ইতিহাস তাঁকে কীভাবে মনে রাখবে

প্রকাশিত: মার্চ ১৭, ২০২১; সময়: ৭:০৭ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
ইতিহাস তাঁকে কীভাবে মনে রাখবে

মহিউদ্দিন আহমদ : শৈশবে স্বজনেরা আদর করে ডাকতেন খোকা। নানা তাঁর নাম রাখলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্রজীবনেই জড়ালেন রাজনীতিতে। জ্যেষ্ঠ নেতাদের কাছে তিনি ‘মজিবর’ কিংবা ‘মজিবর মিয়া’। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্সে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি হলেন ‘বঙ্গবন্ধু’। একাত্তরের ৩ মার্চ পল্টনে ছাত্রলীগের এক জনসভায় তাঁকে ‘জাতির পিতা’ ঘোষণা করা হলো। একাত্তরের এপ্রিলে তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁকে রাষ্ট্রপ্রধান করে তৈরি হলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ক্ষমতার নৃশংস পালাবদলে সপরিবার নিহত হলেন তিনি। মাত্র ৫৫ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি ছিলেন অনেক ঘটনার অনুঘটক ও সাক্ষী। রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার আগেই জনপ্রিয়তার চূড়ায় উঠে যাওয়া বিরল ব্যক্তিদের একজন তিনি। তাঁকে নিয়ে আছে অনেক আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্ক, কুতর্ক, কৌতূহল ও বিভ্রান্তি। জন-আলোচনায় তিনি আছেন, থাকবেন। প্রশ্ন হলো, ইতিহাস তাঁকে কীভাবে মনে রাখবে।

একটি রাষ্ট্র ভেঙে আরেকটি রাষ্ট্র তৈরি হওয়া—এমনটি সচরাচর ঘটে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই অঞ্চলে এমনটি হয়েছে দু-দুবার, মাত্র ২৪ বছরের ব্যবধানে। একটি হলো পাকিস্তান, অন্যটি বাংলাদেশ। দুটি রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে আছেন প্রবাদপ্রতিম দুজন মানুষ—মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং শেখ মুজিবুর রহমান। স্বজাতির কাছে একজন ‘কায়েদে আজম’, অন্যজন ‘বঙ্গবন্ধু’। জিন্নাহ বলেছেন, তিনি, তাঁর সেক্রেটারি আর একটা টাইপরাইটার—এই তিন মিলে তৈরি হয়েছে পাকিস্তান। জিন্নাহ জননেতা ছিলেন না, ছিলেন দলের নেতা। তিনি এ রকম ভাবতেই পারেন। এমনটি কিন্তু শেখ মুজিবের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ, মুজিব ছিলেন আপাদমস্তক জননেতা। জনমনস্তত্ত্ব নিয়ে তাঁর যে প্রবল ঘ্রাণশক্তি, সেটি তাঁকে দিয়েছিল বিশিষ্টতা। তাই নেতাপ্রসূ এই উর্বর জমিতে তিনি অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে আকারে-প্রকারে বড় হয়ে উঠেছিলেন।

শেখ মুজিব তাঁর রাজনৈতিক জীবনে আগাগোড়া দুটি শিবিরের চক্ষুশূল ছিলেন। একটি শিবিরে ছিল ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো, অন্য শিবিরটি হলো কমিউনিস্টদের। উভয় বর্গের বেশির ভাগ নেতা ছিলেন সামন্ত বা এলিট। তাঁদের মধ্যে অনেক সময় একধরনের ঈর্ষা ও আক্ষেপ কাজ করত—ও কী করে এত বড় নেতা হয়? এটা সত্য যে বিরোধী শিবিরে ছিল ‘পণ্ডিতের’ ছড়াছড়ি। কিন্তু এ দেশের চাষাভুষারা তাঁদের কথা বোঝে না। তারা মুজিবকে মনে করত আপন লোক। একাত্তর সালজুড়ে এ দেশের ওপর দিয়ে যে প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে, যে রক্তারক্তি ঘটেছে, তখন গ্রামের মানুষ শেখ মুজিবের জন্য নফল রোজা রেখেছ। এ দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাটি এখনো পণ্ডিতদের দখলে থাকার কারণে জনমনস্তত্ত্বের ব্যাখ্যা সেভাবে উঠে আসেনি।

এর অন্য একটি দিকও আছে। শেখ মুজিব এমন একটি রাজনৈতিক দলের বা গোষ্ঠীর ‘লোগো’, যারা ক্ষমতায় আছে অনেক বছর ধরে। ক্ষমতার বৃত্ত কিংবা বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও লোভ থেকে জুটে গেছেন অনেক সুশীল স্তাবক। তাঁরা লিখছেন বন্দনাগীতি। একদিকে মোসাহেবি, অন্যদিকে গালিগালাজ—এর মধ্য দিয়ে মুজিবকে বের করে ইতিহাসের আলোয় প্রতিস্থাপন করার কাজটি কঠিন, ঝুঁকিপূর্ণ ও সময়সাপেক্ষ।

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (১৭৬৯–১৮২১) ফ্রান্সের রাজা ছিলেন ১০ বছর (১৮০৪-১৮১৪)। ১৮১২ সালের জুনে সাড়ে চার লাখ সৈন্য নিয়ে তিনি আক্রমণ করলেন রাশিয়া। ওই বছরের ডিসেম্বরে প্রচণ্ড শীতে পর্যুদস্ত হয়ে তিনি যখন ফ্রান্সে ফিরে আসেন, তখন তাঁর বাহিনীতে অবশিষ্ট আছে মাত্র ৯ হাজার সৈন্য। দুই পক্ষেই হতাহত হয়েছিল অগুনতি মানুষ। এ নিয়ে সাড়ে চার দশক পরে ১৮৬৫ সালে লিও তলস্তয় কিস্তিতে লিখতে শুরু করেন ওয়ার অ্যান্ড পিস। এটি বই আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ সালে। নেপোলিয়নের এই অভিযান নিয়ে একটি মহাকাব্যিক বিবরণ এবং অনেক বছর পর চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। যতই সময় যায়, ততই মানুষ সাম্প্রতিক ঘটনাবলির সংশ্লেষ ও আবেগ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে বড় ক্যানভাসে ইতিহাসের ন্যারেটিভ তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং এর চরিত্রগুলো নিয়ে ব্যবচ্ছেদের একটা সময় এসেছে এখন। এ ক্ষেত্রে আমরা এখনো পিছিয়ে আছি; কিন্তু কাজটা জরুরি।

রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির (পরে নাম হয় কমিউনিস্ট পার্টি) অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি ছিলেন গিওর্গি ভ্যালেন্তিনোভিচ প্লেখানভ (১৮৫৫-১৯১৮)। লেনিনকে সঙ্গে নিয়ে বের করেছিলেন দলের মুখপত্র ইসক্রা। পরে লেনিনের সঙ্গে মতবিরোধ হয় এবং তিনি দেশত্যাগ করেন। ১৮৯৮ সালে দ্য রোল অব ইনডিভিজ্যুয়াল ইন হিস্ট্রি (ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা) নামে তিনি একটি বই লেখেন। তাঁর মতে, মানুষ তাঁর ব্যক্তিগত গুণাবলির কারণে ইতিহাসের পরিক্রমায় বিশিষ্ট হয়ে ওঠেন। তাঁর মধ্যে এমন সব গুণের সমাবেশ ঘটে, যার ফলে সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে গিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন মহান। প্লেখানভের ভাষায়, এ রকম লোকেরা হলেন ‘মেন অব ডেসটিনি’। তাঁরা এমন সব চিন্তা নিয়ে আসেন, মানুষের মনোজগতে যার প্রচ্ছন্নভাবে আছে। তাঁরা এটাকে নাড়া দেন, উসকে দেন, ধারালো করেন।

১৯৪৭-পরবর্তী পূর্ব বাংলা (আজকের বাংলাদেশ) যে পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ, এটি মানুষ বুঝতে পারছিল ধীরে ধীরে। এ দেশের রাজনীতিতে দফাভিত্তিক দাবিদাওয়া উত্থাপনের তরিকা অনেক পুরোনো। ১৫, ২০, ৩০, ৪০, ৫০ দফা নিয়ে অনেকেই রাজনীতি করেছেন, এখনো করছেন। ফলে দাবির মূল ফোকাসটি অগুনতি দাবির ভিড়ে হারিয়ে যায়। শেখ মুজিব কেবল একটি দাবিকে নিয়ে এগোলেন—আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। ছয় দফা হলো তার অনবদ্য আর্টিকুলেশন। এটি ছিল মূলত একটি কনফেডারেশনের ফর্মুলা। কনফেডারেশন হয় একাধিক সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে। ছয় দফার মধ্যে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সর্বনাশের গন্ধ পেয়েছিল। ১৯৬৬-পরবর্তী মুজিব ভিন্ন একটি চরিত্র।

একাত্তর-পরবর্তী মুজিব একেবারেই আলাদা। একসময় তিনি ছিলেন ‘পলিটিশিয়ান’। এবার হলেন ‘স্টেটসম্যান’। একদা মাঠে-ঘাটে যা বলতেন, এখন তাঁকে অনেক কাজই উল্টো করতে হচ্ছে। এই বৈপরীত্যের বিষয়টি বুঝতে হলে বড় ক্যানভাস নিয়ে বসতে হয়। একটি জিনিস তিনি ভালোই বুঝেছিলেন যে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল বৈশ্বিক শীতল লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। একদিকে দিল্লি-মস্কো এক্সিস; অন্যদিকে ইসলামাবাদ, পিকিং-ওয়াশিংটন এক্সিস। মুজিব মনেপ্রাণে চাইলেন নির্জোট হতে। প্রথম সুযোগেই তিনি গেলেন লাহোর, ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তিনি চেয়েছিলেন পুরোনো শত্রু পাকিস্তানের সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে, ‘মুসলিম বিশ্বের’ সঙ্গে দূরত্ব ঘোচাতে। এটা অনেকে পছন্দ করেনি, এমনকি তাঁর দলের মধ্যেও। পাকিস্তানের দিকে সৌহার্দ্যের যে হাতটি তিনি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং এ জন্য যে ছাড় দিয়েছিলেন, পাকিস্তান তার প্রতিদান দেয়নি। এ নিয়ে তাঁর আক্ষেপ ছিল।

চুয়াত্তরের ৯ এপ্রিল দিল্লিতে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের ঘোষণায় উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি ও সম্প্রীতি গড়ে তোলার স্বার্থে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাতিল করে দেওয়ার কথা বলা হয়। চুক্তি সই করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন ঢাকায় ফিরে দেখা করেন শেখ মুজিবের সঙ্গে। মুজিব ছিলেন বিষণ্ন। কামাল হোসেনকে তিনি বলেন, ‘বাঙালিরা উদারতা দেখিয়েছে। এ অঞ্চলে একটি নতুন ধারা সৃষ্টির জন্য আমরা সর্বোচ্চ ছাড় দিয়েছি। কিন্তু আমি ভাবছি, জীবনে প্রথমবারের মতো জনগণকে দেওয়া ওয়াদা রাখতে পারলাম না। আমি বলেছিলাম বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। আমি আমার কথা রাখতে পারিনি। আশা করি এই সিদ্ধান্ত আমাদের জনগণের জন্য ভালো কিছু নিয়ে আসবে’ (কামাল হোসেন, বাংলাদেশ: কোয়েস্ট ফর ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস)।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির একটি সামগ্রিক ছবি এক দিনে আঁকা যাবে না। তাঁকে দেখতে হবে সময়ের আলোকে। সে জন্য সময়টিকে বোঝা দরকার। আগেই একটি উপসংহার টেনে তারপর যুক্তিতর্ক সাজানোর সনাতন গবেষণাপদ্ধতি নিয়ে এগোলে তাঁর ওপর সুবিচার করা যাবে না। কাজটি কঠিন, কিন্তু সম্ভব।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক

[email protected]

সূত্র : প্রথম আলো

  • 18
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে