাকা থাকলেও কৃষক পর্যায়ে এই দামে পাওয়া যায়নি। জানা গেছে অনেক বেশী দামে কিনতে হয়েছে। এবারে সম্ভাব্য প্রতিকেজি ব্র্যাকের আলুবীজের দাম থাকবে ৭৫-৮৫ টাকা।
হুজুরীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও আলুচাষি মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, সার, বীজ, জমিলীজ ও কীটনাশক এবং বিশেষ করে শ্রমিকের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবারে প্রতি বিঘা আলুচাষে প্রায় ৩০ হাজার টাকা বাড়তি গুণতে হবে। আবার আলুচাষের ভরা মৌসুমে কৃত্রিম খাটতি দেখিয়ে ব্যবসায়ী ও ডিলাররা সিন্ডিকেট করে বীজ ও সারের সংকট তৈরী করেন। এতে হিসাবের আর ঠিক থাকে না। তখনও বাড়তি টাকা গুণতে হয় চাষিকেই।
রাজশাহী জেলা বিএডিসি বীজ ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম জানান, এবারে বিএডিসি’র প্রতিকেজি বীজের দাম বেড়েছে ১০-১২টাকা। এ-গ্রেড ৬১ এবং বি-গ্রেড ৬০ টাকা। অথচ উৎপাদন খরচ ছিল প্রতিকেজি প্রায় ৩৫ টাকা। সংরক্ষণ খরচ আরো ১০ টাকা বৃদ্ধি পেলে ৪৫ টাকা হয়। এটা কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন হলেও বাণিজ্যিকভাবে লাভের বিষয়ে চিন্তা করেই দাম বাড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠান মনে করলে ৫০-৫২ টাকা প্রতিকেজি বীজ সরবরাহ করতে পারতো। তিনি আরো বলেন, ‘এ নিয়ে কৃষকের কথা চিন্তা করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে বসা হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাদের কথা শুনেননি। কর্মকর্তারা জানান, বাজারে আলুর দাম বেশী থাকায় বীজের দাম বাড়ানো হয়েছে।
বিএডিসির রাজশাহীর উপ-পরিচালক আব্দুল কাদের বলেন, ‘খাবার আলুর দাম বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে বীজ আলুর দাম। কারণ বাজারে খাবার আলু যে দামে বিক্রি হচ্ছে তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই দাম নির্ধারণ করা হয়। তা না হলে মানুষ বীজ আলু নিয়ে যেয়ে খাবার হিসেবে বিক্রি করবে। তবে তিনি আরো বলেন, ‘বিক্রয় মূল্য ৫০-৫২ টাকা হলে চাষিরা খুশী হতেন এবং আমারো ভাল লাগতো’।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোছা. উম্মে সালমা জানান, এ বছর বীজের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের আলু উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাবে। তাই আমরা কৃষকদের অধিক ফলনশীল জাতের আলু চাষের পরামর্শ দিচ্ছি। একইসঙ্গে মাঠে থেকে কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি। তিনি আরো বলেন, জেলায় এবার আলু রোপণের লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ হাজার হেক্টর নির্ধারণ করা হয়েছে। উৎপাদন খরচ বাড়লেও লাভ বেশি পেয়ে কৃষকরা আলু চাষে আগ্রহী হওয়ায় জেলায় এবারও লক্ষ্যমাত্রার বেশি আলু উৎপাদন হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।