বাংলার বারুদ
আদনান সৈয়দ : গোলা বারুদ নির্মাণের অন্যতম উপাদান হলো সল্টপিটার; বাংলায় যাকে বলে শোরা। ভাবতে পারেন বাংলায় উৎপাদিত বারুদ একসময় ছিল পৃথিবীর বিখ্যাত?
J.W Lether ‘The Indian Saltpetre Industry, Agricultural Research Institute’ গ্রন্থটির মাধ্যমে জানা যায়, ভারতের বাংলা বিহার অঞ্চল ছিল বারুদ উৎপাদনের সবচেয়ে ভালো এবং নির্ভরযোগ্য এলাকা। ভারত তো বটেই গোটা পৃথিবীতেই ছিল বাংলার বারুদের বিশেষ চাহিদা। বারুদের উপাদান সল্টপিটার বা শোরার রাসায়নিক নাম পটাশিয়াম নাইট্রেট (KNO3)। দেখতে সাদা হওয়ার কারণে আরবরা একে বলত চীনের তুষার। যুদ্ধক্ষেত্রে কামানের গোলার ৬০-৭৫% হলো শোরা।
নাইট্রেট নাম শুনেই বুঝতে পারা যায় এখানে নাইট্রোজেনের একটি ভুমিকা রয়েছে। পটাশিয়াম নাইট্রেটের সঙ্গে উপযুক্ত পরিমাণে কাঠ-কয়লা আর গন্ধক মিশালে তৈরি হয়ে যাবে বারুদ। এই বারুদই শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করার অন্যতম কাঁচামাল। বারুদের মান উন্নত হলে যুদ্ধে জেতার সম্ভাবনাও বেশি থাকত। ইতিহাসের পাতা ঘুরে দেখা গেছে শুধুমাত্র উৎকৃষ্টমানের বারুদের অভাবে অনেক পরাক্রমশালী রাজাও যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন। আনন্দের খবর হলো, বাংলা এবং বিহারে উৎপাদিত বারুদের মান ছিল গোটা পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ এবং এ কারণে এর চাহিদা ছিল অন্য যেকোনো এলাকার বারুদের চেয়ে অনেক বেশি।
ভাবুন, আজ থেকে প্রায় পাঁচ শত বছর আগে ১৫৫৮ সাল থেকে শুরু করে ১৮৮০ পর্যন্ত ভারতে বিপুল পরিমাণে বারুদ উৎপাদন শুরু হয়েছিল। প্রথম প্রথম এই বারুদের একচেটিয়া ব্যবসা করেছে ফরাসি আর ডাচ বণিক শ্রেণি। তখনো বৃটিশরা এই বাণিজ্যে প্রবেশ করেনি। তারা তখন অন্য ব্যবসাপাতি গোছাতেই বেশি ব্যস্ত। যদিও ওই সময়েই ভারতে বারুদ উৎপাদন একটা লাভজনক ব্যাবসায় পরিণত হয়েছে। এবং ইউরোপই ভারতীয় বারুদের বড় বাজার। কারণ, ইউরোপে তখন বিভিন্ন দেশের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ চলছে। সেখানে যুদ্ধরত পক্ষগুলোর কাছে বারুদের চাহিদা আকাশচুম্বি।
লেখক James W. Frey এর ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘The Indian Saltpeter Trade, The Military Revolution, and The Rise of Britain as a Global Superpower’ উল্লেখ করেছেন, “১৬০১ সাল থেকে ১৮০১ সাল পর্যন্ত ভারত থেকে ইউরোপে প্রচুর পরিমাণে ভারতীয় পণ্য বোঝাই করে ইউরোপের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বন্দর, যেমন আমস্টার্ডাম, লন্ডন, কোপেনহ্যাগেন,লিসবন, স্টকহোমের উদ্দেশ্যে জাহাজ রওনা দিত। প্রতিটা জাহাজ গড়ে ১ হাজার টন ভারতীয় পণ্য ইউরোপে বহন করে নিয়ে যেত, যার ১৬% থাকত সল্টপিটার বা বারুদ।”
অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ-বিগ্রহে বারুদের চাহিদা মেটানোর পরও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বারুদ রপ্তানী করে ভারত তখন বেশ সুনাম অর্জন করেছে। আর ভারতে উৎপাদিত এই বারুদের ভেতর বাংলায় উৎপাদিত বারুদ তখন উৎকৃষ্টমানের জন্য জগৎবিখ্যাত। তাই ব্রিটিশরা যখন ভারতে উপনিবেশ স্থাপনে সফল হলো, তখন প্রথমেই তারা বারুদ ব্যবসা পুরো নিজেদের কব্জায় নিয়ে নিল।
ইংরেজরা এটা করার পেছনে বড় কারণ ছিল ফরাসিদের সঙ্গে ব্রিটেনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এ যুদ্ধ চলেছিল ১৭৫৬ সাল থেকে ১৭৬৩ পর্যন্ত। জানা যায়, এই যুদ্ধে ব্রিটেনের মোট বারুদ লেগেছিল ১৬০০ টন। আর এর পুরোটাই জোগান দিয়েছিল বাংলা। আগেই বলেছি, ভারত ছিল গোটা পৃথিবীর পয়লা সারির বারুদ উৎপাদনকারী দেশ। ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডেও বারুদ উৎপাদন হতো, তবে ভারতের মতো এত ব্যাপক হারে নয়। আরও পরে বাংলার বারুদের ওপর চোখ পড়েছিল আমেরিকারও।
তখন সবেমাত্র ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে তারা। ফরাসিরা গোপনে আমেরিকায় ব্রিটিশবিরোধী শক্তিকে চাঙ্গা করতে বাংলা থেকে বারুদের যোগান দিয়েছিল এবং ব্রিটিশদের থেকে আমেরিকার স্বাধীনতা পাওয়া ত্বরান্বিত করেছিল। এবং এরসঙ্গে এ তথ্যটিও রোগ করা যায়, শুধু আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে নয়, ১৮৬১ সাল থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত সংঘঠিত আমেরিকা গৃহযুদ্ধেও বাংলার এই বারুদ বেশ সুনামের সঙ্গেই ব্যবহৃত হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, বাংলায় কীভাবে বারুদ উৎপাদন শুরু হয়েছিল? কোথা থেকে এ বারুদ সংগৃহীত হলো। জানা যায়, বারুদ উৎপাদনের জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান ছিল বাংলা এবং বিহার। পাটনার একটি হতদরিদ্র শ্রেণির নাম নুনিয়া (সম্ভবত নুন থেকে নুনিয়া)। নুনিয়ারা ছিল নিম্নবর্গের হিন্দু। নুনিয়াদের পৈত্রিক পেশা ছিল বারুদ তৈরি করা। পরিবারের সব সদস্যরাই এই কাজে ব্যস্ত থাকত। বিভিন্নভাবে তারা এই বারুদ তৈরি করত। বর্ষার পর পানি যখন শুকিয়ে যেত, তখন সেই মাটির ভেতর দীর্ঘদিন পানি চুইয়ে চুইয়ে এক ধরনের সাদা স্তর জমত। আমাদের গ্রামবাংলায় রাস্তায় বা পাহাড়ের ঢালে এখনো এই সাদা স্তর লক্ষ্য করলেই দেখা যায়।
নুনিয়ারা এই ছয়-সাত ইঞ্চি গভীর শোরা ভর্তি মাটি কেটে নিয়ে তা পানিতে জ্বাল দিত, এবং জ্বাল দিতে দিতে মাটি খাটি সাদা পাউডারে পরিণত হতো। এই সাদা পাউডারটিই মূলত পটাশিয়াম নাইট্রেট, যা বারুদ উৎপাদনের অন্যতম কাঁচামাল। জানা যায়, নুনিয়ারা প্রতি বছর অক্টোবর থেকে জুন- এই নয় মাস টানা কাজ করে ছয় শ থেকে বার শ কেজি বারুদ তৈরি করতে পারত। নয় মাসের রোজগারেই তাদের চলতে হতো পুরো বছর।
নুনিয়ারা গ্রাম-গঞ্জ জঙ্গল-পাহাড় ঘুরে ঘুরে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন পটাসিয়াম নাইট্রেটযুক্ত মাটি সংগ্রহ করত বছরের ওই সময়।
কীভাবে মাটিতে নোংরা উৎপন্ন হতো? দীর্ঘদিনের পরিত্যক্ত কোনো শৌচগার, জলাশয়, গরু মহিষের খোয়ার অথবা ঘোড়ার আস্তাবলে দীর্ঘদিন ধরে মাটিতে প্রাণীর মলমুত্র মিশতে মিশতে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হতো পটাশিয়াম নাইট্রেট। নুনিয়ারা সেগুলো দলবেঁধে সংগ্রহ করত। তাছাড়া পাহাড়, বন জঙ্গল, গুহা- এসব জায়গা থেকেও বারুদ তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করত। পাহাড়ের গুহা থেকে সল্টপিটারযুক্ত মাটি সংগ্রহ ছিল নুনিয়াদের আরেকটি উৎস। গুহার দেয়ালে জমে থাকত সাদা ব্যাকটেরিয়ার গভীর স্তর। দুই-তিন ইঞ্চি পুরু এই সাদা অংশটুকু মাটিশুদ্ধই তারা সংগ্রহ করে নিত। তারপর সেই একই প্রক্রিয়া। জ্বাল দিয়ে তৈরি হতো সল্টপিটার বা শোরা। আর তা-ই বারুদ।
লেখক Kumkum Chatterjee তার গ্রন্থ ‘Merchants, politics and society in all modern India Bihar 1733-1820′-এ উল্লেখ করেছেন, “১৭৩৩-১৭৫৭ অষ্টাদশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে বাংলা এবং বিহারে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর বারুদ রপ্তানির প্রতিযোগিতা তুঙ্গে ছিল। সেই প্রতিযোগিতা এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, বারুদ উৎপাদনের বহু আগেই নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আগাম বা দাদন দিয়ে রাখা হতো। বলাই বাহুল্য, এই অর্থ আসলে হতদরিদ্র নুনিয়ারা পেত না। এই টাকা নানা ব্যবসায়ীর হাত হয়ে পেত মধ্যস্বত্বভোগীরা। ইউরোপীয় বণিকরা আগাম অর্থ শোধ করে নানাভাবে স্থানীয় বারুদ ব্যাবসায়ীদের ওপর উৎপাদনের জন্যে চাপ দিতে থাকত। এই চাপ শেষ পর্যন্ত পড়ত গিয়ে হতভাগ্য নুনিয়াদের ওপর। ইউরোপে ব্যাপক চাহিদার কারণে পাটনার শোরা ব্যাবসায়ীরাও ইংরেজদের সঙ্গে ভালো একটি সম্পর্ক বজায় রাখত।” তাদের চটাতে চাইত না।
অন্যদিকে, পাটনায় বারুদ ব্যবসা রমরমা হওয়া সত্বেও সেখানে পরিবহণ ব্যবস্থা ভালো ছিল না। তারপরও ইউরোপিয়ান কোম্পানির প্রতিনিধিরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাজির হয়ে যেত, তাদের উদ্দেশ্য ছিল কম পয়সায় সরাসরি নুনিয়াদের কাছ থেকে বারুদ কিনে তা চড়া দামে ইউরোপীয় বাজারে বিক্রি করা।
আমীরচাঁদ এবং দীপচাঁদ- তারা দুজনই ছিলেন বাংলার অন্যতম বারুদ ব্যাবসায়ী। ১৭৪৭ সালে ভারতে ইংরেজ বণিকদের সঙ্গে রাজনৈতিক গোলযোগের কারণে বাংলায় বারুদ ব্যবসায় খানিকটা ছেদ পড়ে। এই সুযোগে তখন ইউরোপীয় অন্য বণিকরা বাংলার স্থানীয় বারুদ ব্যাবসায়ীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা চালায়। এবং এই সুসম্পর্ক তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমে তারা বারুদ ব্যবসায়ীদের কাছে আগাম অর্থ লগ্নী করতে শুরু করে।
এ সময়ে বিদেশি বণিকরা যে দামে পাটনা বা বাংলা থেকে বারুদ কিনত, তার একটি তালিকা খুঁজে পাওয়া যায়:
১৭৩৭ সাল এলি টাকা ২.১৪
১৭৩৮ সাল এলি টাকা ৩.৪
১৭৩৯ সাল এলি টাকা ৩.৮
১৭৪০ সাল এলি টাকা ৩.৮
১৭৪১ সাল এলি টাকা ৩.৮
*এলি টাকা পাটনার টাকায় স্থানীয় হিসাব।(সূত্র: কুমকুম চ্যাটার্জি,’ Merchants, politics and society in all modern India Bihar 1733-1820)
১৭৪৭ সালের দিকে অভিযোগ ওঠে, কলকাতার বারুদ ব্যবসায়ী চাঁদ পরিবার আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশে ইংরেজ বণিকদের ঠকিয়েছে এবং এই ঝামেলা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। কলকাতা আদালতে দীপচাঁদ পরিবার এবং ইংরেজদের মধ্যে একটি আইনি লড়াই শুরু হলো। শেষে উপায়ন্তর না দেখে কৌশলে দীপচাঁদ পরিবার পাটনায় স্থানান্তরিত হয়ে, দ্রুততম সময়ে বারুদ ব্যবসায় একচেটিয়া প্রাধান্য গড়ে তুললেন।
ইউরোপিয়দের সঙ্গে বাংলার বারুদ ব্যবসায়ীদের সাধারণত বিস্তৃত চুক্তি সম্পাদন হতো। মূলত দেশীয় ব্যাবসায়ীরা কৌশলে বারুদের দাম বাড়ানোর জন্যে ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে একটি কৃত্রিম প্রতিযোগিতা তৈরি করে দিত। তবে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বারুদের একটি নির্দিষ্ট মূল্য আগের থেকেই নির্ধারণ করে রাখত। ব্যাবসা যেহেতু হতো ইউরোপীয়দের সঙ্গে, তাই মূল্য নির্ধারণেও অনেক সময় তাদের ছাড় দিতে হতো বৈকি! ১৭৪৪ সালে ফরাসিরা এ চুক্তি ছেড়ে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দেয়, কারণ তারা তাদের জন্য মাত্র ১৬ শতাংশ বারুদ বরাদ্দে খুশি ছিল না। তাদের চাহিদা আরও অনেক বেশি ছিল। ফরাসিরা এ চুক্তি থেকে বের হয়ে গেলে চতুর ব্রিটিশরা ডাচদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাজার দখল করার চেষ্টা করল।
১৭৪৫ সালে জানুয়ারি মাসে পাটনার ডাচ কুঠির প্রধান ড্রাবি ঘোষণা দেন, তারা এ বছরের জন্যে ব্রিটিশদের কাছে বারুদ কেনার সম্পাদিত চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসছে। কিন্তু আদতে দেখা গেল, সেটিও ছিল ব্রিটিশদের সঙ্গে আঁতাতের একটি সূক্ষ্ম চালমাত্র। দেখা গেল, মার্চ মাসেই ড্রাবি ব্যক্তিগতভাবে গোপনে, ব্রিটিশদের শোরা সরবরাহ করতে শুরু করে দিয়েছেন। ফলে ফরাসিরা বাংলায় পুরোই বারুদ একঘরে হয়ে গেল।
আর ওই একই সময়ে সুযোগ বুঝে পাটনার বারুদ ব্যবসায়ী চাঁদ ভাইযুগল ছোটখাটো অসমিয়া বারুদ বণিকদেরকে হাত করে সস্তায় বারুদ কিনে বেশি দামে ইউরোপীয়দের কাছে বিক্রি করে বিপুল মুনাফা ঘরে তুললেন।
বারুদ ব্যবসায় নবাবদেরও অংশগ্রহণ ছিল। সপ্তদশ শতকের তিন এবং চার দশকে পাটনার বারুদ ব্যবসা রাজদরবারে থেকে অন্দরমহলে পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। নবাব আলিবর্দি খাঁর রাজত্বে (১৭২৬-১৭৪০) তার জামাতা এবং ভাইপো জৈনুদ্দিন আহমেদ খান (১৭৪০-৪৮) এবং দেওয়ান কিরিটচাঁদেরও বারুদ ব্যাবসা ছিল। ইউরোপীয় বণিকদের সঙ্গ দরকষাকষির কাজটি স্থানীয়দের পক্ষ থেকে তারাই করতেন। এছাড়া আলিবর্দি খাঁর ভাই হাজি আহমেদ ১৭৪৭ সালে আফগান বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ আর পাটনার ব্যবসায়ীদের দরবারের সঙ্গে বারুদ ব্যবসার অন্যতম মাধ্যম ছিলেন।
১৭৯০ থেকে ১৮১০ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরাজের অন্যতম ভয় ছিল ফরাসিদের নিয়ে। কারণ, ভারত মহাসাগরের কিছু দ্বীপ ফরাসিদের দখলে থাকায়, প্রায়ই সল্টপিটার বোঝাই ব্রিটিশ জাহাজ আক্রান্ত হতো। তখন স্পেন যুদ্ধ (১৮০৮-১৮০৯) চলছিল। ফরাসিরা ইংরেজদের কাছে থেকে বিপুল পরিমাণ বারুদ ছিনতাই করে স্পেনের যুদ্ধে সরবরাহ করত। ওই সময়ে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর অন্যতম কাজ ছিল তাদের বারুদ বোঝাই জাহাজগুলো ফরাসিদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা।
ফরাসি বিপ্লবের পর অনেকে আমেরিকায় এসে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ধনী বারুদ ব্যবসায়ী। তিনি তার এক রোজনামচায় লিখছেন, “আমেরিকার ভেতর দুটি অথবা তিনটি বারুদ বানানোর কারখানা আছে। কিন্তু সেগুলোর মান খুব খারাপ। যে কারণে আমেরিকার একমাত্র লক্ষ্য হলো ভারত থেকে উন্নতমানের বারুদ আমদানি করা। কারণ ভারতের বারুদ ফ্রান্সের বারুদের চেয়ে গুণগত মানের দিক থেকে অনেক ভালো।”
সেই প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন দেশে বারুদের কাঁচামাল হিসেবে সল্টপিটারের ব্যাবহার চালু ছিল। কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্রেও বারুদের উল্লেখ পাওয়া যায়। দেখা যায় ৩০০ খৃষ্টপুর্বেও ভারতে দেশিয়ভাবে বারুদ উৎপাদন হয়েছিল। কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্রে আরও উল্লেখ আছে যে, উৎপাদিত এই পটাশিয়াম নাইট্রেট ব্যবহার করে তৎকালীন রাজা-বাদশারা বিষাক্ত ধূম তৈরি করে শত্রপক্ষকে পরাস্থ করতেন।
১২৭০ সালে সিরিয়ার রাসায়নবিদ ও গণিতবিদ হাসান আল রাম্মাহ তার ‘ফুরসিয়া ওয়া আল মানাসিব আল হারবিয়া’ (The book of Military Horsemanship and ingenious Devices) গ্রন্থে সর্বপ্রথম বারুদের উল্লেখ করেন। গ্রন্থে লেখক সেটির উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কেও কিছু সূত্র তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, কীভাবে সংগৃহীত পটাশিয়াম নাইট্রেটভুক্ত মাটিকে পানিতে জ্বাল দিতে দিতে সেখান থেকে বারুদ বানানোর উপযোগী পাউডার পাওয়া যায়।
১৮৪৫ সালে চিলিতেও সল্টপিটার তৈরি হতো। সেটির নাম ছিল চিলিয়ান সল্টপিটার। তৎকালীন সময়ে চিলি এবং ক্যালিফোর্নিয়াতে সংগঠিত বিভিন্ন যুদ্ধে চিলিয়ান সল্টপিটার ব্যবহৃত হয়েছিল।
লেকনতে নামে এক ফরাসি বারুদ বিশারদ ১৮৬২ এক অভিনব উপায়ে বারুদ উৎপাদনের কাঁচামাল আবিষ্কার করেছিলেন। তার আবিষ্কৃত বারুদ আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময়ে রপ্তানি হয়েছিল। তিনি ফ্রান্সের গ্রাম-গঞ্জে সাধারণ কৃষকদেরকে সংগঠিত করে সেখানকার গোয়ালঘর এবং ঘোড়ার আস্তাবলে জমে থাকা বর্জ্যপদার্থ থেকে অভিনব উপায়ে পটাশিয়াম নাইট্রেট উৎপাদন শুরু করেছিলেন। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ‘ফরাসি পদ্ধতি’। পরবর্তীকালে ফরাসি বিপ্লবের কিছুদিন আগে তুরগট এবং লাভোসিয়ের- এই দুই ফরাসি ‘the Régie des Poudres et Salpêtre’ নাম দিয়ে ব্যাপক সল্টপিটার উৎপাদন শুরু করেন। প্রক্রিয়াটি ছিল মোটামুটি একইরকম। তবে পার্থক্যটা ছিল একটু ভিন্ন। তারা কাঠের গুড়া, মাটি, খড় জড়ো করে চার ফুট উচ্চতায় এবং ৬ ফুট প্রশস্ততায় মোটা মোটা বস্তা বানিয়ে সেটি গরু বা ঘোড়ার মুত্রের সান্নিধ্যে বছর খানেক রেখে দিতেন। তারপর সেখান থেকে ধীরে ধীরে ক্যালসিয়াম নাইট্রেট চলে যেত এবং জন্ম নিত পটাশিয়াম নাইট্রেট। বারুদ তৈরিতে যা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্ল্যাক পাউডার তৈরিতে পটাশিয়াম নাইট্রেটের ব্যাবহার বেড়ে যায়। পরবর্তীকালে আমরা দেখতে পাই, শিল্প উৎপাদনেও এর ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে মাটিতে সার তৈরিতেও এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নাইট্রিক এসিড থেকে বারুদ তৈরির প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে সল্টপিটারের জায়গা নিয়ে নেয়। গোলায় শোরার ব্যবহার পুরো বন্ধ হয়ে যায়।
শুধুমাত্র বাংলা আর বিহার থেকেই প্রতি বৎসর কুড়ি হাজার টন বারুদ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানী হতো। এর পেছনে সবচেয়ে বড় শক্তিশালী যোগানদার ছিল হতভাগ্য নুনিয়া সমাজ। বলার অপেক্ষা রাখে না, ইউরোপীয় বেনিয়ার দল এবং স্থানীয় ভারতীয় বণিকরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই বারুদ রপ্তানি করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হলেও হতভাগ্য নুনিয়ারা আজীবন দরিদ্রই রয়ে যায়।
সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড