অতল জলে জলাঞ্জলী ৫ম পর্ব: ফাল্গুনী মিষ্টি বিকেল
এ কে সরকার শাওন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলের তৃতীয় তলার একটি কক্ষ। দুপুরের খাবারের পর জগলু বারান্দায় উদোম গায়ে একটি কেদারায় বসে পায়ের উপর পা ভাঁজ করে রেখে হা করে আমের তামাটে মুকুল দেখছে আর আয়েশ করে ক্যাপস্ট্যান ধূমপান দণ্ড ফুঁকছে। মাঝে মাঝে ঠোঁট দু’টো গোল করে মুখ থেকে গোলাকার ধোঁয়ার কুন্ডলী ছাড়ছে। ডান পাশে অন্য একটি কেদারার উপর ভাঙ্গা হাতল বিশিষ্ট চায়ের পেয়ালায় ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ধূমপান দণ্ডে টোকা দিয়ে ছাই ফেলছে। এমন সময় জিল্লুর এসে আশ্চর্য হয়ে বললো
-বাহ বাহ, তুই এখও নবাবী শৈলীতে বসে ধুমপান করছিস?
জগলুঃ
তোকে বলি নবাবী শৈলী
আমার আকবরী খায়েশ;
সিপাহী নেই শান্ত্রী নেই
তবু তো আছি বেশ;
থাকতে দে না নবাবী রেশ!
জিল্লুর কৃত্রিম রেগে বললো
-তুই উঠবি কি-না বল?
জগলুঃ আহ চটছিস কেন? তুইও এখানে বসে আয়েশ করে একটি ধূমপান দণ্ড ধরা। আমার সাথে নবাব বনে যা।
জিল্লুরঃ না, আমি ওসব ছাই ভস্ম গিলি না।
জগলুঃ তা বেশ, এখানে একটু তো বস।
জগলু কেদারা থেকে হাতল ভাঙ্গা পেয়ালাটা সরিয়ে গামছা দিয়ে উড়ে পড়া ছাই মুছে দিলো। উপরে থাকা কবিতার খাতাটা পড়ে গেলো। জিল্লুর খাতাটা উঠিয়ে হাতে নিল।
জগলু চেয়ারটি ঘুরিয়ে জিল্লুরকে নীজের মুখোমুখি করে বললো
-আরে বস তো।
জিল্লুরঃ দাঁড়াও বৎস, আগে দেখি আজ কী লিখেছো! সে কবিতাংশটি আবৃত্তি করতে লাগলো।
“বসন্ত আয় সুরের খেয়ায়
নাতিশীতোষ্ণ হাওয়ায়;
প্রাণে লাগে দোলা ধরণী উতলা
ফাল্গুনী গান গায়!”
বাহ দারুণ লিখেছিস কবি! তা কী শিরোনাম দিলি?
জগলুঃ এখনো চুড়ান্ত করিনি। ভাবছি ফাল্গুনী গান শিরোনাম দিবো। এবার বল বালিয়াপুকুর কেন নিয়ে যাবি আমাকে?
জিল্লুরঃ বালিয়াপুকুর আমার ফুফুর বাড়ী। ফুফু নাটোরে সিরাজদৌলা কলেজের গণিতের শিক্ষক। ফুফার নাটোর ও নওগাঁতে দুটো ফ্যাক্টরী আছে। তিনিই দেখাশোনা করেন। গতকাল রাতে খাবার সময় আমাকে ফুফু বললেন
-জিল্লুর, দেখতো ভালো একটা গৃহ শিক্ষক মেলে কী না! অবশ্যই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হতে হবে। গণিত বা ইংরেজি বিভাগের হলে ভালো হয়। যে গণিতে ভালো সে সবখানে ভালো। তখন তোর কথা মনে পড়লো। তুই গত সাপ্তহে বলেছিলি না তোর আরও একটা ছাত্র-ছাত্রী পড়ানো দরকার।
উৎফুল্ল জগলু বললো
-হুম, বলেছিলাম? তা কাকে পড়াতে হবে বন্ধু?
জিল্লুরঃ ফুফুর দুই মেয়ে জুহি ও মাহি। বড় মেয়ের নাম জুহি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ২য় বর্ষে পড়ে। সে তুখোড় ছাত্রী।
জগলুঃ তাকেই পড়াতে হবে?
জিল্লুরঃ আরে না, তাকে নয়। তাকে পড়াতে লাগলে শেষ পর্যন্ত তুই আবার আমার ভগ্নীপতি হয়ে যেতে পারিস।
জগলুঃ বয়েই গেছে আমার তোর বোনকে বিয়ে করতে
জিল্লুরঃ কবিদেরকে ছেলে মেয়েরা একটু বেশী পছন্দ করে কী না তাই বললাম!
জগলুঃ তা কাকে পড়াতে হবে মহাশয়?
জিল্লুরঃ পড়াতে হবে ওর ছোট বোন মিহিকে। সে মধ্যম মানের ছাত্রী। গনিত ও ইংরেজিতে ওর আরও একটু ভালো করা দরকার। এই দু’টি বিষয় তোকে দেখতে হবে।
জগলুঃ কোন ক্লাসে পড়ে?
জিল্লুরঃ ৯ম শ্রেণি, বিজ্ঞানে, প্রমথনাথ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ে…
জগলুঃ আমি বাচ্চাদের পড়াই না তুই জানিস।
জিল্লুরঃ তোর পায়ে পড়ি দোস্ত এর পর তোকে আর বাচ্চা পড়াতে বলবো না।
জগলুঃ ঠিক আছে দেখবো। আমার বিষয়টি দ্রুত ভাবার জন্য তোকে কী দিয়ে যে ধন্যবাদ দিবো!
জিল্লুরঃ আগেই ধন্যবাদ দিস না। আগে এক মাস পড়া।
জগলুঃ এক মাস কেন?
জিল্লুরঃ ওখানে কোন গৃহ শিক্ষক দুই এক মাসের বেশী টেকসই হতে পারে না তো তাই!
জগলুঃ কেন মিহির কী পড়াশোনায় মন বসে না।
জিল্লুরঃ না, মিহি কোন সমস্যা না। ফুফু-ফুফাও কোন সমস্যা না।
জগলুঃ তবে সমস্যা কি টাকা পয়সায়?
জিল্লুরঃ আরে না, টাকা পয়সা ফুফু একটু বেশীই দিবে।
জগলুঃ তাহলে সমস্যাটা কোথায় শালা?
জিল্লুরঃ জুহি, জুহি সমস্যা। সে মিহির অভিভাবক সেজে গৃহ শিক্ষকের উপর মাতুব্বরি করে। শিক্ষককে পড়া ধরে।
জগলুঃ তাহলে তুই-ই পড়া দোস্ত।
জিল্লুরঃ আরে আমাকে তো ওরা বন্ধু মনে করে। আমার সাথে দুষ্টামি ও রসিকতা করে। আমাকে পাত্তা দেয় না।
জগলুঃ কেন তোর কী জুহির সাথে ইয়ে আছে না-কী?
জিল্লুরঃ ধ্যেৎ, ওদের আমি নিজের বোন মনে করি। আমার দ্বারা ওদের পড়ানো হবে না। তুই ই পারবি। তুই গণিতের ছাত্র আবার ইংরেজিতে দক্ষ। চলতো এবার।
জগলুঃ কিন্তু…
জিল্লুরঃ আবার কিন্তু কি? তোর কাছে হাত জোড় করে মিনতি করি দোস্ত আর কিন্ত টিন্তু নয়। চট করে তৈরী হয়ে নে। আমি ততক্ষণে খবরের কাগজটায় চোখ বুলিয়ে নেই।
আচ্ছা বলে জগলু প্রক্ষালন কক্ষের দিকে চলে গেলো।
৫ম পর্বঃ ফাল্গুনী মিষ্টি বিকেল
উপন্যাসঃ অতল জলে জলাঞ্জলী
এ কে সরকার শাওন
শাওনাজ ভিলা, উত্তরখান, ঢাকা।