রাজকীয় স্মৃতিতে মোড়ানো উত্তরা গণভবন

প্রকাশিত: জুলাই ৫, ২০২৩; সময়: ১২:২৩ অপরাহ্ণ |
রাজকীয় স্মৃতিতে মোড়ানো উত্তরা গণভবন

ইন্দ্রাণী সান্যাল : প্রায় তিনশত বছরের ঐতিহ্যবাহী দিঘাপতিয়া রাজবাড়িটি বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম। নাটোর শহর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার উত্তরে এক মনোরম পরিবেশে ইতিহাস খ্যাত দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি তথা উত্তরা গণভবন অবস্থিত।

দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দয়ারাম রায়। তিনি নাটোরের রাজা-মহারাজ রামজীবনের একান্ত অনুগত একজন দেওয়ান ছিলেন। নাটোর রাজ্যের উত্থানে দয়ারাম রায় অসামান্য ভূমিকা রাখেন।

এ কারণে মহারাজ রামজীবন খুশি হয়ে ১৭০৬ সালের দিকে দয়ারামকে উপহার হিসেবে বাসস্থানের জন্য দিঘাপতিয়ায় কিছু জমি দান করেন। পরে জমিদার ও রাজা হওয়ার পর ১৭৩৪ সালে দয়ারাম রায় দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।

সাড়ে ৪১ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত প্রাসাদটি পরিখা ও উঁচু প্রাচীরঘেরা। প্রাসাদের পূর্বপাশে পিরামিড আকৃতির চারতলা প্রবেশদ্বার রয়েছে যা উপরের দিকে সরু। প্রবেশদ্বারের উপরের অংশে একটি বিরাটাকৃতির পাথরের ঘড়ি বসানো রয়েছে।

ঘড়িটি রাজা দয়ারাম সেই সময় ইংল্যান্ড থেকে আনিয়েছিলেন। ঘড়িটির পাশে রয়েছে একটি বড় ঘণ্টা। এক সময় এই ঘণ্টাধ্বনি বহুদূর থেকে শোনা যেত।

বাংলাদেশের অন্যান্য সামন্ত প্রাসাদের মতোই নাটোরের রাজবাড়িতে রয়েছে দীর্ঘ প্রবেশ পথ। এ পথের দু’ধারে বোতল পামের সুবিন্যাস লক্ষণীয়।

এছাড়াও প্রাসাদের ভেতরে বহু প্রাচীন ও দুর্লভ প্রজাতির গাছের সমাবেশ ও সমারোহে মনোরম পরিবেশ তৈরি করে। ঢাকার জাতীয় স্মৃতিসৌধের শোভাবর্ধনকারী রোপণকৃত ফুল ব্রাউনিয়া ও ককেসিয়া এখান থেকেই নেয়া হয়।

এছাড়া অন্যান্য বৃক্ষের মধ্যে এখানে আছে রাজ-অশোক, সৌরভী, পারিজাত, হাপাবমালি, কর্পূর, হরীতকী, যষ্টিমধু, মাধবী, তারাঝরা, মাইকাস, নীলমণিলতা, হৈমন্তীসহ বিভিন্ন দুর্লভ প্রজাতির ফলজ ও ঔষধি বৃক্ষ। প্রাসাদের মধ্যে পরিখা বা লেকের পাড়ে এসব বৃক্ষের মহাসমারোহ।

প্রাসাদের প্রবেশ পথের চারদিকে প্রাসাদঘেরা পরিখা যা পুরো রাজপ্রাসাদকে ঘিরে রেখেছে। ভেতরে বিশাল মাঠ ও গোলাপ বাগান, একপাশে গণপূর্ত অফিস।

দ্বিতল হলুদ ভবনটি কুমার প্যালেস নামে পরিচিত। এই প্রাসাদে শেষ রাজকুমার (বড় রাজকুমার) প্রভাত কুমার রায় বসবাস করতেন। প্রাসাদের নিচতলাটি টর্চারসেল হিসেবে ব্যবহৃত হত।

এই চত্বরে একটি একতলা তহশিল অফিস আছে। সে সময়কার চারটি কামান রয়েছে। কামানগুলোর স্থাপনকাল ছিল ১৭৯৯ সাল।

বিশাল রাজদরবারসংলগ্ন বাগানে জমিদার দয়ারামের একটি ভাস্কর্য তার স্মৃতির প্রতীক। প্রাসাদের মধ্যে একটি মিলনায়তন ভবনসহ রয়েছে আরও দুইটি ভবন।

গাড়ি পার্ক করার গ্যারেজ আলাদা। যাবতীয় স্থাপনা মাঝখানে। প্রাসাদের ভেতর রয়েছে বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিসপত্র। ভবনের মধ্যে জাদুঘর, বহু দর্শনীয় স্মৃতিস্তম্ভ, ভাস্কর্য ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য দৃষ্টি কাড়ে।

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর দিঘাপতিয়ার শেষ রাজা প্রতিভানাথ রায় ভারতে চলে যান। এসময় থেকে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি পরিত্যাক্ত অবস্থায় থাকে।

১৯৫০ সালে জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হওয়ার পর দিঘাপতিয়ার রাজ প্রাসাদটির রক্ষণবেক্ষণে বেশ সমস্যা দেখা দেয়। ১৯৬৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার রাজবাড়িটি অধিগ্রহণ করে।

রক্ষণবেক্ষণের সমস্যা সমাধানে দিঘাপতিয়ার মহারাজাদের এই বাসস্থানকে ১৯৬৭ সালের ২৪ জুলাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আব্দুল মোনায়েম খান দিঘাপতিয়ার গভর্নরের বাসভবন হিসেবে উদ্বোধন করেন।

পরে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এক আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে এর নাম পরিবর্তন করে উত্তরা গণভবন ঘোষণা করেন।

গনভবনে রয়েছে একটি সংগ্রহশালা। যা ২০১৮ সালের ৯ মার্চ স্থাপিত হয়। উত্তরা গণভবনের পুরাতন ট্রেজারিভবনে স্থাপিত সংগ্রহশালায় বিভিন্ন রাজার আমলের অন্তত শতাধিক জিনিসপত্র স্থান পেয়েছে।

এই সংগ্রহশালাকে রাজার আমলের শতাধিক দুষ্প্রাপ্য সামগ্রীর সমাহারে সাজানো হয়েছে। অতীতের সাথে বর্তমানের মেলবন্ধন তৈরি করেছে এই সংগ্রহশালা।

সংগ্রহশালার করিডোরে রাজা প্রমদানাথ রায় ও সস্ত্রীক রাজা দয়ারাম রায়ের ছবি আর রাজবাড়ির সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে। করিডোরে মার্বেল পাথরের একটি রাজকীয় বাথটাব আছে।

ডানপাশের কক্ষে রাজার পালঙ্ক, ঘূর্ণায়মান চেয়ার, টেবিল, আরামচেয়ার আর ড্রেসিংটেবিল স্থাপন করে তৈরি করা হয়েছে রাজার শয়নকক্ষ।

বামপাশের দ্বিতীয় কক্ষে শোভা বাড়াচ্ছে রাজসিংহাসন, রাজার মুকুট আর রাজার গাউন। আরও আছে মার্বেল পাথরের থালা, বাটি, কাচের জার, পিতলের গোলাপ জলদানি, চিনামাটির ডিনার সেট। একটি কক্ষ রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা চৌধুরাণীর।

সুলেখক ইন্দ্রপ্রভাকে রাখা হয়েছে তারই পিতলের ছবির ফ্রেমে। আছে তার ব্যক্তিগত ডায়েরি, আত্মজীবনী, পাণ্ডুলিপি ও তার কাছে লেখা স্বামী মহেন্দ্রনাথ চৌধুরীর রাশি রাশি চিঠি।

দর্শনার্থীদের জন্যে ইন্দুপ্রভার লেখা বঙ্গোপসাগর কবিতাটি ফ্রেমে বাঁধাই করে দেয়ালে টানানো হয়েছে। ৬৭ লাইনের এই কবিতায় মুগ্ধ কবি বর্ণনা করেছেন বঙ্গোপসাগরের অপরুপ সৌন্দর্য।

করিডোর ছাড়াও সংগ্রহশালার দশটি কক্ষের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন সব আসবাবপত্র। বিশেষ করে রকমারি সব টেবিল।

এর মধ্যে ডিম্বাকৃতির টেবিল, গোলাকার টেবিল, দোতলা টেবিল, প্রসাধনীটেবিল, অষ্টভুজ টেবিল, চর্তুভূজ টেবিল, কর্নার টেবিল, গার্ডেন ফ্যান কাম টি-টেবিল ইত্যাদি।

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে