‘মেমসাহেব’-এর নিমাই ভট্টাচার্য

প্রকাশিত: জুন ২৭, ২০২০; সময়: ৩:৩১ অপরাহ্ণ |
‘মেমসাহেব’-এর নিমাই ভট্টাচার্য

মিন্টু চৌধুরী : সাংবাদিক-সাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্য এর লেখার সাথে পরিচয় সেই স্কুল পার হওয়া সময় থেকে তার কালোত্তীর্ণ উপন্যাস ‘মেমসাহেব’ এর কল্যাণে। প্রথমবার এক নিমিষেই পড়ে ফেলা উপন্যাসটির কেমন যেন টান। আবারও পড়তে উৎসাহিত হয়েছিলাম। এত ঝরঝরে সহজ গদ্যে লেখা উপন্যাস মনের মধ্যে এক ধরনের ছাপ ফেলেছিল।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে নিমাই ভট্টচার্যের আরও কিছু বই পড়ার সুযোগ হয় এবং সহজ গদ্যের জন্য তার লেখার ভক্ত হয়ে পড়ি। বড় হয়ে সাংবাদিকতা পেশার সাথে যুক্ত হওয়ায়, একজন সাংবাদিক মানে পুরোদস্তুর একজন রিপোর্টারের কথাসাহিত্যিক হয়ে ওঠার বিষয়টি আমাকে তার প্রতি আগ্রহী করে তোলে। জেনে এসেছি, একজন মাঠের রিপোর্টার সচরাচর অত ভালো সাহিত্যিক হতে পারেন না। কিন্তু পুরোদস্তুর একজন ডিপ্লোম্যাটিক রিপোর্টার হওয়া সত্ত্বেও তিনি একের পর এক লিখে গেছেন উপন্যাস, তা অবাক করার মতোই।

তার লেখা ‘রিপোর্টার’, ‘ডিপ্লোম্যাট’, ‘পিকাডেলি সার্কাস’, ‘লাস্ট কাউন্টার’, ‘কয়েদী’, ‘চিড়িয়াখানা’ ‘বংশধর’, ‘তোমাকে’সহ আরও বেশ কয়েকটি বই একপ্রকার গোগ্রাসে গিলেছি। চট্টগ্রামের বিভিন্ন বইয়ের দোকানে এখনো খুঁজি নিমাই ভট্টচার্যের কোনো বই এসেছে কি না। আসলেই কিনে নিই। তার লেখার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণের আরও একটি কারণ হল সহজপাঠ্য এবং কয়েকটি বই সাংবাদিকতার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে রচিত। ফলে পেশাগত কারণে এক ধরনের নৈকট্য অনুভব এবং একজন রিপোর্টারের অবস্থানে থেকে উপন্যাস রচনায় তার যে স্টাইল তা আকৃষ্ট করে।

বেড়ানোর সুযোগে কলকাতায় যাওয়া আসায় মনে মনে আগ্রহ তৈরি হয় লেখক-সাংবাদিক নিমাই ভট্টাচার্যের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করার। কলকাতায় উনার বাড়ি হলেও কোথায়, কার মাধ্যমে দেখা করা যাবে সে ব্যাপারে অন্ধকারেই ছিলাম।

২০১৮ সালের জুলাই মাসে ব্যক্তিগত কাজে কলকাতা গিয়ে নিমাই ভট্টাচার্যের সাথে দেখা করার বিষয়টি মাথায় ঘুরতে থাকে। তার লেখা ‘বংশধর’ নামের উপন্যাসের ফ্ল্যাপে নাম-পরিচয়ের জায়গায় ছাপানো একটি মোবাইল নম্বর সে আগ্রহকে আরও উস্কে দেয়। কলকাতার এক নামী পত্রিকার একজন চিফ রিপোর্টার বড়ভাইকে নিমাই ভট্টাচার্যের বাড়ির ঠিকানা এবং অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে, তেমন তথ্য দিতে পারেননি। তবে বইয়ের ফ্ল্যাপে থাকা ওই মোবাইল নম্বরে ফোন করে সরাসরি যোগাযোগ করার পরামর্শ দিলেন তিনি।

সে উৎসাহেই সংকোচ কাটিয়ে সরাসরি একদিন ওই নম্বরে ফোন দিয়ে বসি। একবার মাত্র কল দিতেই ওপাশ থেকে হ্যালো বলতেই সম্ভ্রম নিয়েই জিজ্ঞেস করি, নিমাই ভট্টাচার্য আছেন কি না?’ ওপাশ থেকে ভরাট গলায় উত্তর এলো, ‘হ্যাঁ, আমিই নিমাই বলছি’। বাংলাদেশ থেকে এসেছি এবং তার লেখার একজন পাঠক হিসেবে পরিচয় দিয়ে সরাসরি দেখা করার প্রস্তাব দিয়ে বসি। কোনো দ্বিধা ছাড়াই তার কলকাতার টালিগঞ্জের মোর এভিনিউর বাসার পুরো ঠিকানা দিয়ে পরদিন বিকেলবেলাতেই যেতে বললেন।

পরদিন আমার স্ত্রীকে নিয়ে লেখকের দেয়া ঠিকানার ওপর ভর করে টালিগঞ্জের সে দোতলা ফ্ল্যাটটিতে পৌঁছে কলিং বেল টিপলাম। দরজা খুললেন লেখক নিজেই। প্রায় ছয় ফুট উচ্চতার, শুভ্রকেশ নিমাই ভট্টাচার্য দরজা খুলেই জিজ্ঞেস করলেন, আমি বাংলাদেশ থেকে আসা সাংবাদিক কি না। এত বড় একজন লেখক প্রথম দেখাতেই তার সহজ ব্যবহার আকৃষ্ট করে।

সাধারণ একটি গেঞ্জি পরিহিত লেখকের দিকে তাকালেই সম্মানে মাথা নুইয়ে আসে। পরিচয় পর্বের শেষে ৮৭ বছর বয়েসী নিমাই জানতে চাইলেন, কেন তার সাথে দেখা করতে এসেছি? ওই সময়ের তিন বছর আগে পক্ষাগাতগ্রস্ত হওয়ার পর থেকে তিনি আর লিখতে পারেন না।

প্রায় দেড়শ’র বেশি বইয়ের এ লেখকের সাথে আর তেমন কেউ দেখা করতে আসেন না বলে জানালেন। চা-বিস্কুটে আপ্যায়ণ করে জানতে চাইলেন, বাংলাদেশ ও সেখানকার মানুষের কথা। দেশভাগের পূর্বে এই পূর্ব বাংলাতেই জন্মেছিলেন তিনি সেকথা জানাতেও ভুললেন না। দেশ স্বাধীনের পর এক সফরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথেও দেখা করে নিজের লেখা চারটি বই উপহার দেয়ার কথাও জানান আলাপচারিতায়। বাংলাদেশে তার বইয়ের অনেক পাঠক রয়েছে সেকথা তিনি জানেন এবং তাকে মনে রাখার জন্য ধন্যবাদও জানান পাঠকদের।

কথায় কথায় বললেন, ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত টানা বিভিন্ন কাগজে রিপোর্টিং করেছেন। রিপোর্টিং ছাড়ার পর পুরোপুরি লেখায় মনোনিবেশ করেন। বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন দিল্লিতে। একজন পুরোদস্তুর রিপোর্টার হওয়া সত্ত্বেও এত সহজ গদ্যে কিভাবে একের পর এক বই কিভাবে লিখে গেছেন তা জানার আগ্রহ ছিল খুব বেশি। সে প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, রিপোর্ট যেভাবে লিখতাম, সেভাবেই উপন্যাসগুলো লেখা হয়ে গেছে। বিশেষ কোনো উপলক্ষ নিয়ে এসব লেখা হয়নি- তিনি বলেছিলেন।

এপার এবং ওপার বাংলা মিলিয়ে তার সবচেয়ে বেশি পঠিত ও বিক্রিত উপন্যাস হল ‘মেমসাহেব’। এটি নিয়ে সিনেমাও হয়েছে কলকাতায়, যেটিতে অভিনয় করেছিলেন উত্তম কুমার ও অপর্না সেন। ২০১৮ সালে সে উপন্যাস প্রকাশের ৫০ বছর ছিল। কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করি, এটি তার জীবনের সাথে সম্পর্কিত কি না এবং কিভাবে এতসময় পরেও একটি উপন্যাস সমান জনপ্রিয় হয়ে আছে। স্মিত হেসে বলেছিলেন, অন্যান্য উপন্যাস যেমন মেমসাহেবও তেমনি, বাস্তবের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এটি যখন লিখি তখন আমার বয়েস ৩৫ বছর এবং পুরোদস্তুর রিপোর্টার। দিল্লিতে রিপোর্টিং করতে গিয়ে কাজের ফাঁকে ফাঁকেই ‘মেমসাহেব’ লিখেছিলাম।

লেখকদের রচনায় জীবনের অনেক ছাপ পড়ে, মেমসাহেবের বেলায় তা ঘটেছিল কি না আবারও জিজ্ঞেস করায় তিনি পুনরায় শুকনো হাসি দিয়ে বলেছিলেন, আমি আবারও বলব এটা কাল্পনিক, এর সাথে আমার জীবনের কোনকিছু মেলানো ঠিক হবে না, পাঠক যা ভাবার তারা সেভাবেই ভেবে নিক। এতে আমার কিছু বলার নেই।

তবে লেখক নিমাই ভট্টচার্য সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় বললেও ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি। একদম ভরাট কণ্ঠেই ব্যক্তিগত বিষয়ে আলাপে অপারগতা জানিয়ে দেন। শেষ বয়সে এসে পারিবারিক কোনো সম্পর্কের জায়গায় তার কোনো খেদ ছিল কি না তা বোঝা যায়নি।

প্রায় দেড়শ’র অধিক বইয়ের রচয়িতা নিমাই ভট্টাচার্য সাথে তার বাসায় সেদিন বেশ ভালো সময় কাটিয়েছি। পক্ষাঘাতে শরীরে একটা পাশ অবশ থাকলেও অন্যদেশ থেকে আসা নিজের একজন পাঠককে সময় দিতে তিনি সামান্যতম কুণ্ঠাবোধ করেননি এবং আলাপচারিতায় ছিলেন পূর্ণ আন্তরিক। একজন বিখ্যাত লেখক হলেও কোনো ধরনের অহংবোধ বা আন্তারিকতার কমতি ছিল না তার ব্যবহারে।

তার গুণমুগ্ধ পাঠক হিসেবে একরকম ঘোর নিয়েই প্রিয় সাংবাদিক-কথাসাহিত্যিকের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কোন ফাঁকে সেদিন সময় পার হয়ে গিয়েছিল বুঝতেই পারিনি। কতকিছুই যে জিজ্ঞেস করার ছিল, কিন্তু করা হয়নি। তাকে দেখেই একপ্রকার মনপ্রাণ জুড়িয়ে গিয়েছিল।

‘মেমসাহেব’-এর স্রষ্টা নিমাই ভট্টাচার্য প্রয়াত হয়েছেন বৃহস্পতিবার কলকাতার টালিগঞ্জের বাড়িতে ৮৯ বছর বয়সে। পরিণত বয়সেই তার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু একজন লেখক হিসেবে তিনি বাঙালি পাঠক মহলে আজীবন বেঁচে থাকবেন।

ছবি- লেখক

সূত্র : বিডিনিউজ

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে