বাংলার শিল্প ও সংস্কৃতির স্মারক-হাতপাখা

প্রকাশিত: জুলাই ১৮, ২০২৩; সময়: ৩:২৭ অপরাহ্ণ |
বাংলার শিল্প ও সংস্কৃতির স্মারক-হাতপাখা

ইন্দ্রাণী সান্যাল: প্রযুক্তির হাওয়া লেগেছে সব ক্ষেত্রেই। হোক সে শিল্প-সংস্কৃতি,যোগাযোগ কিংবা নিত্যদিনকার কাজ-কর্ম। প্রযুক্তি যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে আমাদের। ফলশ্রুতিতে আজ বিলুপ্তির পথে বহু ঐতিহ্যেবাহী শিল্প যা একসময় বহুল প্রচলিত ছিলো। তার মধ্যেই একটি হলো হাতপাখা ও নকশি পাখা।

শীতে কাঁথা, বর্ষার ছাতা আর গরমে তালপাখা এ ছিল বাঙালির চিরকালের সম্বল। হাতপাখা বেশ পুরনো। যে সময়ে এসি,কুলার কিংবা ইনভার্টার এর আধিক্য ছিলো না সে সময়ে হাতপাখার প্রচলন ছিলো খুব বেশি। বিয়ে,পুজো-পার্বণ কিংবা অতিথি আপ্যায়নে হাতপাখার হাওয়ার জুড়ি মেলাই ছিলো ভার। বর্তমানে গ্রাম-গঞ্জে হাতপাখা প্রচলিত থাকলেও শহরে এর ব্যবহার খুব বেশি নেই বললেই চলে।

তাল পাতার তৈরী সাধারণ হাতপাখা বেশ প্রচলিত। নিছক সাধারণ হলেও এর হাওয়া অতুলনীয়। এসব হাতপাখা তৈরীতে ব্যবহৃত হয় তালপাতা,বাঁশ,বেত এবং রং৷ একটি তালপাতা থেকে মাত্র একটি পাখা তৈরী হয়। সাধারণত এই হাতপাখা তৈরি হয় দু-তিন খেপে। তালগাছের পাতা কেটে, জলে ডুবিয়ে জাঁক দিয়ে সেই পাতা সোজা করা হয়। এরপর সেই পাতা সাইজ করে কেটে, চারিপাশে বাঁশের সরু চট দিয়ে বাঁধা হয়। এরপর সরু বেতি দিয়ে ছোট ছোট তিনকোণা নকশা করে তালপাতা সরু করে কেটে বোনা হয় এসব হাতপাখা। এরপর রং করে বাজারে ছাড়া হয়।

সৌন্দর্যের কথা মাথায় রেখে এসবের পাশাপাশি তৈরী হয় বাহারী নকশী পাখা। এসব পাখার বিশেষত্ব হচ্ছে, পাখায় রঙিন কাপড়ের ঝালর এবং সুতো দিয়ে বোনা হয় নানা ধরনের নকশা। এসব নকশায় ফুটে ওঠে গ্রামবাংলার লোকগাঁথা , জ্যামিতিক নকশা, গান এবং বিখ্যাত প্রবাদ-প্রবচন। এসব পাখা যেমন ঠান্ডা হাওয়া দেয় তেমনি দেখতেও বেশ দৃষ্টিনন্দন এবং রুচিশীল। আজকাল তালপাতার পাখার বদলে শৌখিন প্লাস্টিকের হাতপাখা দেখতে পাওয়া যায়। যার হাওয়া তালপাতার পাখার কাছে একেবারেই মলিন।

ময়ূরের পালকের এবং চন্দন কাঠের তৈরী পাখা ও এককালে বেশ প্রচলিত ছিলো। ময়ূরের পালকের তৈরী পাখায় নকশার প্রয়োজন হয় না। এসব পাখা পূজা-অর্চনায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। চন্দন কাঠের তৈরী পাখা এদেশীয় নয়, এর উদ্ভব হয়েছিল চীনে। আঠার-উনিশ শতকের দিকে বিত্তবান পরিবারের মেয়েরা এ ধরনের পাখা ব্যবহার করতো। এ ধরনের ফোল্ডিং পাখার আদলে তৈরী বর্তমানে তালপাতার তৈরী এবং প্লাস্টিকের তৈরী ফোল্ডিং পাখা দেখতে পাওয়া যায়।

যুগ বদলেছে। ঘরে ঘরে এখন যান্ত্রিক বাতাস। লোডশেডিং নেই বললেই চলে। এসব কারণে তালপাতার তৈরী আরামদায়ক পাখাও বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। তাছাড়া বিলুপ্তির অন্যতম আরেকটি কারণ হলো পর্যাপ্ত পরিমাণে গাছের অভাব। দ্রুত শহরায়নের ফলে কেটে ফেলা হচ্ছে গাছ। ফলে পর্যাপ্ত তালপাতা সংগ্রহ সম্ভব হয়ে উঠছে না। তার বদলে বাজার দখল করেছে বাঁশের তৈরী পাখা, দেখতে তালপাতার তৈরী পাখার মতো হলেও এটি বহন করা তেমন আরামদায়ক নয় এবং সুবাতাস পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের দিকে বংশ-পরম্পরায় এখনো অনেকে তালপাতার হাতপাখা তৈরী এবং এর ব্যবসা ধরে রেখেছেন। কুটির শিল্প মেলা, বাণিজ্য মেলায় বিক্রি হয়ে থাকে এই হাতপাখা। তালপাতার হাতপাখার জন্য সবচেয়ে প্রসিদ্ধ স্থান নওঁগার সান্তাহার। এসব হাতপাখায় ব্যবহৃত তালপাতার গুণগতমান, বুনন প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে ১০০-২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়ে থাকে। বাঁশের তৈরী হাতপাখার দাম তুলনামূলক কম ২০-৫০ টাকার মতন। জায়গাভেদে এর তারতম্য দেখা যেতে পারে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে পাখার বিক্রি কিছুটা বৃদ্ধি পায় এবং পূজো-পার্বণ ও বিয়ে ছাড়া পাখা ব্যবহার তেমনটা নেই।

হাতপাখা বাংলার ঐতিহ্যেবাহী লোকশিল্প। এটিকে টিকিয়ে রাখা সকলেরই অবশ্য কর্তব্য। একমাত্র পযার্প্ত তালগাছ রোপণ, অযথা গাছ কাটা রোধ এবং হাতপাখা ব্যবসায়ীদের সরকারিভাবে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান ও নায্যমূল্যে বিপণন ব্যবস্থাই পারে বাংলার এই ঐতিহ্যেবাহী লোকশিল্প হাতপাখা শিল্পকে বাংলার বুকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে বহুকাল।

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে