যেসব সংস্কার করতে চান মুহাম্মদ ইউনূস
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার ১৭ দিন পর জাতির উদ্দেশে দ্বিতীয় ভাষণে নিজের কর্ম পরিকল্পনার ধারণা দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন সাপেক্ষ তা বাস্তবায়নের কথা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস
রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, “আমরা বিভিন্ন সংস্কারের কাজ শুরু করেছি। দেশবাসীকে অনুরোধ করব একটা আলোচনা শুরু করতে, আমরা সর্বনিম্ন কী কী কাজ সম্পূর্ণ করে যাব, কী কী কাজ মোটামুটি করে গেলে হবে।
“এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা একটা দিক নির্দেশনা পেতে পারি। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক আলোচনা থেকেই আসবে। আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমরা আমাদের পক্ষ থেকে মেয়াদ বৃদ্ধির কোনো প্রশ্ন তুলব না।”
রোববারের ভাষণে দেশের বিভিন্ন খাতের সংস্কারের কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
ব্যাংক ও আর্থিক খাত
অন্তর্বর্তী সরকার ‘লুটপাট ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা’ ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিতের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান মুহাম্মদ ইউনূস।
জাতির উদ্দেশে তিনি বলেন, “এই খাতে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা স্থাপন, ব্যবসা-বাণিজ্যের সহায়ক পরিবেশ তৈরি এবং জনগণের জীবনযাপন সহজ করতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ও মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার আমরা উদ্যোগ সচল করেছি।
“ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘ মেয়াদি সংস্কারের জন্য ব্যাংক কমিশন গঠন করা হবে। আর্থিক খাতে সার্বিক পরিস্থিতি এবং সংস্কার বিষয়ে একটি রূপকল্প তৈরি করা হবে, যা দ্রুত জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। শেয়ার বাজার, পরিবহন খাতসহ যেসব ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে, তা নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।”
বিচার বিভাগ
বিচার বিভাগকে ‘দুর্নীতি ও দলীয় প্রভাবমুক্ত’ রাখার কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে জানান ইউনূস। তিনি বলেছেন, “একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, অপহরণ এবং আয়নাঘরের মত চরম ঘৃণ্য সকল অপকর্মের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।
“এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত সকলের বিচার নিশ্চিত করা হবে। আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে জনমুখী ও দলীয় প্রভাবমুক্ত ও জবাবদিহিতামূলক কাঠামো সৃষ্টির লক্ষে পুলিশ কমিশন গঠন করা হবে। জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন, দায়িত্বপ্রাপ্ত সকল সংস্থা ও জনগণের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে কমিশনের নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। বাংলাদেশকে আর কোনো দিন কেউ যেন কোন পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত না করতে পারে, তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
মুক্ত গণমাধ্যম
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, “তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। ফ্যাসিবাদী সরকার গণমাধ্যমের ওপরও দলীয়করণ ও নির্যাতনের বোঝা চাপিয়েছিল। জনগণের তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
“তথ্যের প্রবাহে বিদ্যমান আইনি ও অন্যান্য বাধা অপসারণ করা হবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করে এমন সব আইনের নিপীড়নমূলক ধারা সংশোধন করা হবে। ইতোমধ্যে এধরনের আইনগুলো চিহ্নিত করে এই প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।”
শিক্ষা সংস্কার
শিক্ষাখাতে বিগত সরকার চরম নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠা করে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন মুহাম্মদ ইউনূস। “আমরা তার পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের উদ্যোগ নেব। এটা আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার। আপনারা জানেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য সৃজনশীল, নিরাপদ ও ভীতিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা আমাদের অঙ্গীকার। একই সাথে পাঠ্যক্রমকেও যুগোপযোগী করার কাজও দ্রুত শুরু করা হবে,” বলেন তিনি।
স্থানীয় সরকার
ইতোমধ্যেই সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকারে বিগত সরকারের সময় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বাদ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকারে জনগণের ‘সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব’ নিশ্চিত করার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা হবে এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা হবে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে সফল পরিণতি দিতে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনি ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা খাত এবং তথ্য প্রবাহে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পূর্ণ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা হবে। এর লক্ষ্য হবে দুর্নীতি, লুটপাট ও গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি জবাবদিহিতামূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা।”
দুর্নীতি
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছে। আমাদের সকল উপদেষ্টা দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করবেন। পর্যায়ক্রমে এটি সকল সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও নিয়মিত এবং বাধ্যতামূলক করা হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে প্রতিশ্রুত ন্যায়পাল নিয়োগে অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হবে।”
আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের দুর্নীতি, অর্থপাচার ও জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি সই ও প্রকল্পের নামে লুটপাটের তথ্য নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়নের জন্য ইতোমধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান ইউনূস।
“সারা দেশ ঘুষের মহাসমুদ্রে নিমজ্জিত। কীভাবে ঘুষ থেকে আমরা মুক্ত হতে পারি, তার জন্য আমাদের পরামর্শ দিন। শুধু এই কাজটা নিয়ে অগ্রসর হতে পারলেই আমি মনে করি দেশের জন্য এই সরকার একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছে বলে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমি কথা দিচ্ছি, এ ব্যাপারে আমি আমার সর্বশক্তি নিয়োজিত করব।”
স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত খাত মন্তব্য করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “জনগণের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষে স্বাস্থ্যখাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। এই খাতে সংশ্লিষ্ট সকলকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে।
“হাসপাতালগুলোকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে এবং সেখানে সরকারি ডাক্তারসহ বিশেষজ্ঞদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে। স্বাস্থ্যসেবা যাতে নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত না থাকে, দেশের সব অঞ্চলের মানুষ সমান স্বাস্থ্য সেবা পায়, সে লক্ষে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে আমরা বদ্ধপরিকর।”
নিরাপত্তা বাহিনী
ইউনূস বলেন, “দেশ প্রেমিক সেনা বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাবকে গুম-নির্যাতনের কাজে লাগিয়ে তাদের কলঙ্কিত করা হয়েছে। তারা দেশের গৌরব। তাদেরও কিছু অতি উৎসাহিত সদস্যের কারণে পুরো বাহিনীকে আমরা কলঙ্কিত দেখতে চাই না।
‘আমরা অপরাধীদের চিহ্নিত করতে চাই এবং তাদের শাস্তি দিতে চাই। যেন ভবিষ্যতে কারও হুকুমে দেশপ্রেমিক কোনো বাহিনীর, পুলিশের, র্যাবের কোনো সদস্য হত্যাকাণ্ড, গুম ও অত্যাচারে জড়িত হবার সাহস না করে। তাদের কাছে হুকুম যত বড় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেই আসুক না কেন, তারা তা উপেক্ষা করবে। ভবিষ্যতে উপরওয়ালার হুকুমে এমন ঘৃণ্য কাজ করতে বাধ্য হয়েছে, এমন ব্যাখ্যা কারো কাছে যাতে গৃহীত নাহয়, তার ব্যবস্থা করা হবে।”