উত্তীর্ণ এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ট্রল না করে, আসুন পাশে থাকি

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২, ২০২১; সময়: ৬:৪৪ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
উত্তীর্ণ এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ট্রল না করে, আসুন পাশে থাকি

শাহানা হুদা রঞ্জনা : সুলতানাকে আমরা খুব ভালো ছাত্রী হিসেবেই চিনি। ম্যাট্রিকে গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে পাস করেছিল। ও আগাগোড়াই ভালো রেজাল্ট করেছে। সেই সুলতানা এবারও এইচএসসি পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। কিন্তু শুনলাম, এই রেজাল্ট পেয়ে সুলতানা দিনভর শুধু কেঁদে চলেছে এবং খুব বিষণ্নবোধ করছে।

এর পেছনে কারণ মূলত দুটি। সুলতানার চেয়ে যারা ক্লাসে খারাপ ছাত্রী ছিল, তাদের মধ্যেও ৩-৪ জন গোল্ডেন জিপিএ পেয়েছে। ফলে সুলতানা ভাবছে, এই ফলাফলে সত্যিকার প্রতিযোগিতা থাকল না।

এরপর সে দেখেছে, ফেসবুকে এ বছরের পাসের হার ও ভালো রেজাল্ট করা নিয়ে ইতোমধ্যেই ট্রল শুরু হয়ে গেছে। অনেকেই হাসাহাসি করছে, আজেবাজে মন্তব্য করছে এবং ‘অটোপাস, অটোপাস’ বলে বাজে ইঙ্গিত করছে। তাতে সুলতানার মতো সত্যিকারের একজন ভালো ছাত্রী খুবই কষ্ট পাচ্ছে।

সুলতানার পরিবারের সদস্যরা জানালেন, সুলতানাসহ ওর বন্ধুরা এবং বন্ধুদের পরিবারগুলো অন্যসব অভিভাবকের মতো করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে সময় কাটিয়েছে। সুলতানার মা জানালেন, ‘পড়াশোনায় মনোসংযোগ করতে না পারা, ক্লাস করতে না পারা, টিচারদের সাহায্য না পাওয়া, করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়ার ভয়, বিভিন্ন কারণে পরিবারের মানুষদের হতাশা, আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যু সুলতানাকে খুবই ভাবিয়ে তুলেছিল। ও খুব বিষণ্ন থাকত।’

তিনি আরও বললেন, ‘যাক, এরপর পরীক্ষা ছাড়াই যখন মূল্যায়নের ভিত্তিতে ফলাফল দেওয়া হলো, তখন ও খুশিই হয়েছিল। কিন্তু এই রেজাল্ট নিয়ে হাসাহাসি হতে দেখে আমার মেয়েটা আবার বিষণ্ন হয়ে পড়ল।’

এ কথা খুব সত্যি, যারা ভালো ছাত্রছাত্রী, যারা পড়াশোনা করতে চায়, তারা সবসময় প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে পাস করতে চায়। এরা কেউই মুফতে পাস করতে চায় না। খুব ফাঁকিবাজ ছাত্রছাত্রীরাই কেবল এমনটা চাইতে পারে।

করোনাকালে সব স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। ছেলেমেয়েরা কোথাও গিয়ে পড়াশোনা করার জন্য সাহায্য নিতে পারেনি। গ্রামে-গঞ্জে অনেক পরিবার আছে, যেখানে বাবা-মা পড়াশোনা শেখানোর মতো শিক্ষিত নন। এমনকি কোনো কোনো অভিভাবক নিরক্ষরও। সেক্ষেত্রে পড়াশোনা ছাড়া এইচএসসি পরীক্ষা হলে বিপদে পড়তে হতো অগনিত ছাত্রছাত্রীকে।

খুব ট্রমার মধ্যে দিয়ে শিশু-কিশোর, তরুণরা এই সময়টা পার করেছে এবং এখনো করছে। ভয়াবহ দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় মানুষ যখন দিশেহারা, তখন টেবিলে বসে একমনে পড়াশোনা করা স্বাভাবিকভাবেই কঠিন কাজ ছিল। কবে, কীভাবে পরীক্ষা হবে, কী সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া হবে, এসব কিচ্ছু না জেনে, মন শক্ত করে পরীক্ষা দেওয়াটা ছাত্রছাত্রীদের জন্য খুব কঠিন কাজ হতো।

তাই সরকার অগনিত ছাত্রছাত্রীকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এই পাস করিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাজেই এই রেজাল্ট নিয়ে আমরা যারা হাসি-তামাশা করছি, সামাজিক মাধ্যমে আজেবাজে মন্তব্য করছি, ‘অটোপাস-অটোপাস’ বলে ছি-ছি করছি, তারা খুব অবিবেচকের মতো কাজ করছি। আসলে আমরা রীতিমতো অন্যায় করছি।

অনেকেই ‘অটোপাস’ বলে এইচএসসি ও সমমান উত্তীর্ণ ছেলেমেয়েদের হেয় করার চেষ্টা করছেন। আসলে ওদের তো কিছু করার ছিল না। এই পদ্ধতিতে ফল প্রকাশ করা ছাড়া ভালো বিকল্প কেউ দিতে পেরেছেন বলেও মনে হয় না। আমরা সবাই বলেছি, করোনাকালে পড়াশোনা না হলে, না হবে। এক বছর পরীক্ষা না হলে, পড়াশোনা না শিখলে জীবনে কিচ্ছু এসে-যায় না। জীবন রক্ষা করাটা বেশি জরুরি; ক্লাস করা ও পরীক্ষা দেওয়াটা নয়।

এর আগে, মুক্তিযুদ্ধের পর সব ছাত্রছাত্রীকে পরীক্ষা ছাড়াই ওপরের ক্লাসে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কারণ, ওই সময়ে পড়াশোনা করার ও পরীক্ষা নেওয়ার কোনো উপায় ছিল না। করোনাকালেও ঠিক তা-ই হয়েছে। এটাও এক ধরনের আপদকালীন পরিস্থিতি। ১৯৭১ সালে যারা অটোপ্রমোশন পেয়েছিলেন, তাদের জীবন কি থেমে গিয়েছিল? নাকি তারা সবাই ব্যর্থ হয়েছেন? মানুষের জীবনকালে এক বছর বা দুই বছর পড়াশোনাটা করতে না পারা খুব বড় কোনো বিষয় নয়।

শুধু বাংলাদেশই নয়, করোনা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশ নিজেদের মতো করে বিকল্প ব্যবস্থায় পরীক্ষা নিচ্ছে, ফল প্রকাশ করছে। বিশ্বব্যাপী ও-লেভেল, এ-লেভেল পরীক্ষার্থীরাও এ রকমই একটা অ্যাসেসমেন্ট টেস্টের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। যারা ভাবছেন, এইসব ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া ছাড়াই পাস করেছে, বিষয়টি মোটেও তা নয়। দেড় বছর পড়াশোনা করে পরীক্ষায় বসার আগে তারা এই মহামারির কবলে পড়েছে। ওরা পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিতে না পারায় আগের দুটি পাবলিক পরীক্ষার ভিত্তিতে ওদের রেজাল্ট দেওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতির জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না।

আমরা দেখছি, এইচএসসিতে পরীক্ষা ছাড়া পাস করানো নিয়ে অনেকেই বিভিন্ন নেতিবাচক মন্তব্য করছেন সামাজিক মাধ্যমে। শুধু যে এই রেজাল্ট নিয়ে আমরা ট্রল করছি, তা কিন্তু নয়। জীবনের অনেক কষ্টকর, গ্লানিময় ঘটনা নিয়েও এক শ্রেণির মানুষ ট্রল করতে ছাড়ে না। ইন্টারনেট আমাদের জীবনে অনেক অসাধারণ জিনিস যোগ করেছে- এটা যেমন সত্য, সেইসঙ্গে এটাও সত্য যে, অনেক অপ্রীতিকর অবস্থার মুখোমুখিও দাঁড় করিয়েছে। এরই একটি হচ্ছে ট্রল এবং সাইবার বুলিং।

ট্রল বলতে আমরা চিনি শিশুদের রুপকথার সেই দুষ্ট দেঁতো দৈত্যকে, যে ব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে ছোট ছোট ছাগলছানাদের ভয় দেখায় আর গিলে খাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের ট্রল কম্পিউটার, ফোন, মেইল, ম্যাসেঞ্জার- এসবের পেছনে লুকিয়ে থেকে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে দেওয়ার চেষ্টা করে। এই ট্রল হচ্ছে সাইবার বুলিংয়ের একটি রূপ।

আমাদের বাস্তব জীবনে ট্রল হচ্ছে সেই মানুষগুলো, যারা সামাজিক মাধ্যমে আজেবাজে মন্তব্য করে অন্যকে খাটো করে এবং নিজেরা মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা করে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য থাকে মানুষকে বিষণ্ন বা অবসাদগ্রস্ত করে তোলা। এই যে যারা এখন এইচএসসি পাস করা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ট্রল করছে, ‘অটোপাস-অটোপাস’ বলে হেয় করার চেষ্টা করছে, তারা হচ্ছে সেই দুষ্ট দৈত্যের মতো। এরা এসব করে সময় কাটায়, মানুষকে ছোট করে আনন্দ কুড়ায়। এ এক ধরনের মানসিক বৈকল্য।

শুধু যে সামাজিক মাধ্যমেই ট্রল হয়, তা নয়। মানুষের চেহারা, আচরণ, অঙ্গভঙ্গি, যে কোনো ধরনের দুর্বলতা, ধর্ম, বর্ণ, সামাজিক মর্যাদা, পরাজয় নিয়েও ট্রল হয়। শিশুরাও ট্রল করে এবং তাদেরও ট্রলের শিকার হতে হয় স্কুলে ও খেলার মাঠে।আমি ব্যক্তিগতভাবে এ রকম দু’তিনটি বাচ্চাকে চিনি, যাদের ট্রলের শিকার হয়ে স্কুল বদলাতে হয়েছে।

এই যে আমাদের প্রাণপ্রিয় সাকিব আল হাসান বা বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম যখন খারাপ খেলে বা কোনো ভুল করে, তখন তাদের নিয়ে হাসি-তামাশার শেষ থাকে না। এমনকি সৌরভ গাঙ্গুলি যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেলেন, তখনো তিনি ট্রলের শিকার হয়েছেন। নামি-দামি মানুষ থেকে শুরু করে, সাধারণ মানুষের অবস্থা নিয়ে কিছু মানুষ নেতিবাচক প্রচারণা চালাতেই থাকে। যেমন, এখন চালাচ্ছে এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে।

আমাদের মতো সমাজে মেয়েদের অনেক বেশি ট্রলিং ও বুলিংয়ের মুখে পড়তে হয়। মেয়েদের ফিগার, চেহারা, পোশাক নিয়ে ঘরে-বাইরে, অনলাইনে এসব অশ্লীল ঠাট্টা, তামাশা চলতেই থাকে। কিছু নেতিবাচক ও ব্যর্থ মানুষ অন্যকে হেয় করে, বিষণ্ন করে আনন্দ লাভ করে। ট্রল ও বুলিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে অনেক।

অথচ যে বা যারা এই ট্রলের শিকার হয়, তাদের দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতার মাত্রা বেড়ে যায় এবং আত্মবিশ্বাস কমে যায়। মানসিক স্বাস্থ্য এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ভিকটিম আত্মহত্যাও করে ফেলতে পারে এবং করেও।

এভাবে ফল প্রকাশ না করে আমরা যদি আরও অপেক্ষা করতাম, তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক জট পাকিয়ে যেত। তাই সরকারের পক্ষে এই পদ্ধতি গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এভাবে ফল প্রকাশ করায় এমন কোনো বড় ক্ষতি হয়ে যায়নি বলেই আমরা মনে করি। বরং ছেলেমেয়েরা যেন সামনের দিনগুলোতে শক্ত মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে, সেজন্য তাদের পাশে থাকতে চাই।

আসুন সবাই তাদের অভিনন্দন জানাই। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, সময়টা মহামারিকাল, সুতরাং শিক্ষার্থীদের সাহস দিন যেন তাদের মনোবল ভেঙে না যায়। আজেবাজে মন্তব্য করে এদের ভিকটিমাইজ করাটা হচ্ছে খুব অমানবিক একটি কাজ।

১ ফেব্রুয়ারি ২০২১
লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

 

সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

  • 11
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে