সংসদ সদস্যরা যখন ‘ক্ষুদ্র কল্যাণ রাষ্ট্র’ হিসেবে কাজ করেন

প্রকাশিত: মার্চ ৯, ২০২১; সময়: ৯:০০ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
সংসদ সদস্যরা যখন ‘ক্ষুদ্র কল্যাণ রাষ্ট্র’ হিসেবে কাজ করেন

শাখাওয়াত লিটন : ভোটারদের খুশি রাখতে আমাদের সংসদ সদস্যরা তাদের সংসদীয় দায়িত্বের বাইরে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় যা করেন, তা সত্যিই অসাধারণ। স্পষ্টতই, যে কাজগুলো রাষ্ট্রের করার কথা তার অনেক কিছুই সংসদ সদস্যরা করছেন এবং এভাবেই তাদের নিজ নিজ এলাকায় ‘ক্ষুদ্র কল্যাণ রাষ্ট্র’ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন তারা।

এই কথাগুলো কি অপরিচিত মনে হচ্ছে?

তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য সংসদ সদস্যরা তাদের নির্বাচনী এলাকায়গুলোতে যে ‘কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড’ চালাচ্ছেন তার দিকে একটু নজর দেওয়া যাক।

সাংসদরা স্থানীয় স্কুল এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অনুদান দেন; তারা অভাবগ্রস্ত পরিবারগুলোকে চিকিত্সাসেবা কিংবা তাদের মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার জন্য আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকেন। এই আইনপ্রণেতারা তাদের এলাকায় শান্তি বজায় রাখতে স্থানীয় বিরোধ নিষ্পত্তি করেন। এই কার্যক্রমগুলোর জন্য প্রতি মাসে তারা বেশ ভাল পরিমাণে অর্থও ব্যয় করেন। তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা সম্ভবত নিজেদের বেতনের চেয়েও বেশি অর্থ সংসদীয় এলাকায় ব্যয় করে থাকেন।

রাষ্ট্রের আইন বিভাগের অংশ হওয়া সত্ত্বেও সাংসদরা স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখেন। তবে এই কাজটি করার কথা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের, যা সরকার হিসেবেই সমধিক পরিচিত।

এই পরিস্থিতিটি বেশ অদ্ভূত। সংসদ সদস্যরা তাদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় উপজেলা ও জেলা পরিষদের উপদেষ্টা। স্থানীয় সরকারের এই দুটি অঙ্গ যদি কোনো উন্নয়ন কর্মসূচির পরিকল্পনা করে, সেক্ষেত্রে স্থানীয় সাংসদের পরামর্শ নেওয়াটা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক।

সংসদ সদস্যদের সংসদীয় কাজ- আইন প্রণয়ন এবং সরকারি ব্যয়ের তদারকির বিষয়টিতে জনগণ খুব একটা মাথা ঘামান না। তবে স্থানীয় নানান বিষয়ে এমপিদের অংশগ্রহণের দিকটিতে তারা বেশ আগ্রহী। নতুন রাস্তা কিংবা সেতু নির্মাণের দাবিতে জনগণ এমপিদের সঙ্গে দেখা করতে পছন্দ করায়, রাজনীতিবিদরাও ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা অর্জনের এই সুযোগটির ব্যবহার করেন। ভোটারদের খুশি রাখতে এমপিরা উন্নয়নমূলক প্রকল্প সম্পাদনের জন্য সরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে তাগাদা দেন।

প্রচুর জনহিতকর কাজের মাধ্যমে, প্রত্যেক সংসদ সদস্য স্পষ্টতই তাদের নির্বাচনী এলাকায় একটি ‘ক্ষুদ্র কল্যাণ রাষ্ট্র’ হিসেবে কাজ করছেন। কিছু আফ্রিকান দেশে এমপিদের অনুরূপ কার্যক্রম পরিচালনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সম্প্রতি এ শব্দটি ব্যবহার করেছে দ্য ইকোনমিস্ট।

তারা বলেছে, “তবে সংসদ সদস্যরা আইনসভায় যা করেন তা কেবল কাজের অংশ। তাদের নির্বাচনী এলাকায় তারা দুর্বল রাষ্ট্রব্যবস্থার শূন্যস্থান পূরণ করেন; এবং এই অনানুষ্ঠানিক ভূমিকা আইন পাস করার চেয়েও ভোটারদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেন রাজনীতি এত ব্যয়বহুল তা ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করে এটি।”

বাংলাদেশেও রাজনীতি ব্যয়বহুল। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দলীয় টিকিট পাওয়া এবং এই দৌড়ে জিততে প্রচুর ব্যয় করতে হয় এখানে। এমনকি নির্বাচিত হওয়ার পরেও ভোটারদের খুশি রাখতে খরচ অব্যাহত রাখতে হয় এমপি এবং রাজনীতিবিদদের।

তবে আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোয় এমপিদের ‘ক্ষুদ্র কল্যাণ রাষ্ট্র’ হিসেবে কাজ করার কথা নয়। তাদের উচিত সংসদীয় কাজগুলিতে মনোনিবেশ করা যার মধ্যে রয়েছে- আইন তৈরি করা, আইন প্রয়োগের বিষয়টি পর্যালোচনা করা এবং সরকারের কার্যক্রম ও জনগণের অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা। সংক্ষেপে, তাদের কাজ হলো আইন করা এবং দেশে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য কাজ করা।

এমপিদের কোনোভাবেই স্থানীয় প্রশাসনিক কাজে যুক্ত থাকা উচিত নয়। এটা সরকারের কাজ যার জন্য সারাদেশে প্রশাসনিক নেটওয়ার্ক রয়েছে। প্রায় ৫ হাজার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে এ জন্য ৫০ হাজারেরও বেশি নির্বাচিত প্রতিনিধি রয়েছেন।

স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সম্প্রসারিত অংশ। উন্নয়ন কর্মসূচি সম্পাদন এবং স্থানীয় জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব। জেলা প্রশাসক ও ইউএনও’র মতো সরকারের কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের তিন ডজনেরও বেশি বিভাগ কাজ করছে। তারা যে প্রশাসনকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তা হল কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের একটি বর্ধিত অংশ। আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আইন প্রয়োগ এবং বিভিন্ন কল্যাণ ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে নেওয়ার দায়িত্বও তাদের দেওয়া হয়েছে।

তবুও, স্থানীয় প্রশাসনিক কাজে এমপিদের জড়িত থাকা কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সহায়ক শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে মুদ্রার উল্টো পিঠ এক্ষেত্রে অনুজ্জ্বল কারণ স্থানীয় বিষয়গুলোতে এমপিদের সম্পৃক্ততা কেবল শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতাই প্রকাশ করে।

সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদকে সমবেতভাবে সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। সে কারণে সরকারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং সরকারকে তার কাজের জন্য জবাবদিহি করানোর মাধ্যমে প্রশাসনের উন্নয়নে বড় ভূমিকা নিতে হবে সংসদ সদস্যদের। সংবিধান এবং অন্যান্য আইন দ্বারা জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য তাদের কাজ করা প্রয়োজন। আইনের অপব্যবহার বা জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা লঙ্ঘনের জন্য যে কোনও সরকারি সংস্থাকে জবাবদিহি করার ক্ষমতা তাদের সাংবিধানিকভাবে দেওয়া হয়েছে।

তাদের উচিত সরকারের বাস্তবায়ন করা বিভিন্ন নীতিমালা নিয়ে আলোচনা এবং বিতর্ক করা। তাদের উচিত সংসদে জনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যু উপস্থাপন করা এবং তা পরীক্ষা করে দেখা, যে সরকার সেসব বিষয়ে সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা। যদি সরকারের পদক্ষেপগুলি সঠিক পথে না যায়, তবে তারা সরকার কর্তৃক বাস্তবায়ন হতে যাওয়া কার্যক্রমগুলোর বিকল্প প্রস্তাব দেবে। সংসদ সদস্যদের এই সমস্ত কাজই শাসন ব্যবস্থার উন্নয়নে অবদান রাখবে এবং জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা যাতে সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করবে।

এমপিরা যখন তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে এবং দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন না, শাসন ব্যবস্থার তখন দুর্বলতা বেড়ে যায়, জনগণের অধিকার লঙ্ঘিত হয় এবং খারাপ পরিস্থিতির জন্য সরকারকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হয় না। কারণ এমপি’রাই ইতোমধ্যে ওই ব্যবস্থার একটি অংশ হয়ে যান। এটি ক্ষমতা বিচ্ছিন্নকরণের মতবাদেরও বিরোধী। অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতে, সংসদ সদস্যরা দুর্নীতিগ্রস্থ না হলেও, তারা প্রকৃত কল্যাণ রাষ্ট্রের ভালো বিকল্প নন।

এই পরিস্থিতির কারণে রাষ্ট্রের পালন না করা দায়িত্বের বোঝা বিচার বিভাগকে কাঁধে নিতে হয়। এর ফলে বিচারকদের উপর অতিরিক্ত কাজের চাপ তৈরি হয়। কীভাবে?

তাহলে পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্বের উদাহরণটাই দেখুন।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে, উচ্চ আদালত পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষকে রাজধানীর সবচেয়ে দূষিত নদী বুড়িগঙ্গার আশপাশের ২৩১ টি কারখানা বন্ধ করতে নির্দেশ দেয়।

এখানে লক্ষণীয় একটি বিষয় হল, পরিবেশ অধিদপ্তরের নদী দূষণকারী কারখানা বন্ধ করার ক্ষেত্রে আদালতের সিদ্ধান্তের কোনো প্রয়োজন নেই। কারখানাটি আইন মেনে চলতে ব্যর্থ হলে তা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরকে ক্ষমতা দেয়াই আছে। পরিবেশ অধিদপ্তর তার দায়িত্ব পালনে না করার কারণেই উচ্চ আদালতকে ব্যবস্থা নিতে বলতে হয়েছিল।

দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরকে জবাবদিহি করাতে কাজ করা উচিত ছিল সংসদ সদস্যদের। যেহেতু তারা এতে তেমন আগ্রহী ছিল না, তাই হাইকোর্টকে এর প্রতিকারের জন্য পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। বিচার ব্যবস্থায় বহু মামলার ভীড়ে আদালতের জন্য এটির পেছনে আলাদা করে সময় ব্যয় করতে হয়েছে, ফলে ন্যায়বিচারের জন্য অসংখ্য মানুষের অপেক্ষা আরও দীর্ঘ হয়েছে।

লেখক: উপ-নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

 

সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

  • 10
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে