সেই আঁধারেও খুনিদের মুখ চেনা

প্রকাশিত: আগস্ট ২১, ২০২৩; সময়: ৩:১৫ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
সেই আঁধারেও খুনিদের মুখ চেনা

আবেদ খান : ২০০৪ সালের ২১ আগস্টকেও, আমার মতে, কোনোভাবে হালকা করে দেখার কোনো সুযোগই নেই। এর ভয়াবহতা, হিংস্রতা ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের নারকীয় নৃশংসতারই ধারাবাহিকতা মাত্র। ’৭৫ ছিল আমাদের জাতির পিতার পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করার বীভৎস প্রয়াস এবং ২১ আগস্ট ছিল দেশের এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ নির্ভরযোগ্য আশ্রয় জননেত্রী শেখ হাসিনাকে তার রাজনৈতিক ঠিকানাসমেত বিলীন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। ’৭৫-এর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী চক্রের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ব্যক্তি এবং পরিবারের বিনাশ। আর ২১ আগস্ট ছিল শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে চিরতরে মুছে ফেলার বীভৎস কার্যক্রম।’

৭৫ ছিল অধিকতর পরিকল্পিত, সুসংহত গোষ্ঠীর হিংস্র অভিযান। ’৭৫-এ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটির আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা মুখোশধারীদের ছিল স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশ। আর ২০০৪-এর আগস্ট মাসের হিংস্রতা ছিল অধিকতর পরিকল্পিত। আর্জেস গ্রেনেড, অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র, ক্ষমতায় থাকা স্বাধীনতাবিরোধী নেটওয়ার্ক এবং বিচারালয়ের একটি দূষিত অংশসমেত প্রশাসনের ভেতরে ঘাপটি মারা সরীসৃপরা। অবশ্য আরেকটি দিকও প্রণিধানযোগ্য—’৭৫-এর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ছিল অসংগঠিত, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে নিষ্ক্রিয়। কিন্তু ২০০৪-এর আওয়ামী লীগ ছিল অধিকতর সংগঠিত, যা নেত্রীর প্রাণরক্ষার জন্য মানবঢাল রচনা করতে মুহূর্তমাত্রও কালক্ষয় করেনি। কাজেই রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করতে গেলে এ বিষয়কে উপলব্ধি করতে হবে।

গতকাল গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলে ২১ আগস্টের সেই ভয়াল স্মৃতি নিয়ে আমরা কথা বলি।

২১ আগস্ট, ২০০৪। আমি তখন দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদকের দায়িত্বে। সেদিন প্রতিবাদ সভার উদ্দেশ্যেই আমি বের হয়েছি। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশ থেকে কিছু দূরে থাকতেই ড্রাইভার দেখে বলল, ওদিকে যাওয়া যাবে না, বোমা হামলা হয়েছে! আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। সামনে দেখা যাচ্ছিল মানুষের ছোটাছুটি-চিৎকার-চেঁচামেচি, পুলিশের ব্যারিকেড, বাতাসে ধোঁয়া আর পোড়া গন্ধ। আমি বললাম, যেতে তো হবেই কিন্তু আমাকে তারা জোর করে আটকে দিল। কিছুক্ষণ পরে যখন সভাস্থলে প্রশাসনের লোকেরা আসলেন, তখনো কিছু অবিস্ফোরিত গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে হাসপাতালগুলোতে গিয়েছি এবং আহতদের খোঁজখবর নিয়েছি। শেষে গেলাম সুধা সদনে। সেখানে নেত্রীসহ নেতাকর্মীরা প্রচণ্ড রকমের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। যে গাড়িটির ওপর হামলা হয়েছিল, গাড়িটিকে দেখলাম সেই ভয়াবহ আক্রমণের চিহ্ন বহন করে দণ্ডায়মান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা। বিএনপি সরকারের সন্ত্রাস-দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে সেদিন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। একটি ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে সমাবেশ চলছিল। শেখ হাসিনা বিকেল ৫টার দিকে সমাবেশস্থলে পৌঁছান। বুলেটপ্রুফ গাড়ি থেকে নেমে নিরাপত্তাকর্মী ও দলীয় নেতাকর্মী পরিবেষ্টিত অবস্থায় তিনি সেই অস্থায়ী মঞ্চে ওঠেন।

সমাবেশে তিনি বক্তব্য শুরু করেন ৫টা ২ মিনিটে। ২০ মিনিটের বক্তব্য শেষে ৫টা ২২ মিনিটে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে মাইক ছেড়ে পিছিয়ে যাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় ফটোসাংবাদিক এসএম গোর্কি তাকে একটি ছবির জন্য অনুরোধ করেন। তখন শেখ হাসিনা আবার ঘুরে দাঁড়ান। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ভয়াবহ ও অভিশপ্ত সেই ঘটনাটি ঘটে যায় চোখের পলকেই। তাকে লক্ষ্য করে একটি গ্রেনেড ছুটে আসে। গ্রেনেডটি ট্রাকের বাঁ পাশে পড়ে বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেখ হাসিনা ট্রাকের ওপর বসে পড়েন। তার সঙ্গে থাকা অন্য নেতারা এ সময় মানবঢাল তৈরি করে তাকে ঘিরে ফেলেন।

প্রথম গ্রেনেড হামলার মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ট্রাক লক্ষ্য করে একই দিক থেকে পরপর আরও দুটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। বিকেল ৫টা ২২ মিনিট থেকে এক-দেড় মিনিটের ব্যবধানে ১৩টি বিকট বিস্ফোরণ ঘটে। তখন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ও সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, নিরাপত্তা কর্মকর্তা মেজর (অব.) শোয়েব, ব্যক্তিগত স্টাফ নজীব আহমেদসহ দেহরক্ষীরা শেখ হাসিনাকে ধরে ট্রাক থেকে দ্রুত নামিয়ে তার মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িতে তুলে দেন।

নেতাকর্মীরা মানবঢাল তৈরি করে তাকে বাঁচাতে পারলেও আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান ও শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীসহ ২৪ জন নেতাকর্মী এ ভয়াবহ, নৃশংস, নিষ্ঠুর-নির্মম গ্রেনেড হামলায় মারা যান; আহত হন নেত্রীসহ পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। সাংবাদিকরাও আহত হন। সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রাণে বেঁচে গেলেও তার শ্রবণেন্দ্রিয় ও চোখ তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অলৌকিকভাবে এ যাত্রায়ও মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসেন তিনি।

২১ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে আরও একটি ভয়াবহ কলঙ্কময় দিন। দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি অর্থাৎ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে নেতৃত্বশূন্য করাই ছিল এ জঘন্য ও পৈশাচিক আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করে দিয়ে দেশকে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিরাষ্ট্রে পরিণত করতেই সেদিন আওয়ামী লীগ ও জননেত্রী শেখ হাসিনাকে নিশ্চিহ্ন করতে হামলে পড়েছিল সেই ১৫ আগস্টের ঘাতকরা এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রেতাত্মারা। সুপরিকল্পিত এ হামলা করেছিল যারা তারা কখনোই বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি এবং এটি ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যার ধারাবাহিক চেষ্টার এক চূড়ান্ত রূপ।

গ্রেনেড হামলা থেকে কোনোভাবে বেঁচে গেলেও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যেন প্রাণ নিয়ে ফিরতে না পারেন, তার সব চেষ্টাই করেছিল হামলাকারীরা। তার গাড়ির কাচে কমপক্ষে সাতটি বুলেটের আঘাতের দাগ, গ্রেনেড ছুড়ে মারার চিহ্ন এবং বুলেটের আঘাতে পাংচার হয়ে যাওয়া গাড়ির দুটি চাকা সে কথাই প্রমাণ করে। এটি ছিল একেবারে ঠান্ডামাথায় হত্যার পরিকল্পনা। তিন স্তরের বুলেটনিরোধক ব্যবস্থাসম্পন্ন মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িটিই সেদিন শেখ হাসিনার প্রাণ বাঁচিয়েছে বলে তার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব সাবের হোসেন চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন।

সেদিন তিনি বলেছিলেন, গ্রেনেড আক্রমণ ব্যর্থ হলে নেত্রীকে হত্যার বিকল্প পন্থা হিসেবে বন্দুকধারীদের তৈরি রাখা হয়। আর এ বন্দুকধারীরাই খুব হিসাব কষে নেত্রীর গাড়ির কাচে গুলি চালায়। এ গুলি বুলেটপ্রুফ কাচ ভেদ করতে ব্যর্থ হলে তারা গাড়ি লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে মারে। কিন্তু এ চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। সবশেষে গাড়ির চাকা লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে থামানোর চেষ্টা করা হয়। এ অবস্থায় গুলির আঘাতে গাড়ির বাঁ পাশের সামনের ও পেছনের দুটি চাকা পুরোপুরি পাংচার হয়ে গেলেও চালক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেই গাড়িটি বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে ধানমন্ডির সুধা সদনে নিয়ে যান।

বিবিসি থেকে ফোন করা হলে সেদিন নেত্রী নিজের কথা ভুলে প্রথমেই বলেছিলেন, ‘আমার কর্মীরা জীবন দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছেন। গ্রেনেড যখন বিস্ফোরিত হচ্ছিল, তখন নেতাকর্মীরা আমাকে ঘিরে রেখেছিলেন। তাদের অনেকেই আহত হয়েছেন। এখনো আমার কাপড়ে তাদের রক্ত লেগে আছে।’

আমরা যদি ২১ আগস্টের কিছু আগের এ জঙ্গিগোষ্ঠী ও এর নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীদের কর্মকাণ্ডকে পর্যালোচনা করি, তাহলে সহজেই দেখতে পাব—১৯৯৯ সালের মার্চ থেকে ২০০৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় বছরে এ জঙ্গিগোষ্ঠী দেশে ১৩টি বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে ১০৬ জন নিহত হন। আহত হন ৭০০-এর বেশি মানুষ। আওয়ামী লীগ ও সিপিবির সমাবেশ, উদীচী ও ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর এসব হামলা হয়। এ সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকেই হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে অন্তত চার দফা।

তারও আগে যদি দেখি, তাহলে দেখা যাচ্ছে—তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের (১৯৯৬-২০০১) শেষ তিন বছর হুজি-বির জঙ্গিরা আটটি বড় ধরনের বোমা হামলা চালিয়েছিল। তখন তিন দফা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালায় এ জঙ্গিরা। এর মধ্যে প্রথম চেষ্টা হয়েছিল ২০০০ সালের জুলাইয়ে; গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রীর জনসভাস্থল ও হেলিপ্যাডের কাছে দূরনিয়ন্ত্রিত দুটি শক্তিশালী বোমা পুঁতে রেখে। কোটালীপাড়ায় হত্যার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর ২০০১ সালের ৩০ মে খুলনায় রূপসা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল হুজি। কিন্তু তিন দিন আগে ২৭ মে সেতুর কাছাকাছি রূপসা নদী থেকে দুটি ইঞ্জিন নৌকাভর্তি ১৫ জঙ্গি ধরা পড়ে যাওয়ায় সেটিও আর সফল হয়নি। এই ১৫ জনের একজন মাসুম বিল্লাহ ওরফে মুফতি মইন ঢাকায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় অংশ নিয়েছিল।

বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর এ মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। গ্রেপ্তার হওয়া সবাই কিছুদিন পর জামিনে বেরিয়ে যায়। এসব ঘটনায়ই বিএনপি-জামায়াতকে দেখা যায় নানাভাবে চক্রান্তকারী ও আক্রমণকারীদের সঙ্গে থাকা, তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া, রক্ষা করা এবং পৃষ্ঠপোষকতা করা। এসব হামলার প্রধান আসামি মুফতি হান্নানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইডির এমন একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে এ জঙ্গিনেতা বলেছেন, শেখ হাসিনাকে হত্যা করার পরিকল্পনা অনেক বড় জায়গা থেকে এসেছে। তিনি শুধু তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন।

‘বড় জায়গা’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে বিস্তারিত বলেননি। তবে আদালতে তিনি বলেছেন, ২০০০ সালের জুলাই মাসে হুজির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে শেখ হাসিনাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন তারা। আর ২১ আগস্ট হামলার ঘটনায় তৎকালীন উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও বিএনপির নেতা তারেক রহমানের সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এই সেই সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর যাকে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন আদালত।

এসব হামলা ও পৈশাচিক ঘটনাগুলোর বহির্গত কিছু পার্থক্য থাকলেও প্রকৃতই যে একই সূত্রে গাঁথা—তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। যেসব অবিস্ফোরিত গ্রেনেডগুলো পাওয়া গিয়েছিল, তা সবই ‘আর্জেস গ্রেনেড’ যা সাধারণত সেনাবাহিনীর ব্যবহারের জন্যই প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে অবিস্ফোরিত গ্রেনেড আর জেলখানার অভ্যন্তরে পাওয়া গ্রেনেড সবই একই এবং এর গায়ে লেখা ‘মেইড অব পাকিস্তান’। তখনই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়, গ্রেনেডগুলোর জন্মস্থান ও কাদের হাত ধরে এ দেশে সেগুলোর আবির্ভাব। গ্রেনেড হামলার ঘটনার পরদিনই মতিঝিল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলাটির প্রথমে তদন্ত শুরু করে থানা পুলিশ।

পরবর্তীকালে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ হয়ে তদন্তের দায়িত্ব পড়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে। আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী আরও দুটি মামলা করেছিলেন। পরে সেসব মামলা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ২০০৪ সালের ২২ আগস্ট বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে সরকার। মাত্র ১ মাস ১০ দিনের মাথায় ওই বছরের ২ অক্টোবর কমিশন সরকারের কাছে ১৬২ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিশনের সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণ সন্দেহাতীতভাবে ইঙ্গিত করে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পেছনে একটি শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল। যদিও ওই প্রতিবেদনে বিদেশি শক্তি বলতে কোনো দেশের নাম বলা হয়নি। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১১ জুন মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন সিআইডির জ্যেষ্ঠ এএসপি ফজলুল কবির। ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন।

এরপর মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আখন্দ। তিনি ২০১১ সালের ৩ জুলাই বিএনপি নেতা তারেক রহমানসহ ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে ৫২ জনের নামে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র দেন। সেদিন বিশেষ নিরাপত্তার মধ্যে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা-সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ স্বাক্ষরিত চার্জশিটটি দাখিল করেন এসআই গোলাম মাওলা। দুটি পৃথক ট্রাঙ্কে ভর্তি করে আনা চার্জশিটে নতুন করে ৩০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।

গ্রেনেড হামলার পর পৃথক মামলা হয়েছিল তিনটি। এর মধ্যে প্রথম সাত বছরের মধ্যেই তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয় মোট ছয়বার। প্রথম তদন্ত হয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে কিন্তু কোনো প্রতিবেদন দাখিল হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে নতুন তদন্তে সিআইডির এএসপি ফজলুল কবীর ২০০৮ সালের ১১ জুন অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ওই অভিযোগপত্রে মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে অভিযুক্ত করা হলেও গ্রেনেডের উৎস ও মদতদাতাদের শনাক্ত করা হয়নি।

বর্তমান সরকারের আমলে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পর আদালত মামলার বর্ধিত তদন্তের আদেশ দেন। ১৩ দফা সময় বাড়িয়ে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার মধ্য দিয়ে ভয়ংকর গ্রেনেড হামলার তদন্ত শেষ হয়। যেখানে নতুনভাবে অভিযুক্তদের মধ্যে স্থান পান বিএনপি নেতা তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ উল্লেখযোগ্য। সম্পূর্ণ বিচার প্রক্রিয়া শেষে ১০ অক্টোবর ২০১৮ সালে গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে বাবর-পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, তারেকসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১।

আগস্টের ঘটনার কিছু পরেই লক্ষ করা যায়, এ নারকীয় ঘটনার সঠিক ও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্ত ব্যাহত করার অপতৎপরতা। হামলাকারীদের নানাভাবে বাঁচানোর পথ তৈরি করে দেয় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। গুরুত্বপূর্ণ সব আলামত ধ্বংস করে দেয়। এ বিষয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপি সরকার যদি এর সঙ্গে জড়িত নাই থাকবে, তাহলে তারা আলামতগুলো কেন নষ্ট করবে? ওই গ্রেনেড হামলার পরেই সিটি করপোরেশনে তখন মেয়র সাদেক হোসেন খোকা তার লোকজন নিয়ে এসে পুরো এলাকা ধুয়ে ফেলে।… সেই গ্রেনেডটাকে একজন সেনা অফিসার আলামত হিসেবে রাখতে চেয়েছিলেন বলে খালেদা জিয়া তাকে চাকরিচ্যুত করেছিল। কোনো আলামতই তারা রাখতে চায়নি।…’

২১ আগস্ট মামলায়, ২০০৫ সালে আলোচিত অধ্যায় ‘জজ মিয়া’ নাটকও জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। এরও আগে বাংলাদেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা হামলার ঘটনায় বাংলাভাই ‘মিডিয়ার সৃষ্টি’ বলে মন্তব্য করেছিল বিএনপি-জামায়াত। কিন্তু কোনো সত্যই চাপা থাকেনি। সময়ের আবর্তে সবই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায় একসময়। এভাবেই একসময় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তে উন্মোচিত হয় বিএনপি-জামায়াত জোটের অনেক কুশীলবের হামলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততার বিষয়টি। ২০১৮ সালের অক্টোবরে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায়েই আমরা দেখতে পাই সেসব নরঘাতককে।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে