আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ইস্যুতে নানামুখী চাপে সরকার
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত পাঁচই আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে দলটিকে নিষিদ্ধ করার প্রসঙ্গ উঠে আসছে। বিষয়টি নিয়ে এখন রাজনৈতিক মতবিরোধের পাশাপাশি কূটনৈতিক চাপের কথাও শোনা যাচ্ছে।
বিবিসি বাংলায় মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সোমবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, গণতন্ত্রের কথা বলে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করতে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস থেকে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করছে।
“আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের কথা যখন সরকারের পক্ষ থেকে আমরা বলি, রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকেই তখন তাদের বক্তৃতায়, কথায় সেটার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে,” যোগ করেন উপদেষ্টা আসিফ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এর আগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ প্রশ্নে বিএনপির বিরুদ্ধে ক্ষোভ দেখিয়েছিল। এখন একজন উপদেষ্টা বলছেন কূটনৈতিক চাপের কথা।
এর একদিন আগে ঢাকা সফরে আসা যুক্তরাজ্যের আন্ডার সেক্রেটারি (উপমন্ত্রী) ক্যাথেরিন ওয়েস্ট বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেন।
রাজনীতিতে আওয়ামী লীগও সমান সুযোগ পাবে, সরকারের দিক থেকে তেমন উদ্যোগ প্রত্যাশা করেন কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে মিজ ওয়েস্ট বলেন, “অবশ্যই এবং আমরা আশা করি অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের গণতন্ত্র কীভাবে এগিয়ে যাবে তার একটি রূপরেখা তুলে ধরবেন।”
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে সোমবার মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে ‘হামলা’ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার অধিকারকে সমর্থন করে তার দেশ।
এদিকে, ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য হিন্দুকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাননি তারা। তিনি বলেন, বিএনপি চায় সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক।
বিএনপি যেহেতু বাংলাদেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দল, তাই তাদের মতামতকে অগ্রাহ্য না করার কথাও জানান অধ্যাপক ইউনূস।
কিন্তু, দমন-পীড়ন ও হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি দলটিকেও বিচারের মুখোমুখি করতে আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে। এ অবস্থায় এসব রাজনৈতিক ‘চাওয়া’ ও কূটনৈতিক ‘চেষ্টা’ সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ভবিষ্যতের জন্য কী অর্থ বহন করছে?
গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর আন্দোলনে থাকা পক্ষগুলোর মধ্যে মতবিরোধ প্রথম স্পষ্ট হয় রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে। এরপর আওয়ামী লীগের রাজনীতি প্রসঙ্গে বিএনপি’র দিকে রীতিমত সন্দেহের আঙুল তোলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
“আওয়ামী লীগকে সাথে নিয়ে বিএনপি নির্বাচনে যেতে চায়,” ছয়ই নভেম্বর পঞ্চগড়ে এক বক্তৃতায় এ অভিযোগ করেন সংগঠনটির আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, “দলীয়ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি যে অনুমোদন বা অনুমোদনহীনতা কোনোটাই করবো, সেটা আমাদের কর্ম না। কর্ম জনগণের যে আওয়ামী লীগের রাজনীতি গ্রহণ করবে কি না, বা ফ্যাসিবাদী গণহত্যাকারী দলকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আহ্বান করবে কিনা।”
মঙ্গলবার এক ফেসবুক পোস্টে হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আওয়ামী পুনর্বাসনের জন্য যারা উদ্যোগ নেবে, তাদেরকে ইতিহাস গণশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করবে।
“জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে যারা ধারণ করে, তারা ২৪ পরবর্তী বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করার দাবি ছাড়া আওয়ামী লীগ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আর কোনো দ্বিতীয় বক্তব্য দিতে পারে না,” যোগ করেন তিনি।
অবশ্য এদিনই পেশাজীবী পরিষদের এক আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “আমরা চাই না হাসিনা আবার ফিরে আসুক। চাইনা আওয়ামী লীগের দুঃশাসন আবার ফিরে আসুক।”
তবে, বিএনপি যে কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পক্ষে নয় সে বিষয়ে মির্জা ফখরুলও একাধিকবার কথা বলেছেন।
নভেম্বরের শুরুতে জাতীয় পার্টি এবং বৈষম্যবিরোধীসহ কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তিনি বলেছিলেন, “রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার আমরা কারা?”
‘আনপ্লেজ্যান্ট বাট নেসেসারি’-
আটই আগস্ট অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাবশালী দেশগুলোর পক্ষ থেকে সমর্থন পায়। এই সরকারের সাথে সংস্কারসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজ করার ব্যাপারে নিজেদের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন পশ্চিমা দেশগুলোর ঢাকায় নিযুক্ত প্রতিনিধিরা।
কিন্তু, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আছে এমন পশ্চিমা দেশগুলো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ প্রশ্নে সরকারের সাথে ভিন্নমত পোষণ করছে বলেই মনে হচ্ছে। কারণ, “বন্ধু রাষ্ট্রগুলো শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ চায়। কাউকে এক্সক্লুড করতে (বাইরে রাখতে) গেলে সংঘাতের আশংকা বাড়ে। সেজন্যই বন্ধু রাষ্ট্রগুলো তাগিদ দিচ্ছে যাতে অন্তর্ভূক্তিমূলক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাটাকে নেয়া যায়,” বলছিলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির।
“এটা আনপ্লেজ্যান্ট বাট নেসেসারি,” যোগ করেন মি. কবির।
কূটনীতিকদের যে তৎপরতার কথা বলা হচ্ছে, তা অস্বাভাবিক নয় বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক অধ্যাপক সাহাব এনাম খান।
আওয়ামী লীগের ব্যাপারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের তীব্র ক্ষোভের ব্যাপারটি তাহলে কীভাবে দেখা হচ্ছে? এমন প্রশ্নে অধ্যাপক খানের বিশ্লেষণ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গণতন্ত্র সম্পর্কে ধ্যান ধারণার সাথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটা ফারাক আছে।
“বিদেশিরা যেভাবে বাংলাদেশের দলগুলোকে দেখছে, সেভাবে বাংলাদেশের জনগণ সবসময় দেখেছে বলে মনে হয় না,” বলেন তিনি। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই শিক্ষকের ধারণা, আগামীতে কূটনীতিকদের তরফে এমন তৎপরতা আরো বাড়তে পারে।
রাজনৈতিক ‘চাওয়া’ ও কূটনৈতিক ‘চাপের’ প্রভাব কী?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের মন্ত্রী এমপিদের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা’র অপরাধে বিচারের কথা বলে আসছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার জন্য এক মাসের সময় বেঁধে দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এদিকে মঙ্গলবার আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের কিছু সংশোধনী আনার জন্য বুধবার উপদেষ্টা পরিষদে তোলা হবে।
এমন বাস্তবতায় “আওয়ামী লীগ যদি আবার জনগণের কাছে আসতে চায় তাদের অনুশোচনা বা ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে” বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম।
কিন্তু, “গণতন্ত্রের কথা বললে সব দল, মত, বিশ্বাসের সুযোগ থাকা দরকার। সেই সুযোগগুলোর মধ্যে কাকে নাগরিকরা গ্রহণ করবে নাকি গ্রহণ করবে না সেটা আইনগত বিধান দিয়ে আটকে দেয়ার চেষ্টা খুব একটা কাজ করে না,” বলেন অধ্যাপক ইসলাম।
তার মতে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে বিএনপি’র বরাত দিয়ে অধ্যাপক ইউনূস যা বলেছেন তাকে ‘এন্ডোর্সমেন্ট’ কিংবা সরকারের সুনির্দিষ্ট অবস্থান হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। “বিএনপি একটা পক্ষ মাত্র, অন্য যে পক্ষগুলো আছে তাদের সবার মধ্যে যদি একটা বোঝাপড়া তৈরি না হয়, বিষয়টা সহজ হবে না,” যোগ করেন তিনি।
আবার, কূটনীতিকদের মতামত যদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর বোঝাপড়ার সঙ্গে না মেলে সেগুলো কার্যকর হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে বলে মনে অধ্যাপক মারুফুল ইসলাম।
আন্তর্জাতিক মহলের মনোভাবের ব্যাপারে একই মত সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবিরেরও। তিনি বলেন, কূটনৈতিক দিক থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার বাংলাদেশের সরকার ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর।