স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির এই মহাক্ষণ আমাদের যা মনে করিয়ে দেয়

প্রকাশিত: মার্চ ২৭, ২০২১; সময়: ৬:৫৬ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির এই মহাক্ষণ আমাদের যা মনে করিয়ে দেয়

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ :
“সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি
ও আমার বাংলাদেশ…….”

বাংলাদেশের পতাকা জাপানের পতাকার ধাঁচে আঁকা হয়েছিলো, রং বদলিয়ে। বাংলাদেশকে এখন উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারির বলে বিবেচনা করা হয়।

আর্থসামাজিক উন্নয়নের সব সূচকেই আমরা এখন পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছি। অথচ বিগত শতকের ষাটের দশকের শেষ পর্যন্ত, সেসময়ের পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় সব উন্নয়নের সূচকেই আমরা অনেক পেছনে ছিলাম। আর সামাজিক উন্নয়নের কিছু কিছু সূচকে, যেমন জনসংখ্যার গড় আয়ুর বিচারে আমরা এখন প্রতিবেশী ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছি। কাজেই ছয় দফা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের পেছনের যে অর্থনৈতিক যুক্তি ছিলো তা যথার্থ প্রমাণিত হয়েছে।

হেনরি কিসিঞ্জার যে দেশকে তলাবিহীন ঝুঁড়ি বলে অবজ্ঞা করেছিলেন, তা এখন “উন্নয়নের বিস্ময়” বলে আখ্যায়িত হয়েছে। তার কারণ অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও বিগত তিন দশকে মাথা পিছু আয়ের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হিসাবে বাংলাদেশের স্থান উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে প্রথম সারিতে। তার থেকেও বেশি বিস্ময়ের বিষয় হলো শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সামাজিক উন্নয়নের সূচকগুলোতে অর্থনৈতিকভাবে সমকক্ষ দেশের তুলনায় আমাদের অনেক এগিয়ে থাকা, যদিও আমাদের সামাজিক খাতের সরকারি উন্নয়ন ব্যয় – সেটা মাথা পিছু বা জিডিপি-র অনুপাতেই হোক – তুলনামূলকভাবে অনেক কম, এবং সরকারি সেবার গুণগত মানও নিচু পর্যায়ের।

উল্লেখ্য, “তলাবিহীন ঝুঁড়ি” কথাটি হেনরি কিসিঞ্জার খুঁজে পেয়েছিলেন তার স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন কর্মকর্তার নথি থেকে। সেই কর্মকর্তা আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ নিয়ে অনেকদিন কাজ করেছিলেন এবং সেখানকার দেশগুলোকে নিয়ে কথাটি বলেছিলেন। বাংলাদেশেও সেরকম দুর্ভিক্ষের দেশ হবে এরকম ইঙ্গিত করতেই কিসিঞ্জার এই কথাটি ব্যবহার করেছিলেন। তাছাড়া এদেশের প্রতি তার রাজনৈতিক ক্ষোভ তো ছিলই। দুর্ভিক্ষ এখন বাংলাদেশে ইতিহাসের বিষয়।

উদীয়মান সূর্যের এই দৃশ্যে সূর্যের উজ্জ্বল আলো খানিকটা ঢাকা পড়েছে মেঘে। কেনো? একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের যে অঙ্গীকার ছিল তা রক্ষা হয় নি; বরং সমাজে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বৈষম্য বেড়েছে এবং এই দু ধরণের বৈষম্য একটি অন্যটির শক্তি যোগাচ্ছে। সমাজে নৈতিকতার মান কমছে। একটি জ্ঞানমনস্ক বুদ্ধিবৃত্তিক মধ্যবিত্ত সমাজের পরিধি বাড়ার বদলে বরং কমছে। “সুশীল সমাজ” কথাটিকে একটা হাসি ঠাট্টার বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে। অথচ জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় পুরো সমাজকেই তো সুশীল পরিশীলিত হয়ে গড়ে ওঠার কথা।

সর্বোপরি এত বছরেও আমরা দেশ শাসনের একটা টেকসই বন্দোবস্ত করতে পারি নি, যেখানে শাসন ব্যবস্থার সর্বস্তরে জবাবদিহিতা থাকবে। গনতান্ত্রিক বা কর্তৃত্ববাদী যে কোনো শাসন ব্যবস্থাতেই জবাবদিহি ছাড়া উন্নয়ন টেকসই হয় না। আমার এই বক্তব্যের সাথে একমত হলেও অমর্ত্য সেন তার সঙ্গে যোগ করেছেন ‘কর্তব্যপরায়নতা’। জবাবদিহি হলো কার্যকর প্রশাসনের একটা অপরিহার্য শর্ত, আর কর্তব্যপরায়নতা হলো একটা ব্যক্তিগত নৈতিকতার বিষয়; দুটোই দরকার। (সূত্র: আমার সম্প্রতি প্রকাশিত প্রবন্ধ: Bangladesh’s socio-economic progress with poor governance: how are Amartya Sen’s thoughts relevant for Bangladesh?)

মজার বিষয় হলো বাংলাদেশের “উন্নয়ন বিস্ময়” ব্যাপারটা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এবং আমাদের সরকারের নজরে এসে পৌঁছেছে অনেক পরে;

বাংলাদেশের গবেষকদের আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলোর সূত্র ধরে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এর উল্লেখও সর্বশেষ অমর্ত্য সেনের লেখালেখির হাত ধরে।

(www.scholar.google ওয়েবসাইটে “Bangladesh development surprise” দিয়ে সার্চ করলেই গবেষণা প্রবন্ধগুলো এবং অন্যরা তাদের সূত্র কতবার ব্যবহার করেছে সে সংখ্যা জানা যাবে।) আবার এখন যখন বিগত পাঁচ-সাত বছর ধরে সামাজিক উন্নয়নের অনেকগুলো সূচক স্থবির হয়ে গেছে, এমনকি উল্টো দিকেও যাচ্ছে, তা আমরা এখনো লক্ষ করি নি বা করতে চাই না। (সম্প্রতি প্রকাশিত Bangladesh Demographic and Health Survey 2017-18, Key Indicators রিপোর্টটি, যা ওয়েবসাইটে পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে সূচকগুলোর ধারাবাহিক পরিসংখ্যান দেয়া আছে।) সামাজিক খাতের সূচকগুলোর আশ্চর্যজনক উন্নতি কেন হলো, আবার এখন কেন সেগুলো ক্রমে স্থবির হয়ে যাচ্ছে তার কারণ অনুসন্ধান না করলে তো প্রতিবিধান করাও সম্ভব নয়।

সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

  • 5
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে